ভূঁইয়া আশিক রহমান: [২] বাংলাদেশের এক নম্বর আয়রনম্যান শামসুজ্জামান আরাফাত বলেছেন, আয়রনম্যান রেস জয়ের পরও এতো রিলিফ লাগে না, যতোটা রিলিফ লাগছে আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে যাওয়ার এনওসি পেয়ে। আমি ট্রেনিং করি, ঘাম ঝরাই, পরিশ্রম করি, হার্টবিট বাড়ে, কষ্ট হয়। কিন্তু এটা আমি ভালোবেসেই করি।
[৩] আগামী ২৬ আগস্ট আয়রনম্যান ৭০.৩ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ফিনল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে। এই প্রতিযোগিতায় একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে সরাসরি কোয়ালিফাই করেছেন এবং আয়রনম্যান বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ফ্রান্স ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। তারপর ২৪ সেপ্টেম্বর বার্লিন ম্যারাথন এবং সর্বশেষ আয়রনম্যান মালয়েশিয়া ৭ অক্টোবর। আমাদের সময় ডটকমকে এই আয়রনম্যান বলেন, এনওসি নিয়ে কয়েকদিন যে দুঃশ্চিন্তায় কেটেছিলো, তা আমাকে একদম থামিয়ে দিয়েছিলো। যে কারণে গত দেড় মাস আমি কোনো ট্রেনিং করতে পারিনি। অলমোস্ট আমার স্পোর্টস থেমে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিলো। এমন পরিস্থিতিতে স্পোর্টস কন্টিনিউ করার একটা স্কোপ তৈরি হয়েছে, কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
[৪] এর আগেও আমি এনওসি পেয়েছি। আমি কখনো আমার প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সহযোগিতা চাইনি। আমি শুধু চেয়েছি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের অনুমতি। আমি খুব লাকি বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সাল থেকে আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়ে আসছে। কিন্তু এবার কেন এমনটি হলো, আমি জানি না।
[৫] তিনি বলেন, আয়রনম্যান আমি অপেশাদার স্পোর্টস হিসেবে করি। আমি শুরু করেছি খুব বেশি সময় হয়নি। এটা হয়তো অনেকের বুঝতে সমস্যা হয়েছে। নতুন কেউ শুনলে বুঝতে একটু সময় প্রয়োজন হয়, তাৎক্ষণিক তিনি হয়তো রিলেট করতে পারেন না। আমি ও বুঝাতে পারিনি। বেশ কয়েকজন সহকর্মী চেষ্টা করেছিলেন যেন আমার এনওসিটা হয়। তারা খুব খুশি হয়েছেন। অন্য সহকর্মীরাও স্বাগত জানিয়েছেন।
[৬] শামছুজ্জামান আরাফাত বলেন, আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের জন্য রোববার ভিসার আবেদন জমা দেবো। এনওসি পাওয়ার পর কিছু কাজ থাকে। ফরেন মিনিস্ট্র থেকে একটা নোট নিয়েছি। ইন্সুরেন্স করেছি। কিছু ডকুমেন্টেসের নোটারি করতে হয়, তা করে রেডি করে রেখেছি। ব্যাংক স্টেটমেন্ট নেবো। বৃহস্পতিবারের মধ্যেই সব কাগজপত্র রেডি হয়ে যাবে আশা করি। চেষ্টা করছি ইমার্জেন্সি একটা এপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার। আশা করি এপয়েন্টমেন্টটা পেয়ে যাবো।
[৭] মাননীয় ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল দায়িত্ব নিয়ে আমার এনওসিটা করে দিয়েছেন। এনওসি নিয়ে প্রবলেমে পরার পর তিনি মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারি করেন। তবুও হয়নি। তখন তিনি সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে কথা বলে নিশ্চিত করেন আমার এনওসি প্রাপ্তি। বলা যায় ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী খুব আন্তরিকভাবে লড়ে গেছেন আমার এনওসির জন্য। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকে পুরো ব্যাপারটা অবহিত করেছেন ডা. জাহাঙ্গীর কবির। সাংবাদিক-কলামিস্ট শরিফুল হাসান ভাইও একটা লেখা লিখেছেন, যা বহু মানুষ পড়েছেন। তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এটা পৌঁছেছে। সাংবাদিক ভাইয়েরা বিপুল সহযোগিতা করেছেন। সবার নাম হয়তো মেনশন করা কঠিন। তবে দেশবাসী আমাকে দোয়া করেছেন। আমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে যেতে চেয়েছি। এটা সম্ভব করেছেন সবাই সাপোর্ট দিয়ে। সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।
