আফসান চৌধুরী: ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষা, রাজনীতি ও অর্থনীতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলো। শুধু বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলনই হয়নি, উর্দু ভাষাভাষিরাও হিন্দুওয়ালাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলো। হিন্দির বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন ভাষা আন্দোলন হয়েছে। এসবের একটা পটভূমি বা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। যারা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, তারা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান চাইছিলো। কিন্তু এটা হয়নি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্য। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার কথা ছিলো। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান না হয়ে যৌথ বাংলা হলো না। তখন রাজনীতির মধ্যে এসে যা হলো, বাংলা ভেঙে গেলো। ১৯৪৮ সালের মধ্যে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। যেটা হিন্দিওয়ালারা করেছিলো, এটাই উর্দুওয়ালা করেছেÑ সব জায়গা থেকে বাঙালিদের বাদ রাখা। কারণ প্রতিযোগী কমানো।
প্রথমে যারা উর্দু ভাষাভাষির মানুষ ছিলেন, তারা উত্তর প্রদেশের। উর্দুওয়ালা লিয়াকত আলী খানরা বাঙালি বিরোধী ছিলেন। কারণ বাঙালিরা চাকরি করতে যেতো। ভাষা আন্দোলনের ভিত্তি ছিলো চাকরির সীমাবদ্ধতা। বেশির ভাগ তথ্য সেটাই প্রমাণ করে। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে সিভিল সার্ভিসসহ বিভিন্ন চাকরিতে উর্দু জানতে হবে। উর্দু না জানলে চাকরি হবে না। হিন্দিওয়লারাও বহুবার চেষ্টা করেছিলো। সর্বভারতের বিভিন্ন জায়গায় ভাষা আন্দোলন হয়েছে। দক্ষিণ ভারত উত্তর ভারত থেকে অনেক আলাদা। হিন্দি বেল্ট থেকে তারা একরকম আলাদা হয়ে গেছে। তারা উন্নয়ন করে গেছে, হিন্দিুওয়ালারা অনুন্নত রয়ে গেছে। উত্তর ভারতীয়রাও বাংলাদেশিদের সঙ্গেও একই ব্যবহার করেছিলো।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্তরা তখন নিজেদের দুর্বল ভাবা শুরু করলো। তারা ভাবলো, এতোকিছু করলাম, কোথায়, আমাদের তো কোনো মূল্যায়ন নেই। কোথাও চাকরির সুযোগ নেই। নানান ভাবে বাধার দেয়াল তৈরি করে রাখা হয়েছিলো। চাকরি দেয় না বাঙালিদের। সমস্যা বাধলো এখানেই। ভাষা আন্দোলন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন। সবার আন্দোলন নয় এটা। শিক্ষিত শ্রেণিই ভাষা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৯৯ শতাংশ মানুষই সাধারণ। তাদের মধ্যে অনেকেই পড়ালেখা না জানা মানুষ। তাদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই।
ভাষা আন্দোলন হচ্ছে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির আন্দোলন। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই রাজনীতি করে। পড়ালেখা করে থাকে। ভাষা আন্দোলন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় বা বিশ^বিদ্যালয়কেন্দ্রিক আন্দোলন। এই এলিট শ্রেণির আন্দোলন তো সবার আন্দোলন হতে পারে না। সবার আন্দোলনের আলাদা ইতিহাস আছে। ১৯৭১ সালের আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণকারী ছিলো কৃষক সমাজ। সাধারণ মানুষ। তারা কিন্তু ভাষা আন্দোলন করেননি। আমরা যারা ইতিহাস নিয়ে পড়ালেখা করি, লিখি, গবেষণা করি, নিয়ন্ত্রণ করি ইতিহাসের ন্যারেটিভ, আমরা আদলটা নিই বাহান্ন থেকে। হিন্দু, না মুসলিম নাÑআমরা বাঙালি। ১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিলে পাকিস্তানি আর্মিরাও লুট করেছিলো গ্রামে গ্রামে। কেন? কারণ টিকে থাকার জন্য। তাদের কাছে খাবার ছিলো না। তারা তো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। মার্চ-এপ্রিলে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছিলো, সেই অভিজ্ঞতাই যুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে বেশি একত্রিত করেছিলো।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলে কোনো কিছু নেই। এটা পশ্চিমা ধারণা থেকে জাতিগতভাবে আমরা পালন করি। জাতিগত আন্দোলন করলে তো আমাদের ধরে নিতে হবে আমরা ভাষা বা সংস্কৃতির জন্য আন্দোলন করেছি। এটা তো ঠিক নয়। আমরা আসলে পেটের জন্য আন্দোলন করেছি। পৃথিবীর সকল আন্দোলন পেটের আন্দোলন। বাঙাল জাতীয়তাবাদ হতে পারে। কারণ বাঙাল যে অঞ্চলের মানুষ, যারা যে সংস্কৃতির, অর্থনীতির সেটা বাঙালদের ছিলো। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের ছিলো। শেখ সাহেব ও মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত একটি দল করেছেন। পরবর্তী সময়ে আবারও এক হয়েছিলেন। কিন্তু মাঝখানে একটা সময় ছিলেন না একসঙ্গে। তাঁদের আন্দোলনের ভিত্তি কিন্তু একাত্তর সালের সেই ধরনের মানুষগুলোই। গরিব, নিরন্ন, সংগ্রামী ও রুজি খোঁজা পূর্ববঙ্গের মানুষ। পরিচিতি : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সাংবাদিক
আপনার মতামত লিখুন :