শিরোনাম

প্রকাশিত : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৯:৩৮ সকাল
আপডেট : ০৫ নভেম্বর, ২০২৫, ০৩:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অন্তর্বর্তী সরকারে আস্থাহীনতা, আমলাতন্ত্রে চাপা ক্ষোভ

‘ড. ইউনূস দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন।’ ‘পুরো উপদেষ্টা পরিষদে পরিবর্তন আনবেন ড. ইউনূস। উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে নানা কারণে তিনি এখন ত্যক্ত-বিরক্ত।’ ‘ছয় শর্ত মেনে নিলে পুরো কেবিনেট নিয়ে ডিসেম্বরেই চলে যাবেন ড. ইউনূস।’ ‘ড. ইউনূস চলে গেলে আসবে নতুন কেয়ারটেকার সরকার।’ ‘ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে না। হলেও তা হবে গণভোট।’ ‘সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু, জাকসু নির্বাচন সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছে।’ ‘অক্টোবরে দেশে আসবেন তারেক রহমান। তিনি এলেই দেশের বিদ্যমান চেহারায় আমূল পরিবর্তন ঘটবে।’

পাড়ার চায়ের দোকান, বাজার, অফিস আড্ডা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এ ধরনের আলোচনার যেন শেষ নেই। কিন্তু এগুলো কতটা সত্য? এমন প্রশ্নের জবাবে ‘সবই গুজব’ বলে উত্তর মিলেছে।

তবে শুধু সাধারণ মানুষের মাঝেই নয়, এ ধরনের নানান গুজব ঘুরপাক খাচ্ছে সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও।

নেই কোনও ভিত্তি, নেই কোনও সোর্স—তারপরও এ ধরনের বিষয় নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। আর এর প্রভাবে আমলাদের আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

সচিবালয় ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে যেখানে সর্বত্রই ড. ইউনূসের গুণকীর্তন হতো, সেখানে এখন সরকারের নানান কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় নেমেছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশ। ড. ইউনূসের সততা নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে প্রকাশ্যে। চলছে উপদেষ্টাদের নিয়েও প্রবল সমালোচনা।

উপদেষ্টাদের কাজের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এমনকি সততা নিয়ে এখন সমালোচনা হচ্ছে সচিবালয়ে। এছাড়া শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর যেসব আমলা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছেন তাদের নিয়েও চলছে প্রকাশ্যে সমালোচনা—যা দুই মাস আগেও ছিল বিরল।

সম্প্রতি জনপ্রশাসন সচিবকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় এই আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বলা হচ্ছে, এভাবেই হয়তো একদিন কেবিনেট সচিবকেও সরিয়ে দেওয়া হতে পারে! অথচ কয়েক মাস আগেও এসব কর্মকর্তার নামে সচিবালয়ে এক ধরনের বন্দনা চলতো।

জানা গেছে, ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে চাকরিতে ফিরে আসার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে সচিবালয়ে। এদের মধ্যে অনেকেই এসব সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নন। এদের কেউ কেউ অসৎ, কেউ সরকারকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করছেন—এমন নানা সমালোচনায় মুখর এখন সচিবালয়।

আবার একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করা আমলারা এখন ভিন্ন সুর ধরেছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। কিছু দিন আগেও যারা তারেক রহমানকে আগামী দিনে দেশের যোগ্য শাসক বলতেন, তারা এখন ‘সৎ লোকের শাসনের’ কথা বলে ভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। শুধু তাই নয়, আমলাদের অনেকেই এখন কোনও একটি রাজনৈতিক দলের একক সরকার নয়, সব মতের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের কথাও বলছেন।

আমলাদের খোলস বদলে অনেকেই অবাক হয়েছেন। কথিত আছে, দীর্ঘদিন বিরতি দিয়ে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে জামায়াতপন্থি কর্মচারীদের সংগঠন বিভিন্ন দাবিতে আবারও সোচ্চার হয়ে নানা ইস্যুতে আন্দোলন শুরু করেছেন।       

