শিরোনাম
◈ মবের তাণ্ডব, ডাইনী সন্দেহে একই পরিবারের পাঁচজনকে পু.ড়িয়ে হত্যা ◈ মালয়েশিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় তিন বাংলাদেশি নিহত, আহত দুই ◈ এক ইলিশ বিক্রি হলো ১২,৪৮০ টাকায়! ◈ নতুন বন্দোবস্তে সবকিছু কি ওলটপালট হয়ে গেল? ◈ আগামীকাল শহীদ মিনারে ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ ঘোষণা ◈ ঢাকায় ছাত্রদল ও এনসিপির মহাসমাবেশ কাল: শাহবাগ ও শহীদ মিনারে পাল্টাপাল্টি জমায়েত, উত্তেজনা রাজনৈতিক অঙ্গনে ◈ গুলিস্তানে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ১১ ইউনিট ◈ যে কারণে নিজেদের সব কূটনীতিককে আরব আমিরাত ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ! ◈ তিন দি‌নের সফ‌রে ভারতে আস‌ছেন মে‌সি, খেল‌তে পা‌রেন কোহলি-ধোনির সঙ্গে ক্রিকেট ◈ এশিয়া কাপের ভবিষ্যৎ আবার অনিশ্চিত! পি‌সি‌বি‌কে ৩৭০ কো‌টি টাকার ভয় দেখা‌চ্ছে সম্প্রচারকারী সংস্থা

প্রকাশিত : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ১২:৪৯ রাত
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ১২:৪৯ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

পবিত্র কোরআনের কোথাও কি চাকরি সংক্রান্ত কোনো আয়াত আছে?

মোহাম্মদ আবদুল বাতেন

মোহাম্মদ আবদুল বাতেন: পবিত্র কোরআনের কোথাও কি চাকরি সংক্রান্ত কোনো আয়াত আছে? আমার জানামতে, সরাসরি নেই। কেউ জানলে জানাবেন। সূরা কাসাসে ২৬ নম্বর আয়াতে হযরত মুসা (আ.) প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একটা অংশ আছে এমন, ‘সবচেয়ে ভালো কর্মচারী সেই হবে, যে শক্তিমান ও বিশ্বস্ত’। এটা বুঝতে হবে আধুনিক ফর্মেটে যে চাকরি সেটা কোরআন নাজিল কিংবা প্রাক ইসলাম যুগে ছিলো না। তাই সেই সময়ে ওয়ার্ক এনভায়রনমেন্ট, ওয়ার্ক এথিক্স এসব আসলে ব্যক্তিগত চরিত্র দিয়েই মাপা হতো। আমাদের আধুনিক সমস্যা সমাধানে তাই আমরা কোরআন হাদিসের যে ব্যবহার তা অনেকটাই কিছু মৌলিক বিষয়ের মাধ্যমে বাকিটা এডজাস্টমেন্ট।

