শিরোনাম
◈ জাতীয় স্বার্থের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না : আশিক চৌধুরী ◈ স্ত্রীকে বিদেশ যেতে বাধা, বিষয়টিকে বিব্রতকর বলে মন্তব্য করেছেন পার্থ! (ভিডিও) ◈ এনবিআর বিলুপ্তি করা হলো কেন, জানাল সরকার ◈ কোম্পানীগঞ্জে প্রবাসী পরিবারের ওপর হামলা ও গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন ◈ অর্থনীতিতে স্বস্তির বার্তা : জুনে আইএমএফ-এর ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ ◈ স্থ‌গিত হওয়া পিএসএল ১৭ মে আবার শুরু, প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ সিরিজে ◈ ক্লাব বিশ্বকাপের আগে আর্জেন্টিনার ১৫ হাজার সমর্থককে নিষিদ্ধ করা হলো ◈ শার্শায় ৩০ মামলার আসামী আইনাল গ্রেফতার ◈ ইতালিতে কড়া অভিবাসন নীতি, টার্গেটে বাংলাদেশিরা! ◈ তরুণী মা'রধরের নেপথ্যে লঞ্চের ভেতরে সেদিন কী ঘটেছিল? ভিডিও প্রকাশ্যে

প্রকাশিত : ০১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৯:২৪ সকাল
আপডেট : ০১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৯:২৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রোহিঙ্গা ইতিহাস: বাংলাদেশ, বার্মা ও আরাকান প্রেক্ষাপট

মাহবুবুর রব চৌধুরী : ইতিহাসের স্বাধীন আরাকান, রাখাইন নামে বর্তমানে মিয়ানমারের সাতটি রাজ্যের একটি। মিয়ানমারের পূর্ব নাম বার্মা। সরকার স্বীকৃত ১৩৫টি ভাষাভাষী সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির মাঝে মূল বার্মার ‘বামার’ ভাষীরাই সবচেয়ে বড় অংশ। বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের উৎস এবং নিস্পত্তির সূত্র খুঁজে পেতে হলে আরাকান ও বার্মার অতীত জানা দরকার। তাই রোহিঙ্গা সংকটের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস না জেনে, শুধুমাত্র খন্ডিত চিত্রতে সমাধানের প্রচেষ্টা কার্যকরী ভূমিকা রাখবেনা এবং স্থায়ী শান্তিও আসবেনা।

আরাকান ও বার্মার সুদীর্ঘ ইতিহাস দ্ব›েদ্ব ভরা। সেখানে রয়েছে আগ্রাসী দখলদারিত্বের কাহিনী। ২০১৭ সালের আগস্টের শেষভাগে মিয়ানমার নতুন করে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের অসহায় অবস্থায় নিজ জন্মভূমি থেকে জোর করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। তাই বিষয়টি বিশ্ব ফোরাম ও গণমাধ্যমে এসেছে। মগের মুল্লুক কথাটি এখনও যে বার্মার জন্য প্রযোজ্য তা এবারও দেখাল বার্মা। সুকি’র তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের, অর্থাৎ সামরিক, আধাসামরিক, নাসাকা এবং সশস্ত্র বৌদ্ধ জঙ্গিদের পরিকল্পিত হামলার মুখে নিরুপায় হয়ে জীবন, মান-সন্মান, ইজ্জত বাঁচাতেই রোহিঙ্গারা স্থাবর ও অস্থাবর সবকিছু ফেলে দিয়ে বাংলাদেশ আসতে বাধ্য হয়েছে। রোহিঙ্গা নির্মূল পরিকল্পনায় বা এথনিকক্লিনজিংয়ে গণহত্যা, পাশবিক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ সব ধরণের বর্বরতার অবলম্বন মগ-বার্মিজরা নিয়েছে। এটি বর্বরতার ইতিহাসে নুতন সংযোজন। মগের মুল্লুক কথাটি বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, নিয়ম-নীতিহীন অরাজকতাকেই বোঝায়।

বাস্তবে মিয়ানমার সংশ্লিষ্ট এই বিশেষ শব্দগুলো কোন প্রেক্ষাপটে এবং কিভাবে প্রচলিত হয়েছে, তা নিশ্চয়ই জানার কৌতুহল অনেকের রয়েছে। যেমন- মগ, রোহিঙ্গা, আরাকান, আকিয়াব ইত্যাদি। উত্তর খুঁজলে যা পাওয়া যায় তা হল, ভারতের মগধ থেকে আসা বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকদের কারণে মগ শব্দটি এসেছে। যারা নব দীক্ষা পেয়েছে মূল বার্মার সেই বর্মীদেরকেই লোকে মগ বলে। আররক্কন থেকে আরাকানের উৎপত্তি। রক্কন অর্থ পিলার বা স্তম্ভ এবং ইসলামের পাঁচ স্তম্ভেও একটি, আররক্কন। আকিয়াব অর্থ একটি নদীর পাড়ে বা জলের ধারে। যেমন- পাঞ্জাব, পাঁচ নদীর পাড়ে, তেমনি আকিয়াব আকিয়াব নদীর পাড়ে। একইভাবে রোহিঙ্গা নামের উৎপত্তিতে রয়েছে আরো চমৎকার এক কাহিনী। বহুকাল আগে আরাকান উপকূলে এক আরব জাহাজডুবির পর সবাই অলৌকিকভাবে প্রানে বেঁচে যায়। কিভাবে বাঁচল, সেই প্রশ্নের উত্তরে সবাই বলেছিল আল্লাহর রহমতে। এই রহমত থেকেই তারা রোহিঙ্গা হিসাবে পরিচিতি পেয়ে যায়।পরবর্তীতে আর যারা এই ক্যাটাগরিতে রোহিঙ্গা হিসাবে যোগ দেয়, তারাও প্রধানত ১৪৩০ সালে নরমিখলার আমলে বাংলাদেশ ও আসাম অঞ্চল থেকে যাওয়া মূলত মুসলিম কৃষক পরিবার। নরমিখলা বাংলার সুলতানের ৩০ হাজার মুসলিম সেনা সহযোগিতায় ২৪ বছর পর মগদের দখল থেকে আরাকানের স্বাধীনতা উদ্ধার করেন।

এই রোহিঙ্গারাই আরাকানের মাটিতে রহমতের জোয়ার এনেছে। শত শত বছরের বিরান অনাবাদি পতিত জমিতে সোনার ধান ফলিয়ে একদিকে খাদ্য অভাব পূরণ করেছে, অন্যদিকে মৎস্যজীবিদের থেকে দ্বিগুন খাজনা দিয়ে রাজকোষ ভওে তুলেছে। উৎপাদনশীল এই কর্মকান্ড রাজা, প্রজা, সকলের কাছেই পজেটিভ ইমেজে ধন্য হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সন্মান ও মর্যাদা সুনাগরিক হিসাবে স্বাধীন আরাকানের মারাউকি আমলের ৩৫৫ বছর থেকে বাড়া বৈ কমেনি। আরাকান বাংলা ভাষী দেশ না হলেও মেজরিটি রোহিঙ্গার ভাষা বাঙলা হওয়ার কারণেই রাজসভায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চাটা একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। উৎপাদনশীল সুনাগরিক রোহিঙ্গারা ছিলেন মগদের সামাজিক, কৃষ্টিক, রাজনৈতিক এবং হামলা ও আক্রমণের মুখে শক্ত প্রতিরোধ। রোহিঙ্গারা মূলত মুসলিম হবার কারণে বাংলা ও মোগল ভারতের নজওে এসেছিলেন। এটা মগদের বিরুদ্ধে কাউন্টার ব্যালান্স হিসেবে সাহায্য করত। দ্বিতীয়ত রোহিঙ্গারা নিয়মিত খাজনা দিয়ে প্রশাসন এবং সেনাবাহিনী সচল রাখতে বিরাট ভূমিকা রাখতেন। আরাকান, বার্মার ইতিহাস, বাংলার সুলতান এবং মোগল ভারতের ইতিহাসের মাঝে রোহিঙ্গা ইতিহাসের বীজ লুক্কায়িত। সম্ভবত সিনো, মঙ্গোলয়েড নামের উচ্চারণভঙ্গির কাঠিন্যেও কারণে এবং কিছুটা কষ্টসাধ্য এবং কিছুটা অপরিচিত আর অপ্রচলিত হবার কারণেই রোহিঙ্গাদেও নিয়ে ইতিহাস চর্চা ততটা হয়নি। একই কারণে হয়ত বার্মার আরাকানি ইতিহাস আমাদের কাছে খুব একটা পরিচিত এবং আলোচিত বিষয় নয়। আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের মজবুত গাঁথুনি নির্মাণে এই ইতিহাস চর্চা জরুরি। এটা আমাদের স্বার্থেই প্রয়োজন।