জানা গেছে, শুরুর দিকে তেমন সমস্যা না হলেও কিছু দিন পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের পুরো মেয়াদেই প্রশাসনের সর্বত্রই এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। স্তরে স্তরে রয়েছে সমন্বয়ের অভাব। নতুন পে-স্কেল, পদোন্নতি, ক্যাডার বৈষম্য, মহার্ঘ ভাতার দাবিসহ সচিবালয়ের কর্মচারীরা সোচ্চার রয়েছেন নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে। এর মধ্যেই চলছে বাধ্যতামূলক অবসর ও ওএসডি বানানোর কার্যক্রম।

নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করতে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ ট্যাগিং চলছে। একশ্রেণির সুবিধাবাদী কর্মকর্তা-কর্মচারী এসবের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে জানা গেছে। অপরের ললাটে ফ্যাসিবাদের তকমা লাগিয়ে নিজেকে সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে যাওয়ার এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। বর্তমানে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ উপস্থাপনের নীরব প্রতিযোগিতাও চলছে।

এসব নানা বিষয় নিয়ে প্রশাসনে সৃষ্টি হয়েছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা। এর ফলে সরকারি কাজকর্মে স্থবিরতা নেমে এসেছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বড় একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক আমলারা এসবের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বলেও গুঞ্জন রয়েছে ।

এদিকে আমলাতন্ত্রের কাছে অন্তর্বর্তী সরকার রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছে বলেও বিভিন্ন সময় গুঞ্জন উঠেছে। এমন প্রেক্ষাপটে আমলাদের এই আকস্মিক পরিবর্তন সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলেও মনে করেন অনেকে।

৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পরে ড. ইউনূস যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তার ওপর দেশের মানুষ গভীর আস্থার কথা বলেছেন। তখন অনেকেই বলেছেন, এই আস্থার মূল্য দিতে তাকে শক্ত হতে হবে। যেসব আমলা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতামূলক আচরণ করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তার উপদেষ্টা পরিষদকে আরও সক্রিয় ও গতিশীল হতে হবে। প্রয়োজনে কাউকে কাউকে বাদ দিতে হবে। দক্ষ-যোগ্য-অভিজ্ঞ নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করতে হবে। এখন তারাই আবার বলছেন, ড. ইউনূসের ওপর আর সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। তিনি দেশের মানুষকে নয়, নিজের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। তিনি এখন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বেশি সময় দিচ্ছেন। দ্রুত নির্বাচন দিয়ে তার সরে যাওয়া উচিত বলেও পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘ডিসি নিয়োগকে কেন্দ্র করে সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে হাতাহাতির ঘটনা আমার চাকরি জীবনে এর আগে কখনও দেখিনি। অথচ এই সরকারের আমলে আমরা সবাই তা দেখলাম। হাতাহাতিতে অংশ নেওয়া সেই মাস্তান ডিসিরাই এখন জেলা সামাল দিচ্ছেন। প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ, পদায়ন বদলি নিয়ে প্রকাশ্যে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের আলাপচারিতার রেকর্ড প্রকাশ হতে আগে শুনিনি। এই আমলে এসে শুনলাম।’’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব নাম গোপন রাখার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আসলে এই সরকার যে এতটা অথর্ব হবে, আমরা তা আগে ভাবিনি। হবেও না কেন? রাষ্ট্রের কঠিন সময়ে কঠিন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার পাশে থেকে বুদ্ধি পরামর্শ দেওয়ার মতো উপদেষ্টা পরিষদে কয়জন আছেন?’’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, ‘‘ক্ষমতা পাওয়ার আগেই যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করে, দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, চাঁদাবাজ দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে—তাদের দিয়ে দেশ কত ভালো চলবে, আর দেশের মানুষ কতটা নিরাপদ থাকবে, তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাই এদের দিয়ে হবে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় সৎ লোকের শাসন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।’’

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমলাদের কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক হওয়া ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, তারা জনগণের সেবক। জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন হয়। আর বর্তমান সরকারকে মনে রাখতে হবে, তারা দেশ গঠনের একটি সুযোগ পেয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকার চেষ্টা করতে হবে। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়