সাইফুর রহমান সাগর : পৃথিবীর বুক থেকে যখন মানবতা শূন্যের শেষে বিকাশমান, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো হয়ে উঠলেন পৃথিবীর মানবকুলের মানবতার এক বিরল দৃষ্টান্ত। তার বাবাও ছিলেন কানাডার একজন সফল প্রধানমন্ত্রী, রক্তে মাংসে রাজনীতির বাহক জাস্টিন ট্রুডো এমন এক সময় কানাডার প্রধানমন্ত্রী হলেন যখন, সারা পৃথিবীতে অভিবাসী অত্যাচার চরমে। পৃথিবী জুড়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে, মুসলমানদের সংখ্যা অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসি আগ্রাসনে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ মুসলিম দেশ গুলির নাগরিকরা বর্তমানে বিভিন্ন দেশে অভিবাসিতো হয়ে আছে যা ,স্মরণকালের যে কোনো সময়ের থেকেও বেশি। আন্তর্জাতিক অভিবাসন আইনের অধিকার নিয়ে এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কোনো দয়া নয়, নিতান্তই অধিকার যখন খড়গ এর ন্যায় সামনে এসে দাঁড়ায়, এর চেয়ে কঠিন সময় মানব জীবনে আর কিছুই থাকে না। সাম্প্রতিক কালের অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও ধনী রাষ্ট্র, যে দেশ আন্তর্জাতিক মানবিক আইন প্রণয়নে অগ্র ভূমিকা পালন করেছেন সব সময়, সেই আমেরিকাও এখন অভিবাসন বিমুখ ও অভিবাসী নির্যাতনে প্রথম স্থানে চলে যাচ্ছে।
এ থেকে বুঝা যায় যে, পৃথিবীর মানবতা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দুদোল্যমান, মানবতাকে যখন ফাঁসিতে ঝুলানোর প্রস্তুতি চলছে তখন, মানবতার মুক্তির জামিননামা নিয়ে হাজির হলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। অন্যান্য মানবিক দেশগুলো যখন অভিবাসনকে অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত করছে, জাস্টিন ট্রুডো তখন অভিবাসীদেরকে তার দেশের সর্বোচ্চ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। পার্শ্ববর্তী দেশসহ পৃথিবীর যেসব দেশ যুদ্ধে বিদ্ধস্ত, সেসব দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষকে কানাডায় এনে অভিবাসনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন বিনা সর্তে। পৃথিবীর সৃষ্টির পর থেকে বহুবার মানবতার বিপর্যয় ঘটেছিল, আর সেই বিপর্যয়কে কাটিয়ে উঠানোর জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত অনেক মহামানবরা যুগ যুগ ধরে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, জাস্টিন ট্রুডো হয়তো তেমনি মহামানবদের ধারাবাহিকতায় প্রেরিত একজন মানুষ যিনি, মানবতার লাগামকে আঁকড়ে ধরে পুনঃস্থাপন করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
সর্বশেষ নির্বাচনে অভিবাসন সহজীকরণ ও আন্তর্জাতিক শান্তি বজায় রাখার নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয় লাভ করেছেন, কানাডার ইতিহাসে সর্ব কনিষ্ঠ এই জাদুকর প্রধানমন্ত্রী। জয়ী হবার পর, প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষণ পৃথিবী ব্যাপী সমাদৃত ও জনপ্রিয় হয়েছিল, তার ভাষণে কয়েকটি উদ্বৃতি সারা বিশ্বের রাজনীতিবিদদের মনে ঝড় তুলে দিয়েছিল, কানাডার অনেক মানুষ খুশিতে সেদিন কেঁদেছিল। তার ভাষণে বিশেষ করে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তিনি কোড করে বারবার পাশে থাকার ইঙ্গিত করে গেছেন, যে কারণে কানাডাতে মুসলমানদের নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে। জাস্টিন ট্রুডোর জীবন ব্যবস্থা একেবারেই সাদামাটা ছিল, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও ঠিক অনুরূপ ভাবেই চলাফেরা করার চেষ্টা করেন পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম রাষ্ট্রের প্রধান এই নেতা। এখনো তিনি সাইকেল চালিয়ে মানুষের মাঝে চলে আসেন কোনো সরকারি নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া। তার চলাফেরা সাধারণ মানুষের খুব কাছেই থাকে যে কেউ তার সাথে হাত মেলাতে চাইলে, তিনি নিজে কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দেন। মুসলমান নারীদের সাথে পরিচয়ের সময় করমর্দনের জন্য কখনোই হাত বাড়িয়ে দেন না, কারণ তিনি জানেন মুসলিম নারীরা পর পুরুষদের হাতস্পর্শ করেন না। এখানে যারা আশ্রয় চাইতে আসেন তাদেরকে, সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধা দিয়ে থাকেন কানাডা। গত সরকারের আমলে কিছুটা বৈষম্য আনলেও, ট্রুডো সরকার সব বাঁধাকে সরিয়ে অভিবাসন বান্ধব আইন তৈরি করে যাচ্ছেন দিনকেদিন।
তিনি রোজার শুরুতেই সারা মুসলিম বিশ্বের প্রতি সম্পূর্ণ পরিষ্কার উচ্চারণে সালাম দিয়ে রোজার মাসের অভিনন্দন জানান, নন মুসলিম দেশের প্রধানের কাছ থেকে এমন আচরণ একেবারেই বিরল। রোজদারী অভিবাসীদের সাথে মেঝেতে বসে ইসলামী পোশাক পরিধান করে সবার সাথে ইফতার করেছেন অনেকবার। পৃথিবীর সব দেশেই বোরকা পরিধানের উপর নানা আপত্তি ও বিপত্তি থাকলেও, কানাডাতে বোরকা পরিধান বা যে কোনো পোশাক পরিধানে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা। অনেক মজার বিষয় হলো, অনেক বাংলাদেশিরা তাকে বন্ধু হিসেবেও পরিচয় দিয়ে থাকে কারণ, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পূর্বে তিনি বেশিরভাগ সময় পায়ে হেঁটেই চলা ফেরা করতেন। বাংলাদেশিদের সামাজিক এবং অনেক ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও যোগদান করেছেন বহুবার, অনেক বাঙালিদের সাথে রয়েছে ঘনিষ্টতার ছবি, অনেকের কাছেই রয়েছে তার ব্যবহৃত খুদে ফোন নাম্বার। তার মানবিক হাজারো উদাহরণ রয়েছে, এমন উদারতা নিতান্তই ঐতিহাসিক মহামানবদের মহানুভবতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
তার দেওয়া কয়েকটি ঐতিহাসিক উক্তি’ ২০১৭ সালে এমন ধরনের উক্তি নিতান্তই আমাদের কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হয়, জাস্টিন ট্রুডো অঙ্গিকারের প্রতিটা স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপান্তর করে বিশ্বনেতাদের কাছে এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে রয়ে চলেছেন।
দীর্ঘজীবী হোক কানাডা, দীর্ঘজীবী হোক জাস্টিন ট্রুডো।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, মন্ট্রিয়ল, কানাডা
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