ডেস্ক রিপোর্ট : নানামুখী পদক্ষেপ নেয়ার পরও শব্দদূষণ কমছে না। রাজধানীতে শব্দের মাত্রা এর ‘মানমাত্রার’ চেয়ে দেড় থেকে ২ গুণ বেশি। সম্প্রতি পরিচালিত পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
শব্দদূষণের ফলে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদিকে শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের অনেকটা বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। সেখানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কর্মসূচির আওতায় দেড় শতাধিক বধির শিশু কানে শুনতে পাচ্ছে এবং এরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।
শব্দদূষণ থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দেয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। চলতি বছর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হাইকোর্ট হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণবিধি-১৯৯৭ ও শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধি-২০০৬ অনুযায়ী ঢাকার গুলশান, বনানী, অফিসার্স ক্লাব, বারিধারা ও ধানমন্ডি এলাকাসহ সারা দেশে উচ্চশব্দ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নজরদারি টিম গঠনে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বেসরকারি সংগঠনগুলো শব্দদূষণ কমাতে প্রায়ই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জরিপ চালায়। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ঢাকা মহানগরীর ৪৫টি স্থানে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে। নীরব এলাকায় দিবাকালীন, আবাসিক এলাকায় দিবা ও রাত্রিকালীন, মিশ্র এলাকায় দিবা ও রাত্রিকালীন এবং বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। এছাড়া বাসের ভেতর, সামনে ও পেছনে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা হয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত পবার প্রতিবেদনে বলা হয়, নীরব এলাকায় দিনের বেলা শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় থেকে ২ গুণ, আবাসিক এলাকায় দিনের বেলা শব্দের মাত্রা দেড় ও রাতে শব্দের মাত্রা দেড় থেকে প্রায় ২ গুণ, মিশ্র এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা দেড় ও রাতে শব্দের মাত্রা দেড় থেকে ২ গুণেরও বেশি। এছাড়া বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণ বেশি। নীরব এলাকায় দিনের বেলা শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি ইডেন মহিলা কলেজের সামনে, ১০৪.৪ ডেসিবল। মিশ্র এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি পল্টনে, ১০৫.৫ ডেসিবল। আর রাতে শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি কলাবাগানে, ১০৬.৪ ডেসিবল। অন্যদিকে বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে, ১০৮.৯ ডেসিবল।
পবার সাধারণ সম্পাদক আবদুস সোবহান বলেন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ ২০০৬ বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারবে না। কিন্তু আইন ও বিধিবিধান থাকলেও সেগুলোর প্রয়োগ না থাকায় রাজধানীতে শব্দদূষণের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শব্দদূষণে শিশুদের শ্রবণযন্ত্রের ক্ষতি হয় বেশি। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ শ্রবণপ্রতিবন্ধী রয়েছেন। এছাড়া প্রায় ৫০ লাখ মানুষ রয়েছেন, যাদের কোনো না কোনো মাত্রায় শ্রবণহীনতা রয়েছে। বাংলাদেশ শব্দের তীব্রতা ৬০ ডেসিবেলের কম হলে শুনতে না পাওয়া ব্যক্তিকে শ্রবণপ্রতিবন্ধী বলে। বিশ্বে ৫ শতাংশের বেশি মানুষের কোনো না কোনো মাত্রায় শ্রবণহীনতা রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটি ২৭ শতাংশ। আর বাংলাদেশে ৩৩ শতাংশ। জাতীয় নাক কান গলা (ইএনটি) ইনস্টিটিউটের এ তথ্য জানায়।
বাংলাদেশে শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা পর্যাপ্ত নয়। দেশে ৫৫০ জনের মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ৩ লাখ মানুষের জন্য একজন নাক-কান-গলার রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য মাত্র আটটি বিশেষ বিদ্যালয় আছে। এখানে সব মিলিয়ে ১ হাজার শিক্ষার্থীর পড়ার সুযোগ রয়েছে। মাধ্যমিক থেকে উচ্চস্তরে শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ প্রায় শূন্যের কোটায় রয়েছে। এ কারণে শিক্ষার অভাবে এরা দক্ষ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে পারছে না।
জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান বলেন, অনেকে জন্মগতভাবে কানে শোনে না। আবার অনেকে দুর্ঘটনা বা নানা রোগের কারণে শ্রবণশক্তি হারান। আমাদের দেশে শব্দদূষণও বেশি।
তিনি বলেন, অসচেতনতা, অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে অনেকে শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন। পরিবারে মা-বাবার কারণেও অনেক শিশুর শ্রবণ সমস্যা হয়।
এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চলছে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কর্মসূচি। এর আওতায় দেড় শতাধিক শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশু কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি সম্পন্ন করে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। শব্দহীন পৃথিবী থেকে এসব শিশু ফিরে এসেছে শব্দময় মধুরতম সুরের ভুবনে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট জীবন বদলে দেয়া এক অসাধারণ আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। এত দিন যে চিকিৎসা শুধু উন্নত দেশে হতো, তা এখন হচ্ছে বাংলাদেশে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট এক ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে চিকিৎসায় ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকা ব্যয় হয়ে থাকে। কিন্তু সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় অনেকটা বিনামূল্যেই এ চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে এ ধরনের ইমপ্লান্ট প্রতিস্থাপন করে দেড় শতাধিক শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। চলতি অর্থবছরেও ৫০ বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশু বিনামূল্যে এ চিকিৎসা পায়।
ঢাকার মিরপুরের ওয়ালিদ হোসেন তানহার মা কুলসুম বেগম জানান, তার সন্তানও বধির ছিল। বিএসএমএমইউয়ে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করার পর এখন অনেকটা স্বাভাবিক কথা বলতে ও শুনতে পারে। বিএসএমএমইউয়ে বিনামূল্যে সেবার জন্য বিবেচিত না হলে, ইমপ্লান্ট কিনে শুধু ২৫ হাজার টাকার মতো সার্জারি ফি দিলেই যে কেউ সেবা পেতে পারেন। আলোকিত বাংলাদেশ