শিরোনাম

প্রকাশিত : ০১ ডিসেম্বর, ২০২৩, ১২:০৮ রাত
আপডেট : ০১ ডিসেম্বর, ২০২৩, ১২:০৮ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

‘কিসিঞ্জারি বুদ্ধি’ ও হেনরি কিসিঞ্জারের কুবুদ্ধি

মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন

মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন: নোয়াখালী অঞ্চলে কেউ কোনো কূটচাল দিয়ে কাউকে ঘায়েল করলে বলে ‘কিসিঞ্জারি বুদ্ধি’। ঢাকার গুলিস্তান ও আশেপাশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষের প্রাধান্য বেশি। সেখানে গেলে কান পাতলেই শুনবেন, ‘আর কইছ না। হিতে একটা কিসিঞ্জার’। মানে অতি চালাক কাউকে বুঝাতে নোয়াখালী অঞ্চলে ‘কিসিঞ্জার’ একধরনের উপাধি। যদিও মূলত নেগেটিভ টোনেই বলা হয়, কিন্তু মাঝে মাঝে কিসিঞ্জারি বুদ্ধি বলতে ‘বিপদে উদ্ধার পাওয়ার জন্য স্বার্থপর কোনো বুদ্ধিকেও বুঝানো হয়।’ যদিও সেটা পুরোপুরি পজিটিভ নয়, আবার নেগেটিভও নয়। কিসিঞ্জার নামটা এতোটাই পপুলার নোয়াখালী অঞ্চলে যে একজন কৌতুক শিল্পী ‘হারুন কিসিঞ্জার’ নাম ধারণ করে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কৌতুক পরিবেশন করে দেশে একসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। তার জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে অনেক সিনেমায়ও অভিনয় করেছিলেন। 

একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, দেশের অন্য অঞ্চলের লোক নোয়াখালীর মানুষের যেকোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, বিপদে তড়িৎ বুদ্ধিমত্তা, টিকে থাকার জন্য যেকোনো উপায় অবলম্বনের যে ক্ষমতা সেটাকে কটাক্ষ করে নোয়াখালীর লোকজনকে প্রায়ই ‘কিসিঞ্জারের’ সঙ্গে তুলনা করে। কিসিঞ্জার কে, কী তার পরিচয় সম্ভবত যারা ‘কিসিঞ্জার’ উপাধি হারহামেশাই ব্যবহার করে এমন মানুষ জানেও না। কেউ কেউ হয়তো জেনেই ব্যবহার করে। কিন্তু বেশির ভাগ হয়তো শুনে শুনে ‘অতি চালাকি’ বুঝাতে একটা রূপক শব্দ হিসাবেই ব্যবহার করে। 

