শামীম আল আমিন: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির সুর ভীন্নভাবে কিংবা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন অস্কার বিজয়ী সঙ্গীতজ্ঞ এ আর রহমান। তিনি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও খুবই পছন্দের মানুষ হলেও, যে কাজটি করেছেন, তাতে অনেকের মতো আমিও খুব ব্যথিত হয়েছি। তবে সুর নিয়ে সেই আলোচনা ভারতীয় সিনেমা ‘পিপ্পা’ কে নিয়ে এসেছে সবার মুখে মুখে। যদিও সিনেমায় গানটি খুবই অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। পুরো গানটি প্রকাশ করা হয়েছে এ আর রহমানের ইউটিউব চ্যানেলে। যা সঠিক সুরে করা হলে বিশ্ব দরবারে কবি নজরুলকে তুলে ধরার প্রয়াসের কারণে আমাদের হৃদয় এ আর রহমানের প্রতি মমতায় আরও পূর্ণ হোত। দু:খের বিষয় সেটি হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ‘পিপ্পা’ সিনেমাটি দেখেছেন কী? অ্যামাজন প্রাইমে মুক্তি দেয়ার প্রথম দিনই এটি দেখেছি, শিহড়িত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি, কৃতজ্ঞ হয়েছি। কেননা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর ‘পিপ্পা’ একটি অসাধরণ ও অনবদ্য সিনেমা।
এই সিনেমার মূল সৌন্দর্য তথ্যগত বস্তুনিষ্ঠতা ও দৃশ্যধারণে নৈপুন্য। এর সিনেমাটোগ্রাফি দূর্দান্ত। কাহিনির প্রয়োজনে ১৯৭১ সালকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অসামান্য দক্ষতায়। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত একচেটিয়া তাদের অর্জন বলে দাবি করেনি। বঙ্গবন্ধুর অসামান্য লড়াই, সংগ্রাম, ১৯৭০ এর নির্বাচনে নিরস্কুশ বিজয়, এরপর পাকিস্তানীদের বিশ্বাসঘাতকতা-সংক্ষেপে হলেও উঠে এসেছে চমৎকারভাবে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাকেও দেখানো হয়েছে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে। অতি সামান্য কিছু তথ্যবিভ্রাট হয়তো ছিল, তবে তা সিনেমার মানকে এতটুকু কমতে দেয়নি। যখন একটি দেশ সিনেমা বানায়, তখন তারা তাদের অবদানকে নির্ভর করেই তা তৈরি করে। মাথায় থাকে তাদের দর্শকের কথাও। সেটি করতে গিয়েও ‘পিপ্পা’ সিনেমা মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির অসামান্য ত্যাগ ও সংগ্রামকে মর্যাদার সঙ্গে তুলে ধরেছে।
সেই সঙ্গে উঠে এসেছে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের করুণ চিত্র। ‘পিপ্পা’ ভারতের ৪৫ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহতার জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ব্রিগেডিয়ার হওয়া বলরাম সিং মেহতার লেখা ‘দ্য বার্নিং চ্যাফিস’ বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে। অভিনেতা ইশান খট্টর প্রধান চরিত্রে দূর্দান্ত অভিনয় করেছেন। সিনেমায় দেখা যায় একসময়ের ‘অবাধ্য’ সেনা, যিনি ঘরে-বাইরে কোথাও প্রশংসিত নন, সেই ক্যাপ্টেন বলরাম কিভাবে এক বীরত্বগাঁধা রচনা করেছিলেন। ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহতার বড় ভাই মেজর রাম মেহতার চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রিয়াংশু পাইনুলি। মেজর রাম পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পরে চরম নিষ্ঠুর নির্যাতনের পরও মুখ খোলেননি। বরং অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে তাদের হাত থেকে মুক্তি পান। এই দুই ভাইয়ের বোন রাধা মেহতার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মৃণাল ঠাকুর। যিনি ভারতীয় গোয়েন্দাদের হয়ে বিভিন্ন কঠিন বার্তার সংকেত উদ্ধার করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
মূলত: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের একটি পরিবারের দুই ভাই ও এক বোনের বীরত্বগাঁথাই এই সিনেমার মূল উপজীব্য। ১৯৭১ সালে যশোরের চৌগাছার গরীবপুরের যুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন রাজা কৃষ্ণ মেনন। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী পিটি-৭৬ ট্যাংক ব্যবহার করেছিল। পানির উপর দিয়ে চলাচল করতে পারা এই ট্যাংককে ভারতীয় সেনারা ‘পিপ্পা’ নামে ডাকতেন। সেই যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি শহীদ হন। আহত হন ভারতীয় সেনাদের অনেকে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে গৌরবের অর্জন। বাঙালির সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ ও লড়াইয়ে অর্জন। কেবল এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া নয়। প্রত্যক্ষভাবে লড়াই করাসহ আরও নানাভাবে বাংলাদেশকে তখন সহায়তা দিয়েছে প্রতিবেশী ভারত। আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সিনেমায় যা অনেকটাই উপেক্ষিত। অথচ কারও অবদান থাকলে, তা স্বীকার করা কিংবা তুলে ধরার মধ্য দিয়ে ইতিহাস বরং সমৃদ্ধ হয়। আমাদের অর্জনও তাতে কিছু ম্লান হয় না। ফেসবুকে ২০-১১-২৩ প্রকাশিত হয়েছে।