এই যেমন কোরআনে ২০টি আয়াতে রিবা শব্দটি এসেছে বিভিন্ন সূরায়। সূরা বাকারায়, আলে ইমরানে, সূরা নিসায়। কিন্তু সব আয়াতেই রিবা মানে আমরা যে অর্থে সুদ বুঝি, সেটা বুঝানো হয়নি। বরং রিবাকে বৃহদার্থে বুঝানো হয়েছে ‘অসম লেনদেন’ হিসাবে। কিন্তু আমাদের দেশে ইসলামী ব্যাংকিং চালু করার প্রাক্কালে তারা তাদের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি হিসাবে কিছু ধর্মীয় বক্তাকে হায়ার করলো, যারা গ্রসলি কনভেনশনাল ব্যাংকিংকে সুদ, হারাম এসব বলে রিজেক্ট করে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য স্পেস তৈরি করলো। ইসলাম কিন্তু সরাসরি ব্যাংকিং সিস্টেম নিয়ে কিছু বলেনি। তৎকালীন আরবে প্রচলিত মহাজনী সিস্টেমের অপকারিতা বুঝাতেই রিবা এসেছে। কারণ এই সিস্টেমে ঋণ গ্রহীতা সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ব্যাংকিং সিস্টেম আমাদের টাকা বিনিয়োগ করে সে একটা লাভ করে, সেই লভ্যাংশের একটা অংশ আমাকে দেয়। সেই অর্থে ইসলামে যেভাবে রিবার কথা এসেছে, সেটা কিনা ভেবে দেখার অবকাশ আছে। কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষ ধর্ম কিংবা আধুনিক কোনো শিক্ষায় বেশি শিক্ষিত না হওয়ায়, অথবা এক শ্রেণি সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত হলেও রিলিজিয়াস ট্রেইন্ড মাইন্ডের কারণে কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে কিছু বললেই সেটা বিশ্বাস করে নিজের যুক্তিকে এপ্লাই করে দেখেনি আসলে ‘ইসলামী ব্যাংক’ কীভাবে অপারেট করে? আপনি যে টাকা জমা রাখেন, সে যে বিনিয়োগ করে সেই বিনিয়োগের বিপরীতে সে কী লাভ কিংবা ইন্টারেস্ট নেয় না? ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে, ইন্টারেস্ট না বলে মুদরাবা বলে। কিন্তু কথা তো একই দাঁড়ালো। সেও বিনিয়োগের বিপরীতে লাভই করে। এ দেশে ধর্মের কথা বলে যেকোনো অন্যায়, অন্যায্য, অত্যাচার জায়েজ হয়ে যায়। কারণ আমাদের মাইন্ড ফলো করার জন্য ট্রেইন্ড,  রিজনিং করার জন্য না। (এই উদাহরণ আমি অনেকবার দিয়েছি)।

আমি পড়ে দেখেছি, সূরা নিসায় পুরুষের চার বিবাহের কথা যেভাবে লেখা আছে, সেটা অনেক কন্ডিশনাল। সেই কন্ডিশন পালন করতে গেলে পুরুষের একের অধিক বিবাহ করার কোনো সুযোগ নেই। আপনি আয়াত নম্বর দুই যদি পড়েন, তাহলে দেখবেনÑ এতিমের হক আদায়ের প্রেক্ষাপটে সেই আয়াত। তার পরের আয়াত নম্বর তিনে এসেছে, এতিম যদি মেয়ে হয় এবং তার অধিকার যদি ঠিকমতো আদায় করতে না পারে, তাহলে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তার অধিকার সংরক্ষণ করতে। সেই প্রসঙ্গে এসেছে যদি সেইক্ষেত্রে একের অধিক বিবাহ করার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে সেটাই করার জন্য। এখন আপনি আয়াত তিন বিচ্ছিন্নভাবে পড়লে মনে হবে, পুরুষকে বহুবিবাহ করতে অনুমতি দিয়েছে। আর আয়াত দুই ও তিন একসঙ্গে পড়লে মনে হবে, এতিমের প্রতি দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে একটা অপশন ক্রিয়েট করা হয়েছে। 

আরও কথা আছে, দুই তিন কিংবা চার বিবাহের পরের লাইনেই আছে, ‘যদি তোমার আশঙ্কা হয় যে, একাধিক স্ত্রীর সঙ্গে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে পারবে না, তাহলে একজনকে অথবা অধিকারভুক্ত দাসীকে বিয়ে করাই যথেষ্ট। এবার একসঙ্গে আয়াত দুই ও তিন পড়েনÑ কী মনে হচ্ছে? ইসলামে কি একাধিক বিবাহ আনকন্ডিশনাল? প্লেজার হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে? নাকি দায়িত্ব এবং ক্ষেত্র বিশেষে (আসলে একের অধিক মানুষের সঙ্গে একি মাত্রায় ইনসাফ কী সম্ভব? সম্ভব নয়) একের অধিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ধর্মকে পুরুষ এমনভাবে নিজের স্বার্থে উপস্থাপন করেছে যে, সে তার মতো সিলেকটিভ আয়াতকে কোট করে নিজের ফায়দা নিতে চেয়েছে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, আর আমরাও আমাদের ‘জাস্ট ফলো’ এভাবে ট্রেইন্ড মাইন্ডের কারণে নিজে খুঁজে দেখিনি আসলে ধর্মে বলেছে কী? বিশ্বাস করে গেছি, এটার পক্ষে খোড়া যুক্ত দাঁড় করিয়েছি। নিজের অজান্তেই ধর্মকে ব্যবহার করেছি মানবতার বিপক্ষে, সমাজে নারীর বিপক্ষে।

ধর্মে দুইটা স্ট্রাকচার থাকে। যেমন একটা বিল্ডিংয়ে একটা ফাউন্ডেশন থাকে যেটাকে বলে সাব স্ট্রাকচার। আর উপরে তলা থাকে সেটা সুপার স্ট্রাকচার। আমি যখন বলি একশো তলা বিল্ডিং। এটা আসলে বুঝায় সুপার স্ট্রাকচার। কারণ এটা ভিজিবল। কিন্তু এর নীচে একশ তলাকে সাপোর্ট করতে যে সাব স্ট্রাকচার  আছে সেটার কথা বলি না। কারণ সেটা ভিজিবল নয়। সাধারণ মানুষ শুধু ভিজিবল অংশটাই নিয়ে থাকে। কিন্তু যে ইঞ্জিনিয়ার সে কিন্তু সাব স্ট্রাকচার সম্পর্কে ঠিকই ধারণা থাকবে। ধর্মেও আমরা যেসব আচার ও রীতি দেখি এগুলো প্রকাশ- ভিজিবল সুপার স্ট্রাকচার। কিন্তু সেইসব আচারের পেছনে যে ফিলোসফিকাল ফাউন্ডেশন থাকে সেটা সাবস্ট্রাকচার কিংবা ভিত্তি। সেই ভিত্তির উপরেই দাঁড়িয়ে ধর্ম। তাই ধর্মকে আপনাকে দুটোই মিলিয়ে দেখতে হয়। সমস্যা আমাদের শোনা ও ‘জাস্ট বিলিভ’ গ্রুপ ধর্মের সুপার স্ট্রাকচার দেখেই সেটাকে অবশ্য পালনীয় ধরে এটার ফিলোসফিকাল ফাউন্ডেশন সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না। যাদের যথার্থ শিক্ষা নেইÑ তারা না পারুক, কিন্তু শিক্ষিত লোক ও পারে না। কারণ এভাবেই বড় করা হয়েছেÑ ‘প্রশ্ন করো না, বিশ^াস করো’। এই যে প্রশ্ন করো না বিশ্বাস করো, এটা পলিটিক্যাল প্রজেক্ট। এই পলিটিক্সে ধর্ম আসলে ক্ষমতাবানের হাতিয়ার। কারণ ক্ষমতা তার নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখতে যেকোনো প্রশ্নকে দমন করতে চায়। 

যে দুইটা বহুল প্রচারিত বিষয়ের উদাহরণ দিলাম তাতে কী মনে হচ্ছে, ধর্মের সুপার স্ট্রাকচার হিসাবে রিবা ও চার বিবাহ আমাদের সামনে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, ধর্মের সাব স্ট্রাকচারও কি একই মিনিং কনভে করে? আমি শুধু দুইটা বললাম, আপনি অনুসন্ধিৎসু মন ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আলোকে পবিত্র কোরআন পড়ে দেখবেন, অনেক ইস্যু পাবেন যা তথাকথিত ওয়াজিয়নারা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করে নিজেদের রুটি-রুজির ও ভক্তকুল বজায় রাখার জন্য তার সঙ্গে প্রেক্ষাপট ও ফিলোসফিকাল মেসেজ কতোটা ভিন্ন।

পুরো কোরআনে যেখানে ছেলেদের চাকরি নিয়েই সরাসরি কোনো আয়াত নেই, সেখানে মেয়েদের চাকরির প্রসঙ্গ আসে কেমনে? এটা সত্য, ইসলামে পর্দা সম্পর্কে নেই, উপদেশ আছে। এখন কেউ তার ধর্মীয় উপদেশ মেনে পর্দা করে চাকরি করতে তো বারণ নেই। অন্তত আমি কোরআন পড়ে এমন কোনো আয়াত পাইনি। উল্টো খাদিজা (রা.) হযরত মুহম্মদ (সা.)কে তার ব্যবসায় নিয়োগ করার আগে নিজেই ব্যবসা পরিচালনা করতো। তার মানে ইসলাম নারীদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে নিষেধ করেনি। তাহলে চাকরিকে নিরুৎসাহিত কিংবা নিষিদ্ধ করার প্রশ্নই আসে না। আয়েশা (রা.) তো যুদ্ধও করেছিলেন (উটের যুদ্ধ)। অন্তত কয়েকজন নারী সাহাবী কৃষিকাজ ও ব্যবসায় নিযুক্ত ছিলেনÑ এমন তথ্য নানা গ্রন্থেই পাওয়া যায়। তাহলে এই ক্রিকেটার নারীর চাকরি সংক্রান্ত এসব তথ্য পেলো কোথায়?

ওই যে আমাদের অল্প শিক্ষিত ওয়াজিয়ান, যারা দুই কলম আরবি পড়তে শিখেছেন। কিন্তু টেক্সট ইন্টারপ্রিটেশন ও এনালাইটিক্যাল এবিলিটি অর্জন করেননি। তারা নিজেদের অল্প বিদ্যার সঙ্গে নারীকে আটকে রাখার জন্য বয়ান তৈরি করেন, সিলেক্টিভ আয়াত দিয়ে সেসব বয়ানের এভিডেন্স আমাদের সামনে হাজির করে। আমাদের ‘হুজুর কি ভুল বলেছেন?’ কিংবা ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’! এভাবে ট্রেইন্ড মাইন্ড সেটাকে বিশ্বাস করে নিছে। তানজিমের দোষ দিয়ে লাভ কীÑ আমার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা বন্ধুকেই দেখলাম, সাফাই গাচ্ছেন তানজিম নাকি সঠিক বলেছেন! ধর্মে নাকি এভাবেই আছে। তারা নিজেরাও ভেড়ার পাল। এসব ভেড়ার পাল তৈরির দায় দেবো আমি শিক্ষা ব্যবস্থাকে। প্রশ্ন করা শিক্ষা না দিলে ভেড়ার পাল তৈরি হবে। আর সেই ভেড়ার পালকে একশ্রেণীর ওয়াজিয়ান রুটি রুজির টার্গেট গ্রুপ বানাবে। এভাবেই সাইকেল পুনঃউৎপাদন হতেই থাকবে। সমস্যা তানজিম সাকিব নন। সমস্যা অনেক গভীর। এটা সামাজিক সমস্যা। তানজিমকে নিষিদ্ধ করলে কিংবা বহিষ্কার করলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। কোটি কোটি মানুষ তানজিম যা লিখেছেন, নারী সম্পর্কে সেটাই বিশ্বাস করেন। তারা শুধরে যাবেন? না। তারা আরও গোড়া হবেন। তারা বিশ্বাস করবেন, তারাই সঠিক এবং তানজীম তার ধর্ম পালনের জন্যই বৈষম্যের শিকার। 

তানজিম সাকিবকে সঠিক তথ্য দিয়ে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। তার ভাবনা যে মোটাদাগে ভুল, সেটা ধর্মীয় ব্যাখা দিয়েই তাকে বুঝাতে হবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে ইনভেস্ট করতে হবে সমাজে ও শিক্ষায়। যাতে মানুষ বিনা বাক্যে বিশ্বাস না করে প্রশ্ন করতে শিখে। ধর্ম মানুষ জাতির মঙ্গলের জন্য, সমাজকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। বিনা বাক্যে ধর্ম বলে যেটা মেনে নেন, সেটা আসলেই ধর্ম কিনা, নাকি যিনি বলছেন তার স্বার্থ সিদ্ধি আগে সে জায়গা নিয়ে ভাবতে হবে। সত্য অনুসন্ধানী মনন ছাড়া, বৈজ্ঞানিক মানসিকতা তৈরি করা ছাড়া,  সমাজ থেকে ধর্মীয় এই পার্শিয়াল ব্যাখার মাধ্যমে সামাজিক অসাম্যের যে দ্বন্দ্ব, সেটাকে মোকাবেলা করা যাবে না। নিষিদ্ধ করা সমাধান নয়। বরং আরও অনেকগুলো সমস্যার জন্ম দেওয়া। সমাজের বিশাল অংশের এজেন্সিকে ইগ্নোর করা। এভাবে ইনক্লুসিভ সমাজ গড়া যাবে না। 

 লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব মেইন, যুক্তরাষ্ট্র

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়