আমি অনেকদিন ভেবেছি, কিসিঞ্জার শব্দটা নোয়াখালী অঞ্চলে এতো জনপ্রিয় হওয়ার প্রেক্ষাপট কী? এটা নিয়ে কারো কাছেই খুব একটা তথ্য নেই। তবে একবার চকবাজারে এক ব্যবসায়ী আমাকে জানালেনÑ পুরান ঢাকার চকবাজারে নাকি একসময় নোয়াখালী অঞ্চলের লোকজন দোকানের কর্মচারী হিসাবে কাজ করতো। নোয়াখালী অঞ্চলের লোক নাকি পরিশ্রমী ও চালাক। তাই দোকানের কর্মচারী হওয়ার বাইরেও তারা ছোট খাটো ব্যবসা করতো ফেসভ্যালু কাজে লাগিয়ে। এভাবে করতে করতে নিজের পুঁজি হয়ে গেলে সে আলাদা ব্যবসা শুরু করতো। এভাবে করতে করতে দেখা গেলো চকের ব্যবসায়ীদের একটা অংশ একদা কর্মচারী হিসাবে শুরু করা নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষের হাতে চলে এলো। তখন নাকি পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা নোয়াখালী অঞ্চলের কর্মচারী থেকে দোকানদার বনে যাওয়া ব্যবসায়ীদের ‘কিসিঞ্জার’ হিসাবে ডাকতো। একই রকম অবস্থা, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, বাংলাবাজার অঞ্চলে। সেখানেও নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষ ধীরে ধীরে ব্যবসা বাণিজ্যে ভালো স্থান দখল করে নিলো। কিসিঞ্জার শব্দটা বাংলাদেশের সঙ্গে অতোপ্রতোভাবে জড়িত। যারা জানে, হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলো এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের অন্যতম এই কিসিঞ্জারকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের কথামালা থেকে ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সম্বোধনে চলে আসে। কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে উপহাস করে বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেইস’ বলেছিলো। মানে তলাবিহীন ঝুড়ি এবং অনুমান করেছিলো বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। তার এই উক্তিকে একাডেমিয়া, রাজনীতি থেকে শুরু করে নানা জায়গায় চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং বাংলাদেশ কিসিঞ্জারকে ভুল প্রমাণ করতে পেরেছিলো। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিসিঞ্জারের ভূমিকা বিতর্কিত এবং অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পেছনে তার কুটচাল আছে বলে বিশ্ব রাজনীতিতে একধরনের আলাপ আছে। এমনকি শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পেছনে কিসিঞ্জারের প্রভাব আছেÑ এটা অনেকেই বিশ্বাস করে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও আমেরিকা আজকে যে সুপার পাওয়ার এটার পেছনে হেনরি কিসিঞ্জারের অনেক অবদান। বিশ্ব রাজনীতিতে বর্ণাঢ্য চরিত্র এই কিসিঞ্জার। সেই হেনরি কিসিঞ্জার ১০০ বছর বয়সে গত ৩০ নভেম্বর দেহত্যাগ করেছেন। জার্মানি থেকে জান হাতে নিয়ে ইহুদী বাবা-মায়ের সঙ্গে আমেরিকায় পালিয়ে আসা অভিবাসীর সন্তান এই হেনরি কিসিঞ্জার অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্র ছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন ও পিএইচডি করা এই রাজনীতি বিজ্ঞানী, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ফোর্ডের সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়েই আমেরিকা সোভিয়েতের সঙ্গে স্নায়ু যুদ্ধ শুরু করে। এমনকি বাংলাদেশের অভ্যুদয় সেই স্নায়ু যুদ্ধেরই একটা আউটকাম, এটাও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষনে প্রতিষ্ঠিত আলাপ। ভারত ও রাশিয়ার বিপরীতে পাকিস্তান, আমেরিকা ও চীন বলয়- স্নায়ু যুদ্ধের দুই অক্ষ। সেই স্নায়ু যুদ্ধকালীন নানা প্রক্সি ওয়ারে পৃথিবীতে কতো দেশে যুদ্ধ হলোÑ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান, আর্জেন্টিনা, সাইপ্রাস, আর কতো দেশে। কোথাও কিসিঞ্জারের পলিসি কাজে লাগলো, কোথাও লাগলো না। এই যেমন কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে তার বিখ্যাত ‘শাটল ডিপ্লোমেসি’র মাধ্যমে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে চীন আমেরিকার বলয়ে চলে এলো। আবার ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা নিজেকে সরিয়ে নিতে কিসিঞ্জারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেজন্য সে নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলো।

