তারেক : একটি বছর চলে যায়। আসে আরেকটি নতুন বছর। কালে কালে আমরা সে দিনটিকে পালন করতে শুরু করেছি। নববর্ষ পালনের ক্ষেত্রে একেক দেশ একেক রীতি পালন করে থাকে। নতুন বছরের প্রথম দিন পালনে অনেক দেশে আজব কিছু রীতিও রয়েছে। এদিকে, সারা বিশ্বেই বেজে গেছে ইংরেজি নতুন বছরের আগমনী বার্তা। এই দিনকে কেন্দ্র করে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া কিংবা আফ্রিকার থাকে নতুন নতুন আয়োজন। তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে তাঁরা এই ইংরেজি নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। তবে সব দেশের ইংরেজি বর্ষ পালনের কিছু সমর্থক উপায় আছে। যেমন-ভালো খাওয়া-দাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করা, পটকা-আতশবাজি ফোটান ইত্যাদি। আবার ভিন্নতাও আছে। সেই ভিন্নতা নিয়ে বাংলা ইনসাইডারের এই বিশেষ আয়োজন:
উত্তর আমেরিকা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উত্তর আমেরিকা মহাদেশের প্রায় অধিকাংশ দেশে ইংরেজি নতুন বছর মানে একটি সামাজিক ছুটির দিন। এ দিনে এই অঞ্চলটির মানুষেরা বিভিন্ন পার্টিতে অংশ নেয়, নানা ধরণের উৎসব উৎযাপন করে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশেষ উপায়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। আর তা হলো নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনের টাইম স্কয়ারের ৭৭ ফুট উঁচু একটি খুঁটির ওপর থেকে ক্রিস্টাল ও বৈদ্যতিক লাইটের একটি বল ফেলে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো। উত্তর অমেরিকার অন্যান দেশেও আছে বল ফেলানোর এই রীতি।
ইউরোপ
ইউরোপে ইংরেজি নতুন বছর উদযাপনের ধরন আবার এক দেশে হতে অন্য দেশে কিছুট আলাদা। যেমন-পর্তুগাল নতুন বছরকে স্বাগত জানায় ‘ম্যাজিক লাইটের মাধ্যমে। পর্তুগিজরা রাত ১২টার পরে তাঁরা ১২টি আঙ্গুর ফল খায়। তাঁরা মনে করে এই আঙ্গুর ফল তাদের নতুন বছরের জন্য সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসবে। স্পেন আবার পুরাতন বছরের রাতকে বৃদ্ধ রাত বলে অভিহিত করে। তাঁরাও ১২টি আঙ্গুর খেয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। তাদের এই আঙ্গুর খাওয়ার ঐতিহ্য ১৯০৩ সাল থেকে চলে আসছে।
ফ্রান্সের নতুন বছর উদযাপন কিছুটা আমাদের দেশের ঈদের মতো। তাঁরা এ দিয়ে বিশেষ কিছু দেশীয় খাবার খেয়ে থাকে সঙ্গে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের টাকা উপহার দেয়। যুক্তরাজ্য তাদের নতুন বছরের যাত্রা শুরু করে ‘ফাস্ট ফুট‘ বা বছরের প্রথম পদক্ষেপ বলে প্রচলিত একটি ঐতিহ্যের মাধ্যমে। জার্মানি ১৯৬৩ সালের একটি শর্ট ফিল্ম ‘ডিনার ফর ওয়ান’ দেখে নতুন বছর শুরু করে।
এশিয়া
এশিয়াতেও ইংরেজি নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্যবাহী উৎসবের আয়োজন করা হয়। যেমন জাপানীরা হাতে হাত ধরে এক ধরনের বেঁড়ি বা বন্ধন তৈরি করে যাতে করে তাদের ঘর থেকে যা কিছু খারাপ তা বের হয়ে যায়। চীনারা দীর্ঘ জীবনের প্রত্যাশায় বিশেষ খাবার গ্রহণ করে আর থাইল্যান্ড একে অপরের গায়ে পানির ছিটা দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। আর ভারত, বাংলাদেশের মতো এশিয়ার অন্য দেশগুলো ইংরেজি নতুন বছরে ভালো কাপড় পরে, নাচ-গান, খাওয়া-দাওয়া কিংবা বিভিন্ন পার্টিতে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে পার করে।
আফ্রিকা
আফ্রিকা জুড়ে নতুন বছর মানেই সরকারি ছুটির দিন। আর এই দিনে তাঁরা বিভিন্ন পার্টিতে যায়, নাইট ক্লাবে গিয়ে আনন্দ ফুর্তি করে থাকে। তবে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে নতুন বছরের উৎযাপন আবার কিছুটা ভিন্ন। তাঁরা ধর্মীয় কোন দিনকেও নতুন বছরের জন্য বেঁছে নেয়।
দক্ষিণ আমেরিকা