আর্কিওলজিক্যাল নিদর্শনের ভিত্তিতে বার্মা ও আরাকানে জনবসতির ইতিহাস অনেক পুরনো। ইতিহাসে এ দুটি দেশের ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক চিত্র হল- বার্মা দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়, বে অফ বেঙ্গলের পাড়ে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, লাওস এবং থাইল্যান্ড দিয়ে ঘেরা একটি দেশ। আরাকান পর্বতমালা প্রাকৃতিকভাবে বার্মা ও আরাকানকে দুটি পৃথক ভূখন্ডে ভাগ করেছে; অর্থাৎ ইঁৎসধ পড়াবৎং ৬৫৩,৫০৮ ংয়ঁধৎব শরষড়সবঃবৎং ড়ভ ষধহফ ধহফ ২৩,০৭০ ংয়ঁধৎব শরষড়সবঃবৎং ড়ভ ধিঃবৎ, সধশরহম রঃ ঃযব ৪০ঃয ষধৎমবংঃ হধঃরড়হ রহ ঃযব ড়িৎষফ রিঃয ধ ঃড়ঃধষ ধৎবধ ড়ভ ৬৭৬,৫৭৮ ংয়ঁধৎব শরষড়সবঃবৎং. বার্মা এবং আরাকানের এথনিক জনগোষ্ঠির ভাষা, ধর্ম এবং নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যের মূল দিকগুলো ভিন্ন। কেননা বার্মার মূল অংশ আপার বার্মায় প্রায় ১৪০টি এথনিক জাতিগোীষ্ঠ রয়েছে। সংখ্যার বিবেচনায় বামার বা বার্মান ৬৮%, সান ৮%, কারেন ৬%, রাখাইন ৩%, মন ৩%, চিন ৩%, রোহিঙ্গা ২%, কায়া ১%, কাইন ১% এবং অন্যান্য ৫%। আপার বা মূল বার্মায় ৯০% থেরাভাদা বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারী। আর আরাকানের বৌদ্ধরা মাহিয়ানা গোত্রের অনুসারী। বার্মার জন সংখ্যা ৫৬,৮৯০,৪১৮ জন। এক্ষত্রে থেরাভাদা বৌদ্ধ ও মাহিয়ানা বৌদ্ধ গোত্রের পার্থক্য হচ্ছে- থেরাভাদা (ঞযবৎধাধফধ ঝবপঃং: ঞযব ঃবধপযরহম ড়ভ ঃযব বষফবৎং) বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে জীবনচক্র বা ঘরৎাধহধ। অর্থাৎ মহামুক্তি নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত অসম্ভব। অপরদিকে আরাকানের মাহিয়ানা গোত্রের অনুসারী বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে জীবনচক্র বা ঞযব মৎবধঃ াবযরপষব, মহামুক্তি ঘরৎাধহধ উন্নত জীবন অর্জন করলেই পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ থেরাভাদা (ঞযবৎধাধফধ ঝবপঃং: ঞযব ঃবধপযরহম ড়ভ ঃযব বষফবৎং, পারফেক্ট লাইফ এবং গধযধুধহধ (ঞযব মৎবধঃ াবযরপষব), ইবঃঃবৎ ষরভব -এর অনুসন্ধানী।

আর আরাকান হচ্ছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি ছোট কোস্টাল দেশ। আয়তন ১৪ হাজার ২ শত বর্গ মাইল। ২০১৪ সনের আদমশুমারি অনুসারে জনসংখ্যা ৩১, ৮৮,৮০৭; যাদের মাঝে রয়েছে রাখাইন, রোহিঙ্গা, মারমা, মোরো, কামান, কামিন, খামি, সান নৃ জাতিগোষ্ঠি। দৈর্ঘ্যে ৪০০ মাইল এবং সাগর থেকে শেষ সীমানায় বৃহৎ ও ক্ষুদ্রাংশ ৯০ থেকে ৪৫ মাইল। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে ২০৮ মাইল স্থল আর ৬৩ মাইল জল সীমানা অঙ্গীভূত। আরাকানের মংদু শহরটি বাংলাদেশ থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরেই অবস্থিত। কোন এক সময় সেখানে যাতায়াতের রাস্তাটি বাংলাদেশ নিজ খরচে ‘বাংলাদেশ বার্মা ফ্রেন্ডশিপ রোড’ নামে করে দিতে চেয়েছিল। এখানে পূর্ব থেকে পূর্বে ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট-এ মিশে যাওয়ায়, তা বাংলাদেশ, বার্মা, চীন, ভারত, থাইল্যান্ডসহ অপরাপর পূর্ব এশিয়ার দেশের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় শত বিলিয়ন ডলারের বাৎসরিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ‘ডায়মন্ড রোড’ বললে অত্যুক্তি হবে না।
তাই বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটটি উদ্দেশ্যে প্রণোদিত ও গভীর ষড়যন্ত্রমূলক। সেজন্যই রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা,সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফলশ্রæতি। সেপ্টেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত সময়ের তথ্যানুসারে বিতাড়িত রোহিঙ্গার সংখ্যা যথাক্রমে- বাংলাদেশে ৮৯০,০০০, পাকিস্তানে ৩৫০,০০০, সৌদি আরবে ২০০,০০০, মালয়েশিয়াতে ১৫০,০০০, ভারতে ৪০,০০০, আরব আমিরাতে ১০,০০০, থাইল্যান্ডে ৫,০০০, ইন্দোনেশিয়ায় ১,০০০ এবং ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশে ৪,০০০ জন। এভাবে দেশ ও ঠিকানাবিহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে।
তথাপি প্রাচীন ধানী ওয়াদি শাসনামল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আরাকানের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। সুদূর অতীতে আরাকান ছিল একটি সুন্দর পর্যটনের দেশ। এখনও সেই গৌরবময় অতীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব, এমনকী আরাকান হতে পারে ঘরের পাশের নুতন হংকং। তাই ধানি ওয়াদি আরাকান থেকে মগ বার্মার রাখাইন অবধি পথচলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটা হচ্ছে- (১) প্রাক্ ঐতিহাসিক আমল। (২) ধানি ওয়াদি আমল: খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ। (৩) ভেসালি বা ওয়াথালী আমল: ৩০০ থেকে ৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দ। (৪) এটি তিন পর্বে বিভক্ত, যেমন- লেমরু আমল, সময়কাল ৫১২ বছর অর্থাৎ ৮৯৪- ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দ। ক) প্রথম লেমরু স্বাধীন আমল। খ) অর্ধপরাধীন লেমরু আমল ১০৪৪-১২৮৭ পর্যন্ত। অর্থাৎ ১০৪৪ সালে প্যাগান রাজা আনারাথার আরাকান আক্রমণ এবং খাজনা নেবার শর্তে লেমরু শাসনের দ্বিতীয় পর্বের শুরু, যা ১২৫৫ সাল অবধি মঙ্গোলীয় আক্রমন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। গ) পুর্নস্বাধীন লেমরু আমল: ১২৫৫- ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এক্ষেত্রে শেষ বা তৃতীয় পর্বের রাজা ছিলেন মিন স মন। তার আরো দুটি নাম ইতিহাসে রয়েছে, যেমন- নরমিখলা এবং সবশেষে ইসলাম ধর্মগ্রহণ, যেখানে সুলতান মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ হিসেবে নাম ধারণ করেন। (৫) পরাধীন আমল (আভা মগের দখলে ২৪ বছর অর্থাৎ ১৪০৬-১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দ। এ সময়ে বার্মার আভা রাজা মিন খং ১৪০৬ সালে লেমরু শাসনের শেষ রাজা, মিন স মন বা নরমিখলাকে পরাজিত করে আরাকান দখল করে নেন। এই দখল ২৪ বছর স্থায়ীত্ব লাভ করে এবং রাজা নরমিখলা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের দরবারে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। এতে আজম শাহ রাজা নরমিখলাকে আরাকান উদ্ধাওে সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। কিন্তু তিনি মারা গেলে সুলতান মোহাম্মদ জালালউদ্দিন শাহ বাংলার ৩০ হাজার সেনাবাহিনী আরাকানর উদ্ধাওে প্রেরণ করেন। সুলতান মোহাম্মদ জালালউদ্দিন শাহ ছিলেন রাজা গণেশের পুত্র। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নতুন নামে বাংলা শাসন করেন। (৬) স্বাধীন আরাকান মারাউকি আমল ১৪৩০-১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ ৩৫৫ বছর। (৭) পরাধীন মগ আমল ১৭৮৫- ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশদের আরাকান দখলের পূর্ব পর্যন্ত মোট ৪২ বছর আরাকানের অন্ধকার যুগ হিসেবে বিধৃত। (৮) ব্রিটিশ রুল: ১৮২৬-১৯৪৮ পর্যন্ত। (৯) পুর্নমগ বার্মা শাসন আমল: ১৯৪৮-২০১৭ বর্তমানকাল, যা মিয়ানমার নামে বর্মী শাসনাধীন।

