শিরোনাম
◈ ইনু, মেনন ও পলককে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ ◈ জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত বিএনপি: সালাহউদ্দিন আহমদ ◈ বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধে কলকাতার ব্যবসায়ীদের ক্ষতি ৫০০০ কোটি রুপি ◈ আয়কর, ভ্যাট, শুল্ক আদায়ে ব্যর্থতা ও ব্যাংক খাতের স্থবিরতা নিয়ে টিআইবির উদ্বেগ ◈ শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের একই আইনজীবী নিয়ে বার্গম্যানের প্রশ্ন ◈ ছাত্রলীগ পরিচয়ে নির্যাতনের অংশীদার হতেন ‘ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা’, দিলেন অনেকের পরিচয়: আবদুল কাদেরের ফেসবুক পোস্ট ◈ সি‌লেট স্টে‌ডিয়া‌মে হ‌বে বাংলা‌দেশ - নেদারল্যান্ডস সিরিজের সব ম‌্যাচ ◈ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে সরকার পতন: এক বছরে বৈষম্য কতটা দূর হলো? ◈ ইয়েমেন উপকূলে শরণার্থীবোঝাই নৌকাডুবি, ৫৪ লাশ উদ্ধার ◈ ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতি আ‌মে‌রিকার  রাজ‌নৈ‌তিক ঝু‌কি বাড়া‌চ্ছে: অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত

প্রকাশিত : ১৬ অক্টোবর, ২০২৩, ০১:০৬ রাত
আপডেট : ১৬ অক্টোবর, ২০২৩, ০১:০৬ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

শমসের মবিন চৌধুরীর অতীত সম্পর্কে আমরা কতোটুক জানি?

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু: বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বর্তমানে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে একসময় তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ছিল। শমসের মবিন চৌধুরীর বাসা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাসার পাশেই লেকের উল্টো দিকে ১৬ নাম্বার রোডে। পাকিস্তান আমলে এই বাসা থেকেই  তিনি পড়াশোনা করেন। তবে এখন তিনি সেখানে থাকেন না। তিনি ঢাকার ডিওএইচএস আবাসিক এলাকার একটি ফ্লাটে থাকেন। শমশের মবিন চৌধুরীর ডাক নাম ‘শেহেরু’। পরিবারের চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার সর্বকনিষ্ঠ ভাইয়ের নাম শাহান। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল ভাইয়ের সঙ্গে ছিল তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই দেখেছেন, তাদের এই বন্ধুত্ব। বলতে গেলে তারা সবসময় একসঙ্গেই চলতেন। তাদের এই ঘনিষ্ঠতার জন্য এই সময় অনেকেই তাকে শেখ শাহান বলে রসিকতাও করতো। তিনি কয়েক বৎসর আগে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।  

শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৮ সালে। তিনি ওই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে লেফটেনেন্ট ছিলেন। আর আমি ছিলাম অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। খুব সম্ভবত চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে থাকতেন তিনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করার কারণে ওই সময় রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে খুব একটা কথা বলতেন না। তবে মনে হয়েছে, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তার ভেতরে ছিল এক প্রচণ্ড নিরব প্রতিবাদ। ওই সময় আসলে কী হতে যাচ্ছে, কী হতে পারে এ ধরনের একটা চিন্তা ভাবনা সকলের মাঝে বিরাজ করছিল। লেফটেন্যান্ট শমশের মবিনের চৌধুরীর সেদিনের সেই চেহারা আমার এখনো মনে পড়ে। সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট শমশের মবিন দেখতে খুবই আকর্ষণীয় ও স্মার্ট। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। সারা দেশে চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন। শমসের মবিন চৌধুরী ওই সময় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনীর লেফটেনেন্ট পদে খুব সম্ভবত মেজর জিয়াউর রাহমানের অধীনে ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন মার্চের শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রাম আক্রমণ করে তখন তিনি মেজর জিয়ার নেতৃত্বে হাতে অস্ত্র নিয়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। চট্টগ্রামে পাক হানাদার বাহিনী সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করতে করতে পিছু হটে একসময় তিনি চকবাজারের কাছে চলে আসেন। শোনা যায়, মেজর জিয়ার নেতৃত্বে বিদ্রোহ করলেও এইসময় তিনি পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে মেজর শওকতের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেন।  

চকবাজারের পাশেই কাতলগঞ্জ আবাসিক এলাকা। এখানে শমসের মবিনের নিকট আত্মীয় চট্টগ্রাম পাকশেল কোম্পানির তৎকালীন (বর্তমান নাম বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড) জি এম জুনেদ চৌধুরী থাকেন। তিনি বর্তমানে ঢাকার ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ১৮ নাম্বার সড়কে (পুরাতন) স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এখানেই একসময় হঠাৎ করে শমসের মবিন চৌধুরীর ফোন আসে। বলেন, আমি এখন তোমাদের বাসার কাছেই চকবাজারের আশেপাশে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সন্মুখ যুদ্ধ লিপ্ত। যেকোনো সময় আমার মৃত্যু হতে পারে। আমরা এখন অন্যান্য-সহ যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে কালুরঘাট রেডিও স্টেশন রক্ষা করার জন্য যাচ্ছি। আমার জন্য তোমরা দোয়া করবে। আমি পরে আবার টেলিফোন করবো। এই খবর হানাদার পাক সেনারা জানতে পেরে তারা কালুরঘাট ব্রিজ আগে থেকেই বোমা মেরে ভেঙে দেয়।