[৮] আপনার প্রস্তুতি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহে বলতে পারবো, আমি কোন অবস্থায় আছি। তবে আমি আশাবাদী ভালো করার ব্যাপারে। বিশ্ব আয়রম্যান চ্যাম্পিয়নশিপে আমি আমার বেস্ট রেজাল্ট করতে পারবো বলেই বিশ্বাস। আমি আমার সেরা টাইমিংটা হয়তো করতে পারবো। এ ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী।
[৯] আমি চাই আমাদের স্পোর্টস কালচারটা লাইফস্টাইল হোক। এভরিওয়ান ক্যান ডু ইট। আপনার বাচ্চাও এটা করতে পারবে। আমার বাচ্চাও এটা করবে। আমাকে প্রফেশনালি করতে হবে, ব্যাপারটা তা নয়। ঘরে ঘরে যখন ভালো মানের স্পোর্টসম্যান থাকবে, ন্যাশনালি ও ইন্টারন্যাশনালি আমরা ভালো করবো। আয়রনম্যান স্পোর্টস যাতে যে কেউ করতে পারে, এ নিয়ে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে।
[১০] আমি মোটেও খেলাধুলার সঙ্গে ছিলাম না। এখন যে স্টেজে আছি, গত দুই বছর আগেও তা চিন্তা করতে পারতাম না। মনে হয়েছিলো, এখনকার অবস্থানে আসতে আরও ১০-১৫ বছর লাগবে। আমরা আসলে জানিও না কে কী করতে পারি। আয়রনম্যান প্রথমে হবি হিসেবে নেওয়া যেতে পারে, তারপর পেশা হিসেবে নেওয়ার চিন্তা করা যাবে।
[১১] আয়রনম্যান হতে হলে একজন মানুষকে ১৭ ঘণ্টার মধ্যে ৩.৮ কিমি সাঁতার, ১৮০ কিমি সাইক্লিং, ৪২.২ কিমি দৌড় শেষ করতে হয়। শুরুটা হয় সাঁতারের মধ্যদিয়ে। সাঁতার শেষ করে ডাঙায় উঠার সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যেক প্রতিযোগীকে সাইকেল চালাতে হয় ১৮০ কিলোমিটার। সর্বশেষ ধাপে দৌড়াতে হয় একটি ফুল ম্যারাথন (৪২ দশমিক ২ কিলোমিটার) দৌড়। সাঁতার, সাইক্লিং এবং ম্যারাথনের এ সম্পূর্ণ পথটি পাড়ি দিতে মোহাম্মদ শামছুজ্জামান আরাফাত সময় নিয়েছিলেন ১০ ঘণ্টা ৩১ মিনিট। এর মাধ্যমে তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম আয়রনম্যান বিশ্বচযাম্পিয়নশিপ ফিনিশারের স্বীকৃতি।
[১২] আরাফাত ২০১৭ সালে আয়রনম্যান মালয়েশিয়াতে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৯ সালে আয়রনম্যান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পয়নশিপ, জার্মানি এবং দ্বিতীয় বারের মতো আয়রনম্যান মালয়েশিয়া শেষ করেন। তিনবার আয়রনম্যান শেষ করে ২০২১ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট জর্জে অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান ৭০.৩ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন আরাফাত। যেখানে ১.৯৩ কিলোমিটার সাঁতার, ৯০ কিলোমিটার সাইক্লিং ও ২১.১ কিলোমিটার দৌড়ান। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করতে আরাফাত সময় নেন মাত্র ৫ ঘণ্টা ১৫ মিনিট ৪৩ সেকেন্ড, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক কম। পরপর আট বছরে নয়বার বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দেওয়া আরাফাত সামনের দিনে পাড়ি দিতে চান ইংলিশ চ্যানেল।
[১৩] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। আরাফাতের কর্মজীবন শুরু হয়েছিলো ২০১৬ সালে। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে চাকরির মাধ্যমে। ২০১৭ সালে ৩৫তম বিসিএসের নন-ক্যাডারে সমাজসেবা অধিদপ্তরে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।
[১৪] আয়রনম্যানের তালিকা অনুযায়ী বিশ্বে ৩০-৩৪ বছর বয়সী ট্রায়াথলেটদের মধ্যে আরাফাতের অবস্থান ১৩৬তম। বাংলাদেশে তার অবস্থান ১ নম্বরে। আরাফাতই প্রথম বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদ, যিনি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে স্বর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। গত বছর আয়রনম্যানের চারটি প্রতিযোগিতায় আরাফাতের অর্জন ১০,৯১১ পয়েন্ট।