অ্যাড. তৈমূর আলম খন্দকার : সভ্যতার ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক বিশ্বের নাগরিকও বটে। কারও আন্তর্জাতিক অধিকার ক্ষুণœ না হওয়ার জন্যই ১৯৪৫ সনে ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের জন্ম হয়। তবে যেহেতু আমেরিকা, গ্রেটবৃটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স ও চীনের যেকোনো সিদ্ধান্তে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে সেহেতু জাতিসংঘ বর্তমানে উক্ত ৫টি বৃহৎ শক্তির সেবা দাসে পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) ও ভারত রোহিঙ্গাদের ওপর বরাবর অত্যাচারকে তারা সমর্থন দিচ্ছে। অথচ সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি প্রদেশের মধ্যে ৬টিই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। ভারত ও চীনের উল্লেখযোগ্য মুসলমান রয়েছে। তারপরও এ তিনটি রাষ্ট্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে খর্গহস্ত।
রোহিঙ্গারা অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়, যা তাদের জন্মগত অধিকার। অধিকার অর্জনের জন্য পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেই বীর বাঙালি স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। ভারতে সব সময় আগ্রাসী ভূমিকা থাকলেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তাদের ভূমিকা ছিল আমাদের জন্য সহায়ক। পাকিস্তানকে দ্বি-খ-িত করাই ছিল ভারতে স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ছিল অধিকার আদায়ের ও বাঁচা-মরার লড়াই। দুই স্বার্থ যখন এক হয়েছে তখনই ভারত আমাদের মানবিক সাহায্যের পাশাপাশি সামরিক সাহায্য দিয়েছে। সামরিক সাহায্য না পাওয়া গেলে এত তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন হতো কি না সন্দেহ (!) ধর্মীয় কারণে রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল সে সৌদি আরব, এখন ত্রাণ দিয়েই খালাস। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুসলমানদের আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব না নিয়ে সৌদি সরকার নিজেই বিশ্ব দরবারে তাদের গুরুত্ব হারাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইসলামিক কাউন্সিল একটি মাজাভাঙ্গা সংগঠনের পরিচয় দিচ্ছে। যার ফলে রোহিঙ্গাদের সমস্যা বিশ্ব দরবারে প্রকট আকার এখনো ধারণ করেনি। জাতিসংঘ যদি ঠুটো জগন্নাথ না হতো তবে ‘শান্তি বাহিনী’ পাঠিয়ে মিয়ানমার বর্বর মিলিটারিকে শায়েস্তা করা উচিত ছিল। মুসলমান হওয়ায় রোহিঙ্গারা আন্তর্জাতিক বিশ্বে আজ অভিভাবকহীন যা মেনে নেওয়া হৃদয় বিদারক।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার বিষয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালচির এ প্রশ্নের জবাবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘জীবন সময় বিপদে পরিপূর্ণ এবং আমি মনে করি না যে কারও বিপদ এড়ানো সম্ভব। যা সঠিক মনে হয় একজনের তাই করা উচিত এবং সেই যথার্থ কাজ করতে যদি বিপদ আসে তাহলে বিপদের ঝুঁকি অবশ্যই নিতে হবে। আমি পরিণতির কথা ভেবে কোনো পদক্ষেপ নেই না।’
রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে যদি সাহায্য করতে হয় তবে সামরিক সাহায্যই হবে তাদের জন্য উত্তম সাহায্য যা একটি স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করবে।
স্থানীয়ভাবেই রোহিঙ্গা নেতৃত্ব গড়ে উঠেনি, যেমনটি রয়েছে কাশ্মীর বা অন্যান্য দেশে যারা নিজেদের জাতিগত দাবি আদায়ে বিশ্ব নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইন্দিরা গান্ধী সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যেমন সরকার গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে সে ধরনের সঙ্গতি রোহিঙ্গাদের নেই। মিয়ানমারে যা বর্তমানে চলছে তা সম্পূর্ণভাবে গণহত্যা। গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চাওয়ার পরিবর্তে নাগরিকত্ব নিয়ে দেশে ফিরে তারা নিরাপত্তার সহিত বসবাস করতে চায়। যেহেতু বিষয়টি জাতিগত সমস্যা এবং বৌদ্ধরা রাষ্ট্রীয় সমর্থনে যখন নির্বিচারে মানুষের রক্ত ও নারী দেহের স্বাদ পেয়েছে, তা থেকে বৌদ্ধদের ফিরে আসার কোনো সম্ভবনা নেই, আইনগত শক্ত প্রোটেকশন ছাড়া। এ দায়িত্ব কেবল মাত্র বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এ জন্য চাই আন্তর্জাতিক বল প্রয়োগ। বৌদ্ধরা মুসলমানদের ওপরে নির্যাতন করায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। অথচ মুসলমানরা যদি বৌদ্ধদের উপরে এ ধরনের পাশবিক অত্যাচার করত তবে আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো ইহুদী, খ্রস্টানদের বোমারু বিমান এতদিনে চলে আসত। গোটা বিশ্ব আজ মুসলমানদের বিরুদ্ধে যা মুসলিম নেতৃত্বের বোধদয় হচ্ছে না।
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা