গোলাম মোর্তোজা: বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাটা একধরনের ছেলেখেলায় পরিণত হয়ে গেলো। বিষয়টি এরকম যে নির্বাচনে একদল। তার কোনো প্রতিদ্বন্দী নেই। সেই দলটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে প্রতিদ্বন্দীতাহীনভাবে বিজয়ী হওয়া যাবে না। একজন ডামি ক্যান্ডিডেট রাখলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এখন ডামি ক্যান্ডিডেট রেখে কীরকম নির্বাচন হয় সেটা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কোনো কারণ নেই। এটা একটা দিক। আর এর বাইরে নির্বাচনটি কেমন নির্বাচন, কী নির্বাচনÑ এটা খুব চমৎকার করে বলেছেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি সাবেক নির্বাচন কমিশনারও। সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, এই নির্বাচন মানে হলো বিরোধী দল খোঁজার নির্বাচন। সরকারি দল যে ক্ষমতায় থাকবে, সেটা তো নির্ধারিত। মানে আওয়ামী লীগ। তাহলে বিরোধী দল কে? সেই বিরোধী দলটিই খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। কথা দেওয়া হয়েছে জাতীয় পার্টিকে। আবার স্বতন্ত্রও অনেকে আছে। তাই অনেকে বলার চেষ্টা করছে বিরোধী দল কারা জাতীয় পার্টি নাকি স্বতন্ত্র? আর আমার বিবেচনায় নির্বাচনটি সবচেয়ে হাস্যকর অবস্থা তৈরি হয় গত দুই তিনটি নির্বাচনে। দেখা গেছে যে বিরোধী দল যাদের বানানো হয়, অর্থাৎ জাতীয় পার্টিকে তাদের পোস্টারের দিকে তাকালে দেখা যায় লেখা আছে সরকার সমর্থিত জাতীয় পার্টি অনুমোদিত। অর্থাৎ সরকার সমর্থন করে আর জাতীয় পার্টি যাকে অনুমতি দিয়েছে। এরাই সরকার গঠন করবে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি হবে বিরোধী দল। সরকার ও বিরোধী দলের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার মজার নির্বাচন।
প্রার্থী জাতীয় পার্টির। জাতীয় পার্টি মনোনিত আওয়ামী লীগ সমর্থিত। জাতীয় পার্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দল। আবার আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, জাতীয় পার্টি বিরোধী দল। বিরোধী দলের সঙ্গে জাতীয় পার্টির এমন একটি সম্পর্ক যে সেই বিরোধী দল থেকে মনোনয়ন দিচ্ছে আর আওয়ামী লীগ সেটাকে সমর্থন করছে। পোস্টার করেছে নির্বাচন নিয়ে। তিনি আর কেউ নন, জাতীয় পার্টির মহাসচিব। তার মানে হলো বিরোধী দল খোঁজার যে নির্বাচনটি চলছে সেই নির্বাচনে মিলেমিশে জাতীয় পার্টিকে কিছু আসন যেহেতু দিতে হবে, জাতীয় পার্টির নিজের যেহেতু বিজয়ী হওয়ার সক্ষমতা নেই। জাতীয় পার্টির জন্য যেহেতু সরকার ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে এবং ১টি আসনেও তারা বিজয়ী হতে পারবে না যদি সরকার তাদের বিজয়ী করে না আনে। সে কারণে জাতীয় পার্টি চেষ্টা করছে ভোটারদের এটা বোঝাতে যে জাতীয় পার্টির লাঙল মনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত লাঙল। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ আমাদের বিরোধী দল বানাবে। সুতরাং আমাদের ভোট দিন।
আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল বানাবে। সুতরাং জাতীয় পার্টিকে ভোট দিন। এটা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বারবার চিন্তা করে, আলোচনা করে কয়টি আসন ছাড়া হবে এবং কয়টি আসনে তাদের বিজয়ী করে আনা হবে সেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়েছে। তার মানে হলো বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা ১৯৯১ সালের আগে যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে সে কয়টি নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। ৯১ সালের পর থেকে নির্বাচনে যারা পরাজিত হয়েছে তারা প্রশ্ন করেছে। কিন্তু নির্বাচনটি জনমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আর এখন এসে ২০১৪ সালে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ২০১৮ সালে রাতের ভোটের অভিযোগ। আর ২০২৩ সালে আমরা দেখছি সরকারি দল বিরোধী দল বানানোর জন্য বিরোধী দল যাকে মনোনয়ন দিচ্ছে সরকারি দল তাকে সমর্থন দিচ্ছে, সেটা আবার পোস্টারে লিখছে। অর্থাৎ নির্বাচনটি যে কতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ব্যাপার, কতো ছেলেখেলার ব্যাপার সেটা আমরা লক্ষ্য করছি। এই নির্বাচনে দেশের জনগণের কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। প্রশ্ন হলো দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়ে এরকম বিরোধী দল খোঁজার নির্বাচন না করে যদি টেবিলে বসে ঠিকঠাক করে নেওয়া হতো তাহলে তো রাষ্ট্রের এতোগুলো টাকা খরচ হতো না। পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক। ‘গোলাম মোর্তোজা’ ফেসবুক পেইজের ভিডিও কন্টেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস