হরিদাস ঠাকুর: ১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সমবায় সম্মেলনে প্রদত্ত এক বার্তায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবায় সম্পর্কে তাঁর ঐতিহাসিক দর্শন ও স্বপ্নের বর্ণনা দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও একটি উন্নত জীবন পাবেÑ এটি আমার স্বপ্ন। এই প্রেক্ষাপটে তৃণমূল সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ সমবায়ের পথই সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দর্শন ছিল এদেশের মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনগণের কল্যাণের জন্য গভীর বদ্ধমূল মানবিক দর্শন। বঙ্গবন্ধুর দর্শনের ভিত্তি হলো, একটি ঐতিহাসিক বিশ্বাস যে শুধু জনগণই ইতিহাস তৈরি করতে পারে। এই মানুষ বা নাগরিকরাই স্মার্ট বাংলাদেশের প্রধান উপাদান। বঙ্গবন্ধুর সুগভীর স্বপ্ন ও মানবিক সংগ্রাম তার উন্নয়নের রূপকল্পের প্রতিফলন। এই স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর ডাকা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিফলিত হয়েছিল, যেখানে স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের জন্য অন্তত দুটি জিনিস নিশ্চিত করাÑ [১] মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করা, [২] অসাম্প্রদায়িক মনন গড়ে তোলা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় বারবার ব্যক্ত করেন। স্বাধীনতার আগেও তিনি সোনার বাংলার ধারণা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর সোনার বাংলার ধারণায় মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর আস্থা ছিল, যা বাস্তবায়িত হলে বিশে^র মানচিত্রে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে এ দেশের অবস্থান নিশ্চিত হবে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর আস্থাশীল ছিলেন। তাই ১৯৬৯ সালে বৈষম্যের চিত্র সম্বলিত তাঁর পুস্তিকাটির নাম ছিল ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন? কেন সোনার বাংলা শ্মশান?’ পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত একটি সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর চিন্তা-চেতনা, কর্ম ও প্রচেষ্টায় বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি ছিল। তাঁর স্বল্প শাসনামলে তিনি একদিকে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা আঁকেন, অন্যদিকে তা বাস্তবায়নের জন্য সব বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন অনুকরণীয় দিকনির্দেশনা। তিনি যেমন দেশের গন্তব্য নির্ধারণ করেছেন, তেমনি গন্তব্যে পৌঁছানোর রোডম্যাপও তৈরি করেছেন।
জাতির পিতার উন্নয়ন দর্শন ও স্বপ্নের ধারাবাহিক অগ্রগতির ধারায় বাংলাদেশ ২০৩১ সালে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের উন্নত দেশে রূপান্তরিত হবে, যা রূপকল্পে তুলে ধরা হয়েছে। ২০৪১ সালের দিকে বাংলাদেশ হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, যেখানে থাকবে না কোনো দারিদ্র্য, থাকবে না কোনো অভাব, আর কোনো অশিক্ষা। তখন স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি প্রধান উপাদান থাকবে : (ক) স্মার্ট সিটিজেন, (খ) স্মার্ট সোসাইটি, (ঈ) স্মার্ট অর্থনীতি, (উ) স্মার্ট সরকার। ২০৪১ সালে স্বাধীনতার ৭০ বছর উদযাপন উপলক্ষে, আমরা সফলভাবে ২০৪১ এর রূপকল্প বাস্তবায়ন করব, একটি গতিশীল প্রযুক্তি-ভিত্তিক উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ যেখানে থাকবে : (ক) কাগজবিহীন অফিস (খ) ক্যাশলেস সোসাইটি (গ) সিমলেস কানেক্টিভিটি। এই সমস্ত কারণ ও বিশ্বাস মানব উন্নয়নের জন্য মৌলিক ও এটিই স্মার্ট বাংলাদেশের প্রধান উপাদান। বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ ও ‘সমবায়ের বাংলা’ বিনির্মাণে জনগণকে স্মার্ট মানুষ ও মানবসম্পদে পরিণত করতে সমবায়কে কার্যকর অবস্থান নিতে হবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ উদ্যোগ প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে প্রিয় মাতৃভূমিকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করার একটি বাস্তব প্রকল্প। আর এই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রকল্পের রূপকল্পে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার সহ একটি বাংলাদেশকে বোঝার জন্য আমরা ‘সমবায়ের বাংলা’ বলতে চাই, যেখানে সমবায় দর্শন ও চেতনার আলোকে সম্মিলিত পদক্ষেপ হবে: (১) মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত ও সমৃদ্ধ হবে, (২) দেশ সকল প্রকার অপরাধ মুক্ত হবে, (৩) দেশ হবে সকল প্রকার দুর্নীতিমুক্ত, (৪) দেশে কোনো অব্যবস্থাপনা থাকবে না, (৫) সঠিক ব্যক্তি সঠিক জায়গায় থাকবে, (৬) কোন কাজের হাত অলস থাকবে না, (৭) দেশ একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে, (৮) দেশে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ হবে।
জাতির পিতার সমবায় দর্শন ও নির্দেশনা অনুসরণ করে সমবায় বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে কাজগুলো হতে পারে : (১) জনগণের দোরগোড়ায় সেবা ও পণ্য পৌঁছে দিতে সমবায় খাতে উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন। (২) সমবায়কে নতুন প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিশেষ পণ্য ও সেবায় দক্ষ করে তোলা। (৩) ‘আন্তঃ-সমবায় সহযোগিতা’-এর সমবায় নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সমবায়কে পণ্য ও সেবার সংযোগ বিকাশের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা। (৪) নতুন ক্ষেত্রে সমবায় সম্প্রসারণ (যেমন : গার্মেন্টস সেক্টর, প্রবাসীদের কর্মসংস্থানের জন্য পতিত জমিতে কৃষি উৎপাদন, স্কুল সমবায়, পর্যটন সমবায়, স্বাস্থ্য সমবায় ইত্যাদি) (৫) স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য উপযুক্তভাবে জনশক্তিকে প্রশিক্ষিত করা। অর্থাৎ বাংলাদেশ অসীম সম্ভাবনার দেশ যার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে তার মাটি ও মানুষের মধ্যে। আমাদের যা করতে হবে তা হলো উৎপাদনের জন্য এর মাটি খনন করা ও এর মানুষের উন্নয়ন করা।
মাটি ও মানুষের অসীম সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার মূল দর্শন নিহিত রয়েছে ‘সোনার বাংলা’ ও ‘সমবায় বাংলা’। বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ ‘সমবায়ের বাংলা’ সাধারণ মানুষের সক্রিয়তার লক্ষ্যে সমবায় সক্রিয়তার একটি পরীক্ষিত মাধ্যম। আমরা বিশ্বাস করি জাতির পিতার সমবায়ের দর্শন স্মার্ট বাংলাদেশের উন্নয়নের সারমর্মও এখানে নিহিত রয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক। সূত্র : ডেইলি সান। অনুবাদ : মিরাজুল মারুফ
আপনার মতামত লিখুন :