তাই কালের আবর্তে জাতিগতভাবে আরাকানের আদিমানুষ ইন্দো-মঙ্গোলয়েড। সেখানে রাজা নরমিখলা ছিলেন বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং লেমরু সা¤্রাজ্যের শেষ রাজা ও মারাউকি সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, যা তিনটি ধারার বিস্তৃত। তবে তার নরমিখলা নামটি প্রাচীন ভারতীয় পরিচয় বহনের পাশাপাশি মিন স মন মঙ্গোলয়েড প্রভাবেরই স্ফূরণ। আর মোহাম্মদ সোলাইমান শাহ স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী সংগ্রামী পরিচয়ে দেশ ও জাতিকে মুক্ত ও স্বাধীন করার অঙ্গীকার, যিনি অবশেষে মগ শাসনের উৎখাত ঘটিয়েছেন। অবশ্য মারাউকি আমলকে স্বাধীন আরাকানের স্বর্ণযুগও বলা হয়। এক্ষেত্রে ১৪৩০-১৭৮৫ পর্যন্ত ৩৫৫ বছর আরাকানের রাজদরবারে মুসলিম ও ইসলামী ভাবধারা এবং ঐতিহ্যের কদর গড়ে উঠেছিল। তখন আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চাও হত। সেটি হঠাৎ আর্বিভূত হয়নি, বরং এর সঙ্গে ছিল আরাকানের মুসলিম ও রোহিঙ্গাদেও সবিশেষ অবদান; ছিল গভীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এই মারাউকি আমলের শাসনামলে সর্বমোট ৪৮জন রাজা দেশ শাসন করেছেন। তারা মুসলমান এবং মাহিয়ান আরাকানি বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ইতিহাসের পাতায় তাদের সকলেরই সিনো-মঙ্গোলয়েড নাম রয়েছে।

এটা সর্বজনবিদিত যে, মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চার প্রানকেন্দ্র ছিল আরাকান রাজসভা। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব হল? তার যথাযথ উত্তর অনেক সময়ই আমরা পাই না এবং খুঁজেও দেখি না। এই ইতিহাস অবশ্যই পাঠ্য হওয়া উচিত। মহাকবি আলাওল, দৌলত কাজী, কোরেশি, মাগন ঠাকুর, আশরাফ খান, নসরুল্লাহ খান - এরা সবাই ছিলেন আরাকান রাজদরবারের কবি। আজকের যে বাংলা সাহিত্য তার অন্যতম ভিত্তি আরাকানেরই রাজসভা। আরাকানের রাজসভা স্মরণীয় হয়ে আছে বাংলা সাহিত্য চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। দীর্ঘকাল আরাকান রাজ্য পরিচালিত হয় মুসলিম ঐতিহ্য অনুসারে। প্রাচুর্যে ভরপুর ফুলে ফলে সুশোভিত দেশ হিসেবে বিবেচিত হাজার বছরের স্বাধীন আরাকান রাজ্যের অনেক রাজা ও অমাত্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তাদের উদার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। বাংলা সাহিত্য তাই ঋণী আরাকানের রাজসভার কাছে।

পদ্মাবতী, চন্দ্রাবতী, সতী ময়না লোর চন্দ্রানী, হপ্ত পয়কর, সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামান, শরিয়তনামা, দারা সেকেন্দারনামার মতো অনেক কালজয়ী কাব্য, মহাকাব্য রচিত হয়েছে আরাকানে। এসব কাব্যে উঠে এসেছে আরাকান রাজ্যের অনেক অজানা ইতিহাস মুসলমানদের গৌরবময় অধ্যায়। আরাকান এক সময় রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য নামেও পরিচিত ছিল। তখনকার অনেক কবি-সাহিত্যিকেরা আরাকানকে রোসাঙ্গ রাজ বলে অভিহিত করেছেন। সেই উতিহাসের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে: (ক) ১০৪৪ সালে বার্মার প্যাগান রাজা অন্যারাথার আরাকান আক্রমণ। অন্যারাথা প্যাগান সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা। (খ) ১৪০৬ সালে আভা রাজা মিন খং-এর আরাকান আক্রমণ এবং দখল। এই সময় আরাকান রাজা ছিলেন নরমিখলা। তিনি ২৪ বছর পর বাংলার মুসলিম সেনাবাহিনীর সাহায্যে আরাকানকে মগ মুক্ত করেন। (গ) ১৪৩০ সনে রাজা নরমিখলা মুসলিম সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আরাকান স্বাধীন করেন এবং আরাকানে মারাউকি সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজত্ব ৩৫৫ বছর বলবৎ ছিল। (ঘ) ১৫৪৫ সালে টংগগু রাজা তা বিন সাথী আরাকান আক্রমণ করেন। তার সেনাবাহিনীকে আরাকান রাজা জেবুক শাহ অর্থাৎ মিন বিন পরাজিত করেন। এতে আরাকানের মারাউকি আমলের স্বাধীনতা রক্ষা পায়। (ঙ) ১৬৬০ সালে স¤্রাট শাহজাহান পুত্র মোহাম্মদ শাহ সুজা ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে ভাই আওরঙ্গজেবের কাছে হেরে আরাকানে পালিয়ে যান। সপরিবারে তিনি আরাকান হয়ে মক্কা যাবার পরিকল্পনা করেন। ১৬৬১ সালে আরাকান রাজা চন্দ্র সুধর্মা শাহ সুজার অপরূপা সুন্দরী কন্যা আমেনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং যৌতুক হিসাবে শাহ সুজার ধনরতœ দাবি করেন। শাহ সুজা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তিনি ষড়যন্ত্র করে পরিবারসহ তাকে হত্যা করেন এবং রাজকবি দিয়ে মিথ্যা কাহিনী রচনা করেন। এই ঘটনাটি আরাকানের মুসলিমদের মাঝে গভীর রেখাপাত করে। রাজার প্রতি বিশ্বাস ও অখন্ড আনুগত্যে ভাঙ্গন ধরায়। এ বিষয়টি মগদেও আবারো আরাকান আক্রমণে উৎসাহিত করে। (চ) ১৭৮৪ সালে বার্মার কন বায়ুঙ্গ রাজা আরাকান আক্রমণ করেন এবং বোধা পায়ার ৪২ বছরের মগ শাসনের অভুদ্যয় ঘটে। আরাকান রাজা থান বি ঘা বাংলাদেশ পালিয়ে যান এবং ১৮০৬ সালে মৃত্যুও আগে পর্যন্ত চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার থেকে আরাকান থেকে পালিয়ে আসা অনুচর এবং রোহিঙ্গাদেও নিয়ে স্বাধীনতা উদ্ধারে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যান। (ছ) ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ আরাকান দখল করে নেয়। এতে আরাকান উদ্ধারের গেরিলা যুদ্ধ তিরোহিত হয়। (জে) ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ইংরেজরা বার্মা ছেড়ে চলে যায়। যাবার সময় আরাকানকে তার পুরনো প্রভুর হাতে তুলে দেয়। যাবার সময় ব্রিটিশরা আরাকানকে বার্মার সঙ্গে যুক্ত কওে দেয়। সব বিচারে স্বাধীন আরাকানরই হত সুবিচার। কেননা যুক্তই করাই একমাত্র উপায়ান্তর হলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিচারে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করাই ছিল সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। ব্রিটিশের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসিতে পশ্চিমে কাশ্মীর এবং পূর্বে আরাকানই হচ্ছে ভাগ্যের লিখন। আর একই উদ্দেশ্য ও একই পন্থায় ব্রিটিশ শেষ মুগল স¤্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে বার্মার রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠায়। স¤্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন একজন উঁচুমানের সুফী এবং উর্দু কবি। বার্মার রেঙ্গুনে আজও তার মাজার রয়েছে। আর বার্মার শেষ কনবাউং রাজা থিব মিন-কে ইংরেজরা ভারতের রতœাগিরিতে নির্বাসনে পাঠায়। আজ ভারতের কোথাও থিব মিন-এর কোন স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত নেই।
ফলশ্রæতিতে সৌন্দর্য মন্ডিত ও প্রাচুর্যে ভরপুর আরাকান রাজ্যটি মগ, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, বাংলার সুলতান, মোগল স¤্রাাট এবং ব্রিটিশ- এদের সকলের কাছেই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আজকের কক্সবাজার আউটপোস্ট থেকে আরাকানের উপর নজর রাখা হত। পালন কি গ্রামটিই ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স-এর নামানুসারে কক্সবাজার নামকরণ করা হয়েছে। কক্স-এর আগে ওয়ারেন হ্যাস্টিং সেখানকার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি পওে ভারতের গর্ভনর জেনারেল হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও সময় কক্সবাজার অঞ্চলে আয়ুব খান ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন। কক্সবাজার হয়েই তিনি বার্মায় যুদ্ধে যোগ দেন। পওে আয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন।

