শরিফুল হাসান: ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। বাংলাদেশে মেয়েদের মেয়েদের লেখাপড়ার সবচেয়ে স্বনামধন্য এই বিদ্যালয়ে অন্তত ১২ হাজার ছাত্রী লেখাপড়া করে। এমন একটা স্কুলে পুরুষ শিক্ষকরা মাঝে মধ্যেই ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করবে, পরিচালনা পর্ষদের নেতা নাতির বয়সী ছাত্রীদের বিয়ে করবেন, নানা অনিয়ম দুর্নীতি চলবেÑ এগুলো কোনোভাবেই মানা যায় না। এর কোনোটাই সুস্থ পরিবেশ নয়। কিন্তু কেন বারবার হচ্ছে? নিশ্চয়ই সেখানে বড় ধরনের কোনো সমস্যা আছে। আচ্ছা, এই স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ কীভাবে হয়? সেখানে কোনো দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি আছে কি? আফসোস, স্কুল কর্তৃপক্ষ সবসময় তথাকথিত ভাবমূর্তির কথা বলে সবসময় এসব ঘটনা ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত থাকে। আর সারাক্ষণ জিপিএ-৫ এর আশায় থাকা অভিভাবকেরা মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টা সেভাবে ভাবেন বলে মনে হয় না। ফলে মেয়েরাও সাহস করে এসব নিপীড়নের কথা বলতে পারে না। ঘটনটা দেখেন। একজন পুরুষ শিক্ষক একযুগ ধরে ফ্ল্যাটে কোচিং সেন্টার খুলে ছাত্রী পড়াতেন এবং ছাত্রীদের নানাভাবে হয়রানি করতেন। বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চললেও ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পেত না। একটা ঘটনার সূত্র ধরে একটি সংবাদপত্র অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর এখন জানা যাচ্ছে, অসংখ্য মেয়ে এভাবে হয়রানি শিকার। এর মানে স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক সবাই ঘুমাচ্ছিলেন এতোদিন।
আচ্ছা, ভিকারুননিসা নুনের মতো নামী স্কুলের ছাত্রীদের ক্লাসের পর আবার কেন শিক্ষকদের ফ্ল্যাটে পড়তে যেতে হয়? আমি জানি না ক্লাসে কী ধরনের লেখাপড়া হয় যে শিক্ষকের বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়তে হয়। এই প্রাইভেট পড়ানো এদেশের শিক্ষা ধ্বংস হবার একটা বড় কারণ। শিক্ষকর এই প্রাইভেটের নামে পছন্দের ছেলেমেয়েদের বেশি নম্বর দেয়, একধরনের জিম্মি করে রাখে। এই জঘন্য ব্যবস্থা বাতিল হওয়া উচিত। কোনো শিক্ষক যদি প্রাইভেট পড়াতে চান তিনি স্কুলেই পড়াক। সবাই জানুক। সেটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাক। চোরের মতো বাসায় পড়াবে, আবার মেয়েদের হয়রানি করবেÑ এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। এর আগেও ওই স্কুলে ছাত্রী নিপীড়নের ভয়াবহ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে মামলা, জেল, অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু সমস্যার যে সমাধান হয়নি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। যেসব অভিভাবকের সন্তানেরা সেখানে পড়েন তাদের মানসিক অবস্থাটা ভাবেন। তারা যখন এমন নিপীড়নের কথা শোনেন, যখন দেখেন পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য নাতির বয়সী মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেন তখন তাদের কেমন লাগে? আপনারা হয়তো বলবেন এই বইয়ের সাথে নিপীড়নের কী সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে। কারণ পরিচালনা পর্ষদ বা অভিভাবক হিসেবে এ ধরনের সম্পর্কে জড়ানো ক্ষমতার অপব্যবহার। আর এসব ঘটনায় স্কুল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কিন্তু সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ। তারা ব্যস্ত ভর্তি আর নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মে। সব মিলিয়ে সুশাসনের ভয়াবহ ঘাটতি। আচ্ছা, এসব দেখে এই মেয়েরা বড় হয়ে কেমন মানুষ হবে? এর দায় কার?
