এল আর বাদল: গত অগাস্ট পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অন্তর্কোন্দল দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে বিএনপির তৃণমূলে। সংঘাত- সহিংসতার অভিযোগে পত্রপত্রিকার শিরোনামে উঠে আসছে দলটির নেতাকর্মীদের নাম।
বিবদমান বিভিন্ন গ্রুপের সংঘর্ষে কেবল এপ্রিল মাসেই দলটির অন্তত সাতজন নেতাকর্মীর মৃত্যুর খবর এসেছে গণমাধ্যমে। আর শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে অর্থাৎ গত অগাস্ট থেকে হিসাব করলে এই সংখ্যাটা অর্ধশতাধিক।
সংঘাত সহিংসতার বিষয়টি স্বীকার করছেন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও। তাদের দাবি, ব্যবস্থা নেয়ার কারণেই সহিংসতার মাত্রা "স্তিমিত হয়ে এসেছে। -- সূত্র বিবিসি বাংলা
তবে বিএনপির পক্ষ থেকে সহিংসতার মাত্রা কমার দাবি করা হলেও পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দলটির স্থানীয় পর্যায়ের সহিংসতা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এগুলোর পেছনে অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং আধিপত্য সৃষ্টির মতো বিষয় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে।
একইসঙ্গে নির্বাচন এগিয়ে এলে এই ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে বলেও মনে করছেন তারা।
--- দলের জন্যে গেলাম, গুলি খেলাম, অথচ দলের কেউই সহায়তা করলো না ---
গত পাঁচই এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে মারা যান দলটির কর্মী লাভলু মিয়া। উপজেলায় আধিপত্য বিস্তার ও ব্যবসায়ীকে মারধরের প্রতিবাদে ডাকা মানববন্ধনের সময় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে মারা যান তিনি।
এই ঘটনায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও একশো থেকে দেড়শো জনের নামে মামলা দায়ের করেন নিহতের ছেলে মো. রায়হান কবির। তার দাবি, এরইমধ্যে টাকার জোরে আগাম জামিন নিয়েছে" অভিযুক্তরা।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, আমার বাবা বিএনপির একজন নিবেদিত কর্মী ছিলেন। জ্বালাও-পোড়াওসহ একাধিক মামলায় জেলে গেছেন। গুলিও খেয়েছি আমরা বাপ-ছেলে। অথচ আজ বিএনপির নেতারা নীরব।
এই যদি হয় রাজনীতি, তাহলে দেশের জনগণের কাছে অনুরোধ কেউ যেন রাজনীতি না করে। কারণ দলের জন্য গেলাম, গুলি খাইলাম, অথচ দলের কেউ এগিয়ে এসে সহায়তা করলো না।
অভিযুক্তদের আগাম জামিন পাওয়ার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মি. কবির, যদিও এই ঘটনার পর ছয় বিএনপি নেতাকে বহিষ্কার করে দলটি।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ না যেতেই গত ১১ই এপ্রিল গাজীপুরের ধীরাশ্রম এলাকায় কৃষকদল নেতা রাকিব মোল্লাকে নিজ বাড়ির খুব কাছেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তারের জেরে খুন হন তিনি।
পরিবারের অভিযোগ, খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিংবা দলটির ছত্রছায়ায় রয়েছে।
নিহত রাকিবের মা রুবিনা আক্তার সীমা বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিএনপির যে জায়গায় রাকিব পৌঁছাতে পারতো, বাকিরা সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না বলেই তাকে খুন করা হয়।
বিএনপির কিছু লোকজনও আছে, চায় না যে আমার মামলাটা হোক। এরা বলতাছে, বিএনপির লোক থাকলে মামলা হালকা হয়ে যাবে। তাইলে কি বিএনপির লোক অপরাধ করে না? দলের জন্যে কি তাইলে অপরাধ করলে মাফ?" বলেন তিনি।
--- বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আট মাসে ৫৮ জন নিহত --
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কেবল বিএনপির দলীয় কোন্দলেই মৃত্যু হয়েছে ২৬ জনের।
একই সংস্থার হিসাবে, গত অগাস্ট থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আট মাসে ৭৬ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে কেবল বিএনপির অভ্যন্তরীণ সহিংসতায় মারা গেছেন ৫৮ জন। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে অভ্যন্তরীণ বিবাদের বিষয়টি শিকার করে নেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "সংঘাত-সহিংসতা হচ্ছে না, সেটা আমরা বলবো না। কিন্তু দেখতে হবে এটাকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে কিনা। মোটেই তা হচ্ছে না।"
"জড়িতদের বহিষ্কার করা হয়েছে, পদ স্থগিত করা হয়েছে, শোকজ করা হচ্ছে এবং সেখানে জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলে – কেউ এখান থেকে বাদ যাচ্ছে না, বলেন তিনি।
এই ধরনের ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগ প্রমাণ-সাপেক্ষে জেলা বা থানা পর্যায়ের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি করা হয়েছে বলেও জানান এই বিএনপি নেতা। এভাবে তিন থেকে চার হাজার নেতাকর্মীকে ব্যবস্থার আওতায় আনার কথা জানান তিনি।
একইসঙ্গে বিষয়গুলোকে দীর্ঘসময় রাজনৈতিক কারণে হয়রানির শিকার হবার প্রতিক্রিয়া হিসেবেও মনে করেন মি. রিজভী।
"এত বড় রাজনৈতিক দল প্রায় ১৫-১৬ বছর রাজনৈতিক নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করেছে, এলাকা থেকে উচ্ছেদ করেছে, এত বছর পর ফিরে গেছে। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছে।"
"কিন্তু আমাদের এই ব্যবস্থাগুলো নেয়ার কারণে মাত্রাটা অনেক কম এবং ধীরে ধীরে অনেক কমে এসেছে। পাঁচ তারিখের পরের তুলনায় অনেকখানি স্তিমিত হয়ে এসেছে," বলেন তিনি।
-- নির্বাচন ঘনিয়ে এলে অভ্যন্তরীণ সংকট বাড়বে --
দীর্ঘ সময় ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা, নেতৃত্ব সংকটসহ কয়েকটি ফ্যাক্টর বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে বলে মত বিশ্লেষকদের।
আর নির্বাচন ঘনিয়ে এলে দলটির অভ্যন্তরীণ সংকট আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
এ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "১৭/১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি তো ক্ষমতাচর্চা অনেকটাই ভুলে গেছে বলা যায়। এদিকে আবার তাদের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা চেয়ারপারসন নিষ্ক্রিয়, আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন দেশছাড়া।
এই বিশ্লেষকের মতে, দলীয় বন্ধন টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখেন চেয়ারপারসন। গ্রেফতার হওয়ার আগে বেগম জিয়া যতদিন সক্রিয় ছিলেন, ততদিন দলের মধ্যে সমস্যা বোঝা যায়নি। কিন্তু তারপর থেকেই দলটি অনেক এলোমেলো হয়ে গেছে।
তাদের বাইরে যারা নেতৃত্বে আছেন তাদের মধ্যেও বনিবনার অভাব আছে বলে মনে করেন মি. আহমদ। বিশেষ করে বিভিন্ন ইস্যুতে আলাপে তাদের মধ্যকার মতপার্থক্যও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা থেকে বোঝা যায় দলের সংহতিতে টান পড়েছে। ফলে এর প্রভাব পড়বে নির্বাচনেও।
সামনে যদি নির্বাচন আসে, তখন এই নির্বাচন নিয়েও কিন্তু তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে চলে যাবে। কারণ প্রত্যেকেরই নিজস্ব বলয় আছে। অনুগত লোকেরা আছে। তারা সবাই প্রার্থী হতে চাইবে।
এমনিতেই তৃণমূলে নানা ধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। সিনিয়র নেতাদের প্রশ্রয়-আশ্রয় ছাড়া তৃণমূলে অরাজকতা যারা করে বেড়াচ্ছে, এটা তো সম্ভব না", বলেন এই বিশ্লেষক।
ফলে সামনের দিনগুলোতে ঝামেলা বাড়বে বলেই মনে করেন মি. আহমদ।