এদিকে অনেক সময় পার হওয়ার পরও শমসের মবিন চৌধুরীর কোনো খবর না পাওয়ায় জুনেদ চৌধুরীর পরিবারের সকলেই চিন্তিত হয়ে পরে। এভাবে কয়েকদিন পর কোনো টেলিফোন না আসায় একসময় ধরে নেওয়া হয় তিনি হয়তো আর জীবিত নেই। এর মাঝে হঠাৎ করে চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন মহাপরিচালক কাহার চৌধুরীর টেলিফোন আসে। চট্টগ্রাম বেতারের মহাপরিচালক কাহার চৌধুরী প্রখ্যাত লেখিকা বেগম সুফিয়া কামালের বড় মেয়ের জামাই। তিনি সম্পর্কে জুনেদ চৌধুরীর আত্মীয়। হঠাৎ একসময় কাহার চৌধুরী টেলিফোন করে জুনেদ চৌধুরীকে বললেন, শেহেরু খুব বিপদে আছে। কিছুক্ষণ পর রেডিও শুনলে সবকিছু জানতে পারবে। শেহেরুর কথা আছে আর বেশি কিছু না বলে তিনি টেলিফোন রেখে দিলেন। একটু পর চট্টগ্রাম রেডিও থেকে ভেসে এলো শমসের মবিন চৌধুরীর কণ্ঠ, আমি লেফটেন্যান্ট শমশের মবিন চৌধুরী বলছি। মেজর শওকত আপনি যেখানেই থাকুন আত্মসমর্পন করুন। পাক সেনারা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে ইত্যাদি অনেক কিছু যা এখন আমার মনে পরছে না। কিছুক্ষণ পর পর এই রেকর্ডটি চট্টগ্রাম রেডিও থেকে প্রচার করা হয়।

পরদিন কাহার চৌধুরী কাতলগঞ্জে জুনেদ চৌধুরীর বাসায় এসে বললেন, পাক সেনাদের সঙ্গে  যুদ্ধ করতে করতে একসময় শেহেরুর পায়ে গুলি লাগে। সে প্রচণ্ডভাবে আহত হয়ে পাক সেনাদের হাতে ধরা পরে যায়। পাক সেনারা টর্চার করে তার একটি পা কেটে ফেলেছে। আমি তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখেছি। সে এখন পাক সেনাদের হাতে বন্দী। হয়তো তারা তাকে পরে মেরেই ফেলবে। সাধারণত সাক্ষাৎকার নিতে মহাপরিচালকের যাওয়ার কথা নয়। যেহেতু বিষয়টি কাহার চৌধুরীর নিকট আত্মীয় শমশের মবিনের সাক্ষাৎকার, তাই অন্য কাউকে না পাঠিয়ে তিনি নিজেই সেখানে যান। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মেজর শওকত প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে যুক্তরাজ্যে হাই কমিশনার ও পরবর্তী সময়ে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বিএনপি আমলে তিনি একবার মন্ত্রী হন। তবে একসময় তিনি বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কের কারণে দল থেকে পদত্যাগ করেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সেক্টর কমান্ডার গ্রুপে সক্রিয় ছিলেন। 

এভাবেই যুদ্ধের পুরোটা সময় পাক সেনাদের হাতে বন্দী ছিলেন বীর বিক্রম শমশের মবিন চৌধুরী। শুধু বন্দী নয়, এই সময় পাক সেনাদের হাতে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন এই যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শমশের মবিন চৌধুরীর অবদান ও সাহসিকতার জন্য তিনি বীর বিক্রম খেতাব লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সরকার পায়ের চিকিৎসার জন্য তাকে ইস্ট বার্লিন প্রেরণ করে ও সেই সঙ্গে মেজর পদে প্রমোশন দিয়ে সামরিক বাহিনী থেকে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করা হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আমি যখন জেনারেল জিয়ার গ্রেফতারী পরোয়ানার আতঙ্কে পলাতক তখন শমশের মবিন চৌধুরী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল ওয়েস্টার্ন ইউরোপের দায়িত্বে ছিলেন। এসময় বাংলাদেশ থেকে বের হওয়ার জন্য তিনি আমাকে ভিসার ব্যাপারে সহযোগিতা করেন। তার এই উপকারের কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। তিনি পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বে থাকাকালীন এক সরকারি সফরে স্টকহোমে আসলে কিছু সময়ের জন্য আমাদের বাসায় আসেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি তখন আমাকে বলেন, ভালোই করেছো বিদেশে এসে। তা না হলে তুমি বিপদেই পড়তে! 

লেখক: নির্বাচিত বিচারক ষ্টকহল্ম আপিল কোর্ট, নির্বাচিত সদস্য সুইডিশ লেফট পার্টি স্টকহল্ম ডিসট্রিক্ট কমিটি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়