আরেকটা বিষয়। একসময়ের নামকরা ভিকারুননিসায় অনিয়ম দুর্নীতিসহ গত দুই দশক ধরে কেন এতো সমস্যা চলছে তার গভীরে যাওয়া দরকার। দেখেন ১৯৮১ সালের জুন থেকে ২০০২ সালের জুলাই পর্যন্ত এখানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন শিক্ষাবিদ হামিদা আলী। তাঁর এ মেয়াদকালকেই অন্যতম সেরা সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বয়সের কারণে হামিদা আলীকে যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়, শিক্ষার্থী অভিভাবকরা তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সকল প্রতিবাদ ক্ষোভ উপেক্ষা করে হামিদা আলীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর নিয়ম করা হয়েছে অধ্যক্ষ হবেন বাই রোটেশন। সঙ্কট শুরু হয় তখন থেকেই। হামিদা আলীর অবসরে যাওয়ার পর থেকে নানা ধরনের অনিয়ম, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বাড়তে থাকে। গত দুই দশকে ১৭ জন অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে ১২ জনই ভারপ্রাপ্ত (একই ব্যক্তি একাধিকবারও দায়িত্ব পালন করেন)। দুজন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার থেকে এলেও দুজনই বিতর্ক মাথায় নিয়ে গেছেন। তাঁদের একজনের ‘বালিশের নিচে পিস্তল নিয়ে ঘুমানোর’ ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। স্কুলে তিনি গরুর হাট বসিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ আছে। অন্তত ৭২ জন শিক্ষককে তিনি অনিয়ম করে নিয়োগ দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানে এর আগেও এমন ঘটনা বারবার ঘটেছে।
শিক্ষক নিয়োগে এমন অনিয়ম হলে সেই শিক্ষকের কাছ থেকে মূল্যবোধ কী আশা করা যায়? মোটেও না। এছাড়া এই স্কুলের পরিচালনা পর্ষদ নিয়েও নানা অভিযোগ আছে। এই পর্ষদ রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হয়ে নানা ধরনের অনিয়মে জড়িত। সবমিলিয়ে সেখানে সুশাসনের যথেষ্ট ঘাটতি। এই সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া এই স্কুলের পরিবেশ ঠিক করা কঠিন। বিশেষ করে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটা প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রচলন ছাড়া খুব সহসা এই সমস্যার সমাধান দেখি না। আমি মনে করি এই স্কুলের মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য নিয়মিত তাদের কথা শোনা উচিত। এমন একটা পদ্ধতি প্রচলন করা উচিত যেখানে মেয়েরা কোন ধরনের হয়রানির শিকার হলে নাম প্রকাশ না করেও অভিযোগ দিতে পারবে। নিয়মিত মেয়েদের সঙ্গে এ নিয়ে শিক্ষকদের কথা বলতে হবে। সর্বোপরি সুশাসন ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আসলে সবাই মিলে সেখানে এমন একটা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে সেখানে সুশাসন আসে। আর কোনোদিন কখনো কেউ এই ধরনের ঘটনা না ঘটে। বিশেষ করে ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা বন্ধ করতে না পারলে স্কুলের সব শিক্ষকদের উচিত বাড়ি চলে যাওয়া। আর অভিভাবকদের কাছে অনুরোধ, শুধু জিপিএ-৫ না মেয়ের নিরাপত্তার কথাও ভাবুন। তাদের কথা শুনুন। মেয়েকে স্বাভাবিক পরিবেশে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে দেন। এই স্কুলের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। সর্বোপরি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করুন নিজের ঘরে এবং বাইরে সর্বত্র । লেখক: কলামিস্ট
আপনার মতামত লিখুন :