তবে ব্রিটিশ শাসনামলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের ঝুঁকি কমাতে ব্রিটিশ ধারার রাজনৈতিক কালচার সব উপনিবেশেই ধীরে ধীওে চালু করে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠি। সেজন্য তারা একটি নির্দিষ্ট ছক ধরে অগ্রসর হয়। সা¤্রাজ্যবাদী ইংরেজরাই সব চাইতে সফলভাবে এবং তুলনামূলক শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের অঙ্কিত এক্সিট রুট দিয়ে চলে যেতে পেরেছে। বার্মার মগ সংস্কৃতিতে গণতন্ত্রের অনুপ্রবেশও ব্রিটিশদের মাধ্যমেই সম্ভবপর হয়েছে। ১৯২০ সালে রেঙ্গুন কলেজটি রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি দিয়েই বার্মায় পাশ্চাত্য ধারার রাজনীতির হাতে খড়ি। রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন এবং অল বার্মা স্টুডেন্ট ইউনিয়নই প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে। সময়ের ব্যবধানে অন্যান্য সব প্রতিবাদেও মুখপত্র হয়ে দাঁড়ায় সেখনকার ছাত্র আন্দোলন। বার্মার স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব এই ছাত্র আন্দোলন থেকেই স্ফূরিত। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারিতে পাওয়া স্বাধীনতার নেপথ্যে ছাত্র আন্দোলনেরই সবিশেষ ভূমিকা ছিল। সেটির পটভূমিতে ১৯৩১ সালে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন উ নূ, জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন আব্দুর রশিদ, ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন অং সান। ১৯৩৫-৩৭ সালে অল বার্মা স্টুডেন্ট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন উ রাশিদ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন অং সান। জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন উ থি হ্যান। ১৯৩৬ এর নির্বাচনে বা মও কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। বা মও ১৯৪১-এ জাপানের ইঙ্গিতে তিনি প্রভিশনাল সরকার গঠন করেন। বা মও ছিলেন একজন জাতীয়তবাদী স্বপ্নদ্রষ্টা নেতা। তিনি সব সময় মানুষকে স্বপ্ন দেখাতেন; বলতেন, ত্রিশ বছর পর উন্নত হবে গাড়ি-বাড়ি এবং সব পরিবারে ফ্রিজ থাকবে, সেটাই বলতেন। সেই বিবেচনায় অং সান ছিলেন একজন বাস্তববাদী নেতা; কথার চেয়ে কাজকে গুরুত্ব দিতেন। এতে একজন দূরদর্শী নেতা হিসাবেই তিনি বার্মাকে স্বাধীনতার পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হন।