অন্যদিকে একই সময়ে ল্যাটিন আমেরিকায় তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে চিলিতে আগস্ট পিনোশকে সমর্থন দেওয়া এবং পিনোশের মতো মিলিটারি ডিক্টেটর যে গণহত্যা চালালো সেটার ফ্রি লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে কিসিঞ্জারের ভূমিকা মোটামুটি ওপেন ছিলো। সোশ্যালিস্ট আলেন্দে হত্যা করে যে পিনোশে ক্ষমতা নিলো তার পুরোটাই নাকি কিসিঞ্জারের প্লানেই হয়েছিলো। শুধু চিলি নিয় সত্তরের দশকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল সহ নানা দেশে যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনপ্রিয়তা পাচ্ছিলো সেটাকে দমন করে ‘নিও লিবারেলিজম’-এর আদলে পুঁজিবাদি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার পেছনে প্রধান কারিগর এই কিসিঞ্জার। পৃথিবীতে এই যে এখন নিও লিবারেল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জয় জয়কার (আমেরিকা, ইউরোপ এই মডেলেই চলে- ওয়াশিংটন কনসেনসাস মডেল) তার এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয়েছিলো চিলিতে আগস্ট পিনোশের অধীনে। এখন যে বিশ্বব্যাংক নানা দেশে সংস্কারের পরামর্শ দেয় সেই ‘শিকাগো বয়েজ’ মডেল এই কিসিঞ্জারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মিল্টন ফ্রিডম্যান চিলিতে প্রয়োগ করেছিলো। সেই মিল্টন ফ্রিডম্যানকে অনেকে আধুনিক পুঁজিবাদের পুরোধা মানে। ফ্রিডম্যান নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলো। আবার অন্যদিকে কিসিঞ্জার ইয়াম কাপ্পুর এর যুদ্ধ থামাতে ভূমিকা পালন করেন। যদিও তার সময়েই ইসরায়েলকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করার ও আমেরিকার একধরনের স্ট্রাটেজিক পার্টনার বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। সব মিলিয়ে কিসিঞ্জার পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতির শক্তিশালী কেন্দ্র হিসাবে মার্কিন সাম্রাজ্য গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান কারিগর। একইসঙ্গে লাখ লাখ মানুষের হত্যার আর্কিটেক্ট হিসাবেও তাকে দেখা হয়। বিশ্ব রাজনীতিতে সব দেশ নিজের স্বার্থই দেখে। আমেরিকাকে বৃহৎ শক্তি বানানোর অন্যতম কারিগর হিসাবে কিসিঞ্জারকে রিপাবলিকান দল-সহ আমেরিকার কনজারভেশনিস্টরা অতি সম্মানের সঙ্গে দেখে। কিন্তু মানবতাবাদী মানুষ তাকে দেখে কসাই হিসাবে।

যে যেভাবেই দেখুক, বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে হেনরি কিসিঞ্জার এক বিরল মেধা। অনেক যুদ্ধ সে যেমন করেছে, তেমনি অনেক যুদ্ধ সে ঠেকিয়েছে। পুরো ল্যাটিন অঞ্চলকে কমিউনিজমের বিস্তার ঠেকাতে তার যে প্রচেষ্টা, সেটা হাজার হাজার মানুষের জীবনকে ধ্বংস করেছে। হেনরি কিসিঞ্জারকে যদি পুঁজিবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চোখ দিয়ে দেখেন তাহলে হিরো মনে হবে। আর যদি সমাজতন্ত্র ও প্রগতির চোখে দেখেন তাহলে কসাই মনে হবে। কি আশ্চর্য্য- ঠিক যেই নীতিতে আমাদের জাতির পিতাকে হত্যার জন্য কিসিঞ্জারকে দায়ী করা হয় সেই জাতির পিতার দল আওয়ামী লীগ এখন হেনরি কিসিঞ্জারের সেই নীতিই ফলো করছে, ‘উন্নয়ন ও সম্পদ বৃদ্ধির জন্য মানবাধিকারকে কম্প্রোমাইজ করাই যায়। একইসঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও মিলিটাইয়ারেজশন হবে সেই উন্নয়নকে রক্ষা করার হাতিয়ার’। পৃথিবী আসলেই অদ্ভূত। ঈষৎ সংশোধিত। লেখক : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব মেইন, যুক্তরাষ্ট্র 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়