উত্তর আমেরিকার সঙ্গে মিল রেখে টাইম স্কয়ার থেকে বল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন দক্ষিণ আমেরিকানরা নতুন ইংরেজি বছরকে স্বাগত জানায় তেমনি ইউরোপের কিছু কিছু দেশের মতো আঙ্গুর খেয়ে নতুন বছরকে শুভেচ্ছা জানায়। এর বাইরে আর্জেন্টিনা এই দিনে পরিবারকে সময় দেয়। বলিভিয়া আবার ১২ বার একটি চেয়ারে উঠে এবং বসে এরপরে হাতে লাল সুতো বেঁধে নতুন বছর শুরু করে। ব্রাজিল আবার সাদা পোশাক পরে সমুদ্র পাড়ে যায় এবং সমুদ্রের ইশ্বরকে ফুল উৎসর্গ করে। কলম্বিয়ানরা এই দিনে তাদের রাতের খাবার টেবিলে ১২টি গমের শীষ রেখে নতুন বছর শুরু করে।
ভারত
ভারতে সম্রাট আকবরের সময় যে নওরোজ উৎসব হতো তা সর্বভারতীয় উৎসবের মর্যাদা পায়নি। অনেকে ভারতীয় বর্ষবরণ উৎসবকে দিওয়ালি উৎসব বলে অভিহিত করেন। এটি হয় বিভিন্ন রাজ্য বা সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী। পাঞ্জাবে নববর্ষ উৎসব পরিচিত বৈশাখী নামে। নববর্ষে পুষ্পসজ্জা প্রায় সর্বভারতীয় রেওয়াজ, দক্ষিণ ভারতের অঞ্চলবিশেষের মজাদার খাবার ও পুষ্পাহার গুরুত্বপূর্ণ প্রথা। তবে বর্তমানে ইংরেজি নববর্ষ পালন সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে প্রধানত নববর্ষ হিসেবে পহেলা বৈশাখকে জাকজমকভাবে পালন করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এতে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। তবে ১ জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষকেও পালন করা হয়। এ উৎসব অনেকটা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক পালিত হয়।
ফ্রান্স
ফ্রান্সে বছরের শেষ দিনে ঘরে থাকা সব মদ শেষ করতেই হবে। নতুন বছরে ঘরে পুরনো মদ পড়ে থাকা অশুভ। সৌভাগ্য ঘরে আসবে না। তবে ঘরে-থাকা মদ ফেলে দিলে চলবে না। খেয়েই শেষ করতে হবে৷। মদে মশগুল রাত, নতুন ভোর!
প্যারাগুয়ে
প্যারাগুয়ে বছরের শেষ পাঁচদিন তাদের ঘরে কোনো আগুন জ্বলে না। হয় না কোনো রান্না। ওই পাঁচদিনকে তারা পালন করে ‘ঠান্ডা খাবার খাওয়ার দিন’ হিসেবে। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর নতুন বছরের ঘণ্টা বাজলে হেঁসেলে আগুন জ্বেলে নতুন নতুন পদ, একসঙ্গে খেয়ে নতুন বছরে পা দেন তারা।
পোল্যান্ড
পোল্যান্ডেও বর্ষবরণটা বেশ মজার। এখানকার তরুণীরা বর্ষবরণের রাতে খরগোশের মতো পোশাক পরে জড়ো হয়। এরপর খরগোশের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি জোগাড় করে। তারপর ওই শাক-সবজির যতটা সম্ভব চিবিয়ে খায়! শাকসবজি খেয়ে নতুন বছরে পা দিলে নাকি নতুন বছরের দিন সুন্দর হবে।
বুলগেরিয়া
বুলগেরিয়ায় বর্ষবরণের দিন হাঁচি দেয়া বেশ মঙ্গলের। বর্ষবরণের দিন তাদের বাড়িতে আসা কোনো অতিথি যদি হাঁচি দেন, তাহলে বাড়ির কর্তা তাকে নিজের খামারে নিয়ে যান। এরপর ওই ব্যক্তির প্রথম নজর যে পশুর ওপর পড়বে, সেই পশুটি ওই ব্যক্তিকে উপহার দেয়া হয়।
হাঙ্গেরি
বছরের শেষ দিন হাঙ্গেরিবাসী হাঁস, মুরগি বা কোনো ধরনের পাখির মাংস খান না। উড়তে পারে এমন পাখির মাংস খেলে নতুন বছরে জীবন থেকে সব সৌভাগ্য উড়ে যাবে! তারা নতুন বছরে পরিচিত বা বন্ধুদের যে উপহার দেন, তাতে চিমনি পরিষ্কার করছেন এমন একজন শ্রমিকের ছবি থাকে। উপহারে এই ছবিটি থাকলে পুরনো বছরের সমস্ত দুঃখ নতুন বছরে মুছে যাবে।
ভিয়েতনাম
ভিয়েতনামের উত্তরের সংখ্যালঘু জাতি বছরের শেষদিনে প্রতিদিন জল সংগ্রহ করার জলাধারে দলবেঁধে গিয়ে মোমবাতি জ্বেলে মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করে এক কলস জল নিয়ে আসে। এরপর ওই জল দিয়ে বছরের প্রথম দিন রান্না করে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে উৎসর্গ করার পর নিজেরা খায়। বছরের প্রথম দিনে স্যুপ জাতীয় খাবার থাকে না। এছাড়া অনেকে নদী বা পুকুরে কার্প মাছ ছাড়েন।
আফ্রিকা
আফ্রিকার মাদাগাস্কারে নতুন বছর শুরুর সাতদিন আগে থেকে মাংস খাওয়া বন্ধ। বছরে প্রথম দিন বাড়িতে মুরগির মাংস রান্না হবে। প্রথমে তা খেতে দেয়া হবে বাবা-মাকে। বাবা-মাকে খেতে দেয়া হয় মুরগির লেজের দিকের অংশটা। আর ভাই-বোনদের দেয়া হয় মুরগির পা।
অস্ট্রেলিয়া
সিডনিতে নববর্ষ উপলক্ষে প্রায় ৮০ হাজার আতশবাজী ফোটানো হয় যা ১৫ লাখ লোক উপভোগ করে।
স্কটল্যান্ড
এ সময় সবাই নিজেদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে নতুন বছরের আগমনের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় জুনিপার গাছের ডাল পোড়ানো হয়। নববর্ষের দিন যে মানুষ প্রথম বাড়িতে পা রাখে সে-ই ওই বছর বাড়ির সদস্যদের ভাগ্য নির্ধারণ করে। স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় যে নববর্ষ উৎসব হয় তা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। চার দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে মানুষ আসে।
রাশিয়া
গ্রান্ডাফাডার ফ্রস্ট, যে সান্টাক্লসের লালের পরিবর্তে নীল স্যুট পরে, এ দিন শিশুদের মধ্যে খেলনা বিতরণ করে।
জার্মানি
এখানে মানুষ ঠান্ডা পানির মধ্যে তরল সিসার টুকরা ঠেলে দেয়। সিসার টুকরা যে রকম আকার বানায় তা দেখে ভবিষ্যৎ নির্ণয় করা হয়। নববর্ষের আগে খাওয়া খাবারের কিছু অংশ মধ্যরাতের জন্য রেখে দেয়া হয়, যাতে করে নতুন বছর ঘরে পর্যাপ্ত খাবার থাকে।
চীন
পূর্ণিমার শুরুর দিন থেকে শুক্লপক্ষের পনেরো দিন উৎসব চলে নববর্ষ উপলক্ষে। চীনারা নববর্ষ পালন করে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী। নববর্ষের প্রথম দিনে তারা স্বর্গ ও পৃথিবীর দেবতাকে তুষ্ট করে নানা উপাসনা-উপাচারে, দ্বিতীয় দিন পূর্বপুরুষের মঙ্গল কামনা করে। ‘ওয়েইলু’ নামক বিশেষ ভোজনের আয়োজন করা হয় এ দিন। পক্ষব্যাপী আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের মধ্যে সপ্তম দিনটি পালিত হয় ‘শস্য দিবস’ নামে।
জাপান
জাপানে নববর্ষের সময় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। খারাপ আত্মাকে দূরে রাখার জন্য এ সময় বাড়ির বাইরে দড়ি দিয়ে খড়ের টুকরো ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এটাকে তারা সুখ এবং সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখে। নতুন বর্ষ শুরু হওয়ার সাথে সাথে জাপানিরা হাসা শুরু করে, এতে নতুন বছর সৌভাগ্য নিয়ে আসে।
ব্রাজিল
ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো সমুদ্রসৈকতে নববর্ষের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হয়। এর অন্যতম আকর্ষণ চোখধাঁধানো আতশবাজির প্রদর্শনী। এ দিন অনেকেই সাদা পোশাক পরে। সমুদ্রে সাতটি ডুব দিলে এবং সাতটি ফুল ছুড়ে দিয়ে তারা মনে করে বছরটি খুব ভালো কাটবে। এ উৎসবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় দুই মিলিয়ন পর্যটক যোগ দেয়।
আর্জেন্টিনা
আর্জেন্টিনায় নববর্ষের আগের দিন রাত্রে পরিবারের সবাই একত্রে খাবার টেবিলে বসে আহার করে। ভোর পর্যন্ত চলে নানা অনুষ্ঠান। নববর্ষের প্রথম দিন নদী বা পুকুরে সাঁতার কেটে তারা নববর্ষ উদযাপন করে।
কোরিয়া
কোরিয়াতে নববর্ষ শুরুর সময় কেউ ঘুমায় না। এ সময় ঘুমালে নাকি চোখের ভ্রূ সাদা হয়ে যায়! রাত ১২টা বাজার সাথে সাথে টিভিতে ৩৩ বার ঘণ্টা বাজানো হয়। কোরিয়ার ৩৩ বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এটি করা হয়। কোরিয়াতে প্রায় সবাই সূর্যোদয় দেখে। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ার সময় একজন আরেকজনকে শুভেচ্ছা জানায়।
মেক্সিকো
মেক্সিকোতেও ১২টা বাজার সাথে সাথে ১২ বার ঘণ্টা বাজানো হয়। এ সময় প্রতি ঘণ্টাধ্বনির সাথে একটি করে আঙুর খাওয়া হয়। তারা বিশ্বাস করে এ সময় যা কামনা করা হয়, তাই পূরণ হয়।
সূত্র- জাগো, বাংলা ইনসাইডার,