১৯৪৭-এ অং সানের দল হাউজে মেজরিটি পায়। সে সময়ই অং সানকে বিরোধী পক্ষ ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে, তার কেবিনেটের অনেকেই তার সঙ্গে নিহত হয়। তার কেবিনেটের মিনিস্টার আব্দুর রাজ্জাকও এই ঘটনায় মারা যান। অং সানের মৃত্যুর পর ১৯৫৮ পর্যন্ত উ নূ দেশ পরিচালনা করেন। উ নূ-র কেবিনেটে আব্দুর রশিদ সব সময়ই মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬০ সালে মিলিটারি সরকারের প্রধান হন জেনারেল নে উইন। নে উইন ১৯৮৮ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৯০-এর নির্বাচনে অং সানের কন্যা অং সান সুচি’র নেতৃত্বাধীন এনএলডি বা ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি জয়ী হয়, কিšতু ক্ষমতা পায়নি, বরং গৃহবন্দি হন। পরে ২০১৬ সালে এনএলডি’র ভূমিধস বিজয়ের পর বার্মার স্টেট কাউন্সিলর হিসোবে সরকার প্রধান হন। বার্মায় ১৯৬০ পর্যন্ত মুসলিম রোহিঙ্গারা নাগরিক অধিকার কিছুটা হলেও পেয়েছে। এরপর নে উইনের ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত, এমনকী ২০১৭ সালে সু চির ক্ষমতাকালে শুধু বঞ্চনা নয় বরং জঘণ্যতম ‘জাতিগত নিধনের’ শিকারে পর্যবসিত হয়।
অথচ বার্মার স্বাধীনতার মূলভিত্তিটি ছিল পালং চুক্তি। এই চুক্তির মূল কারিগর ছিলেন পে খিন, একজন মুসলিম। আর বার্মার শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি ১৯ জুলাই, ১৯৪৭ কেবিনেট মিটিং চলাকালীন বিরোধী পক্ষের ব্রাশফায়াওে অং সানসহ মারা যান। বার্মার বিখ্যাত শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবি কো নি-কে বিদেশ থেকে ফিরবার পর প্রকাশ্যে এয়ারপোর্টে ২৯ জানুয়ারি, ২০১৭ গুলি কওে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনেই বিজয়ী হয়ে বার্মার মুসলমানেরা পার্লামেন্ট হাউজে বসেছে। তার পরও বলা হচ্ছে রোহিঙ্গারা আরাকানের নাগরিক নয়। ইংরেজ আমলে রাজ কর্মচারি এবং ব্যবসায়ী ভারতীয়রা ছিল রাজধানী রেঙ্গুনের জনবসতির ৫৫%। তারা ১৯৪৮ সালে ইংরেজ শাসনের অবসানের পর ভারতে ফিরে আসেন, তাদের সঙ্গে লাখে রোহিঙ্গার তুলনা করা চলেনা। ভারতীয়রা ছিল ইংরেজের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠি। রোহিঙ্গারা ছিল ‘ভূমিপুত্র’ এবং বঞ্চিত জনগোষ্ঠি। অথচ ইংরেজের মুসলিম বিদ্বেষ রোহিঙ্গাদের উপরও সমানভাবে প্রযোজ্য ও প্রয়োগ হয়েছে।

সেই প্রেক্ষাপটে আরাকানে রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতার বিষয়টি একটি প্রশ্নবোধকচিহ্নও বটে! কেননা মগদের হাতে স্বাধীন আরাকান পরাধীন হবার পর থেকেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশ এবং পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা মুসলিমরা অব্যাহত নির্যাতন ও নিষ্পেষণের শিকার। অপরাজনীতির দাবার চালে সেই পুরানো ছকে অত্যাচারী সব সময়ই নিপীড়িতের উপর মিথ্যা দোষারোপ করে নিজের অপকর্মকে ঢেকে রেখে চলেছে। গৎ বাঁধা বদনাম- সন্ত্রাসী, জঙ্গি, বিছিন্নতাবাদী এবং বিদেশি চর হিসেবে তাদের আখ্যায়িত করা হচ্ছে। আজ মিথ্যা অভিযোগে অধিকারকামী রোহিঙ্গা জাতিসত্তাকে অস্বীকার করে নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নিয়ে বিশ্বের সামনে উপহাসে পরিণত করা হয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ভারতের নিষ্ক্রিয়তায় বার্মা সারা বিশ্বকে উপক্ষো করছে। তারা নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে অন্ধ হয়েছে এবং সত্যকে অস্বীকার কওে লাখো মানুষের ভাগ্যকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। এক্ষেত্রে ভারত এবং বার্মা বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী। দেখা যাচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারতে এক শ্রেনির উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যেমন গো-রক্ষার নামে মুসলিম হত্যার লাইসেন্স খুঁজে পেয়েছে, তেমনি সমাজতান্ত্রিক বৌদ্ধ বার্মায় ছাগল কুরবানীতেও জীব হত্যা মহাপাপ বলে এক শ্রেনির উগ্র বৌদ্ধ মুসলিম হত্যার লাইসেন্স খুঁজে পেয়েছে। চীন বিষয়টি বার্মার অভ্যন্তরীণ বিষয় বলছে, যা আগেও বলেছে। এখন জাতিসংঘে প্রয়োজনে বার্মার পক্ষে শুধু ভোট নয়, ভেটোও দেবে এ আশ্বাস সে দিয়ে রেখেছে। চীনের আছে বার্মার উপর সমর ও অর্থনীতির প্রভাব। তাতে রোহিঙ্গা সংকটে চীন ও রাশিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করেও নিরাপত্তা পরিষদে বিবৃতি দিতে রাজি হয়নি। ভারতে উগ্রবাদীরা ক্ষমতায় থাকায় তারাও হিন্দু মৌলবাদী জাতীয়তাবাদকে উসকে দিতে চাইছে। ফলশ্রæতিতে সুচি ও মোদি যৌথ ঘোষণায় বলেছেন, তারা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় একমত। তার মাধ্যমে কার্যত ভারত সুচির বর্ণবাদী গণহত্যার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ভারত রোহিঙ্গাদের জঙ্গি ও তার নিরাপত্তার হুমকি বলে দিয়েছে এবং একই সঙ্গে তার অবস্থানটা ভূরাজনীতি ও অর্থনৈতিক স্বার্থে একসূত্রে গাঁথা পরিষ্কার করেছে। বার্মা ওই ইঙ্গিতটা ভালই বোঝে। এটা দূরদর্শী চাল। কারণ, বাংলাদেশকে তার ইচ্ছার অধীনে রাখাই কৌশল।

