শিরোনাম
◈ ভালোবাসার শহর প্যারিসে বৃষ্টিভেজা রাতে শুরু হলো অলিম্পিকস ২০২৪ ◈ সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী আজ ◈ কারফিউ আরো শিথিলের সিদ্ধান্ত হবে আজ, জানালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ একদফা দাবিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক বিএনপির ◈ শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে শ্রীলঙ্কা  ◈ ডিবি হেফাজতে কোটা আন্দোলনের ৩ সমন্বয়ক ◈ কোটা আন্দোলন: ঢামেকে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীসহ তিন জনের মৃত্যু ◈ হেলিকপ্টার দিয়ে মানুষ হত্যার জবাব জনগণ একদিন আদায় করে নেবে: মির্জা ফখরুল ◈ প্রতিটি হামলার ঘটনার বিচার হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে সরকার: প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত : ১১ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০৩:৪১ রাত
আপডেট : ১১ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০৩:৪১ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

গান এবং কবিতা

আহসান হাবিব

আহসান হাবিব: গান হচ্ছে কবিতার সংহত রূপ। যতো সংহত ততো সহজ। এজন্য গানের কথা সবচেয়ে সহজভাবে লেখা হয়। গানের কথা কঠিন হলে তা গীতিকবিতা না হয়ে কবিতা হয়ে উঠতে চায় তখন সুর দূরে সরে যেতে থাকে। গীতিকবিতা জানে কথা নয়, সুর তার জন্য অপেক্ষা করছে যে তার সারল্যকে ঢেকে ফেলে প্রধান হয়ে উঠবে। গীতিকবিতা তখন অলক্ষ্যে বসে বসে সুরের ইন্দ্রজাল দেখতে থাকবে। আমরা লক্ষ্য করি গানের কথা সরল হলেও তার ভেতর একটা চমক থাকে, প্রথম লাইন পড়া মাত্র মনের ভেতর একটা স্পার্ক জাগে। কিন্তু কবিতায় চমকের কোনো স্থান নেই, বরং ভাববস্তুটি থেকে চমক খসিয়ে ফেলতে হয়। চমক কবিতার জন্য একটি দুর্বলতা। কবিতা আমাদের অবচেতনে বসে থাকা অনুভবটি জেগে ওঠে, বিস্ময়ে সে অভিভূত হয়। কারণ কবিতা ততক্ষণে তার সামনে এক সত্য উপস্থিত করে ফেলেছে। কিন্তু গান? সত্য উপস্থিত করে কিন্তু তার জন্য তাকে অবচেতন পর্যন্ত যেতে হয় না, শোনামাত্র তা লতিয়ে ওঠে। একটু পরে যখন তা সুরের মায়ায় ঘনিয়ে ওঠে, কথা নিজেকে পেছনে নিতে শুরু করে। সুর সামনে এসে ঢুকে পড়ে কবিতার সেই অবচেতন স্তরে। কারণ সুর এবং কবিতা এক্ষেত্রে সমগোত্রীয়। কবিতার যে অংশ শিল্প তা আমাদের অবচেতনের সত্যকে প্রকাশ করে, গানের সুরের কাজটাও একই রকম।

তবে কি গানের কথা শিল্প নয়? অবশ্যই শিল্প, তবে সে সুরের বাহন, এই বাহন হয়ে ওঠার জন্য যে নির্মিতি, তার প্রকাশের মুনশিয়ানায় শিল্প হয়ে ওঠে। গানের কথা শিল্প হয় তখনই যখন নিজের প্রকাশ হবে সুসংগত সুসংযত এবং সুসংহত এবং তা সুরের জন্য হাত বাড়িয়ে দেবে। কবিতাকে সুরে বেঁধে ফেলা যায় না যদিও কবিতার অন্বিষ্ট হচ্ছে সংগীত হয়ে ওঠা। আসলে সমস্ত শিল্পেই অন্বিষ্ট সংগীতের দিকে যাত্রা। কেন? কারণ একজন শিল্পী যে শিল্পবস্তু নিয়ে যাত্রা করে, তাকে তিনি যখন শিল্পে রূপ দেন, তখন আর সেই প্রাথমিক শিল্পবস্তুটি অবিকল থাকে না, বদলে যায়। এই বদলে যাওয়া রূপটি কিন্তু তখন আর ধরা যায় না, অধরা হয়ে ওঠে। আর যা অধরা তাই সংগীত। তবে একজন গীতিকার এবং একজন কবি একই স্থান থেকে যাত্রা করেন। প্রথমে তাদের ভেতর যে বস্তুকল্পনা জাগ্রত হয়, তা হয়তো একই, কিন্তু প্রকাশের ক্ষেত্রে গিয়ে আলাদা হয়ে পড়ে। একই দার্শনিক চিন্তা গানে এবং কবিতায় ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ পায়। গান সরলতার দিকে যাত্রা করে, কবিতা সরলতা রেখে গভীরে ডুব দেয়। কারণ তার হাতে সুর নেই, আছে বিভিন্ন অলঙ্কার সঙ্গে শব্দ, ধ্বনি ইত্যাদি। এসব উপাদান দিয়ে তাকে তার ভাববস্তুটিকে শিল্প করে তুলতে হয়। কিন্তু গানের কথার জন্য সুর আছে যার উপর দায়িত্ব হচ্ছে গানের কথাটিকে সুরের সাহায্যে শিল্প করে তোলা।

গীতিকবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা সুর আপনাতেই লতিয়ে ওঠে। এটা তার শ্রেষ্ঠ গুণ। একজন সুরকার তার সংগীত জ্ঞান দিয়ে তাকে রাঙিয়ে তোলেন। এখানে গীতিকাব্যটি সুরের ব্যঞ্জনায় কতটা রঞ্জিত হলো, তা নির্ভর করে সুরকারের সংগীত এবং শিল্পবোধের উপর। গানের একটি ভাব কোন স্বরে রঙিন হয়ে উঠবে, বস্তুটিকে কতোটা শিল্পময় করে তোলা যাবে তা এই সুরকারের উপরই নির্ভর করে। সংগীতে স্বরের বিন্যাসে যে মানসিক ভাব ফুটে ওঠে, তা গানের কথায় এমনভাবে প্রযুক্ত করতে হয় যেন তা সুরের অন্বিষ্ট অধরার দিকে যাত্রা করে। যদি এই করণীয়টুকু ঠিকমতো না করা হয়, তাহলে কথা এবং সুর দুটোই মারা পড়বে। হয়তো দেখা গেলো গানের কথাটি অপূর্ব, কিন্তু সুরটি তাকে মুক্তি দিতে পারে নি, ফলে দুটোই ভেঙে পড়বে। কবিতা এক্ষেত্রে মুক্ত, একে শিল্প হয়ে উঠতে কারো সাহায্য নিতে হয় না। কবি নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা। দেখা গেছে একটি শিল্পবস্তুকে যখন অন্য একটি শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, তখন প্রাথমিক শিল্পবস্তুটিকে অপেক্ষাকৃত সহজ হতে হয়। একজন আবৃত্তিকার যখন কবিতা আবৃত্তি করেন, তিনি যথাসম্ভব সহজ কথার কবিতা বেছে নেন। কারণ রূপান্তর এটা দাবি করে। একটা নাটক যখন মঞ্চস্থ হয়, দেখা গেছে নাটকটি যতো সহজে গাঁথা হয়েছে, মঞ্চায়নে নেয়া হয়েছে ততো অভিনব এবং ইঙ্গিতময় প্রকাশভঙ্গী। কবিতার চেয়ে এটা নাটকের ক্ষেত্রে এটি উল্টো। রূপান্তরের প্রকাশ নির্ভর করছে প্রাথমিক শিল্প মাধ্যমটির উপর।

সুরের ক্ষেত্রে সে নিজে জটিল, কিন্তু তার উপাদানটি সারল্য দ্বারা নির্মিত। সুর যদিও মানুষকে আকর্ষণ করে খুব সহজে, কিন্তু এর গঠন প্রক্রিয়া খুবই জটিল। কবিতায় যেমন ছন্দ, এখানে তেমনি ছন্দ আছে যা গতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুরও কবিতার মতো ইমেজ, চিত্রকল্প ব্যবহার করে, তবে তাদের আগেই বলেছি ব্যবহারের উপাদান ভিন্ন। কোনটি সহজ এমন নয়। নির্ভর করে কবি এবং সুরকারের উপর। কবিতাকে যেমন মুক্তছন্দে প্রকাশ করা যায়, গীতিকবিতাকেও করা যায়, কিন্তু গানকে যখন সুরে গাঁথা হয়, তখন তাকে তার ছন্দ ছাড়া চলে না এবং সুনির্দিষ্ট মাত্রায় এটি হতে হয়। যদি এর বত্যয় ঘটে, গানটি ভেঙে পড়বে। কবিতার মুক্তছন্দের মতো সুরেরও বিহার আছে, কিন্তু তাকে বিহার শেষে ছন্দে ফিরতে হয়। কবিতার ক্ষেত্রে এই ফেরাটা নেই, সে মুক্ত করে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। গান এবং কবিতার এই জগৎ দুটোই এক- অমৃতলোক। এখানে শুধু ইন্দ্রিয় ক্রিয়াশীল থাকে তাদের অনুভবের জন্য। অনুভব অধরা, কিন্তু তার উৎপত্তিতে রয়েছে ধরা যায় এমনসব উপাদান। এই যে কবিতা এবং গানের/সুরের অমৃতলোকে যাত্রা- এটাই তাদের ঐক্যের জায়গা। অবশ্য এটা সব শিল্পের বেলায় সত্য। শিল্পবস্তু পড়ে থাকে, অনুভবের খেলা চলতে থাকে চিত্তের জমিনে। গীতিকবিতাকে মুক্তি দেয় সুর, কবিতাকে মুক্তি দেয় ভাবের অধরা শিল্পীত রূপ..। 

লেখক : ঔপন্যাসিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়