রোহিঙ্গা ইতিহাস পাঠে আমরা জেনেছি, ওরা কে এবং তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কটা কী? আরাকানের সুদীর্ঘ ৫-৬ শত বছরের ইতিহাসে রোহিঙ্গারা অনাবাদি জমিকে আবাদি করেছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের ভাষা, ধর্ম ও চেহারায় সাদৃশ্যতার ইতিহাসটি পরিস্ফূট হয়েছে। তাতে আমরা কী সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কখনও অস্বীকার করতে পারব? অথচ তাদের পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ ও বর্হিবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে শেষটায় বিতাড়িত করা হচ্ছে। তাদের চাই সাহস, শক্তি ও শিক্ষা ফিরিয়ে দেওয়া।

আজ রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্পে আমরা যাদের দেখছি, তাদের মতো ১৭৮৪-এর কন বায়ুঙ্গ রাজা বোধা পায়ার সেনাদের আরাকান দখলকালে দুঃশাসন, হত্যা ও নির্যাতনে মারমা, মোরো, চাকমা এবং লাখো আরাকানি মাহায়ানা বৌদ্ধ বাংলাদেশে চলে এসেছে। মারমা এবং চাকমারা তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে বসতি গড়েছে। পূর্বে তারা অন্যারাথার আমলে আরাকান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম এসে বসতি গড়ে, এরা মূলত লাওস, থাইল্যান্ড ও বার্মার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি মন ও সান-দের দূরের আত্মীয়। তখন ১৭৯৯/১৮০০ সালের মাঝে শুধুমাত্র কক্সবাজারেই এক লাখের উপর রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। অন্যারাথা, বোধা পায়া, ইংরেজ এবং আজকের সুচি’র আমলের রিফিউজি রোহিঙ্গা মায়ের অসহায়, দুঃখি ও করুণ চেহারায় চার চারটি বর্বরতা ও নির্যাতনের ছাপ প্রতিভাত। যেমন- আভা রাজা মিন খং-এর ২৪ বছরের আরাকানে অরাজকতার দখলি শাসন, ১৭৮৪ সালে কনবাউঙ রাজা বোধা পায়ার ৪২ বছর দুঃশাসনের অন্ধকার যুগ, ১৮২৬ সাল থেকে ১২২ বছরের ইংরেজ ডিভাইড অ্যান্ড রুলের সুবিধাবাদী, স্বার্থান্বেষী শোষণের যুগ এবং সবশেষে ১৯৪৮ সাল থেকে বর্তমান মিয়ানমারে সুচিদের বর্বরতার যুগ।

অথচ সিঙ্গাপুরে মালয়, মালয়েশিয়াতে চীনা, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতকায় এবং মরিশাসে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা নাগরিক হয়ে সব অধিকার নিয়ে সন্মানের সাথে বসবাস করতে পারলে একই সূত্রে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রোহিঙ্গারা কেন বার্মায় সব অধিকার বঞ্ছিত হবে? ভারত, চীন আমাদের দুই প্রতিবেশী দেশ, তাতে রোহিঙ্গা বিষয়ে তাদের স্বার্থ এবং নীতির সঙ্গে আমাদের স্বার্থ ও নীতির মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সে কারণে চীনের বড় অর্থনীতি আর ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব যেন আমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে না পারে। ভুল হিসাব কষে ধরা খেলে, আমাদেরই প্রচন্ড ক্ষতির সম্ভাবণা বেশি। তাদেও প্রচারের সব সুর ও তালে যেন আমরা তাল না দেই। মোদ্দা কথা, ভারতসহ চীন ও রাশিয়া নিজ স্বার্থেই রোহিঙ্গা প্রশ্নে নিজেদেও নীতি নির্ধারণ করছে, যা আমাদেও স্বার্থেও পরিপন্থী। বাংলাদেশকে তার নিজ স্বার্থেই রোহিঙ্গা সংকটে নীতি নির্ধারণ করতে হবে। সে জন্য রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিত জাতীয় ঐক্যভিত্তিক প্রজ্ঞাশীল নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।
লেখক পরিচিতি: সংগঠক ও গবেষক এবং কানাডার টরন্টোয় আয়োজিত উত্তর আমেরিকা বাংলাদেশ সম্মেলন ২০০০ ফোবানা’র আহবায়ক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়