শিরোনাম
◈ মবের তাণ্ডব, ডাইনী সন্দেহে একই পরিবারের পাঁচজনকে পু.ড়িয়ে হত্যা ◈ মালয়েশিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় তিন বাংলাদেশি নিহত, আহত দুই ◈ এক ইলিশ বিক্রি হলো ১২,৪৮০ টাকায়! ◈ নতুন বন্দোবস্তে সবকিছু কি ওলটপালট হয়ে গেল? ◈ আগামীকাল শহীদ মিনারে ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ ঘোষণা ◈ ঢাকায় ছাত্রদল ও এনসিপির মহাসমাবেশ কাল: শাহবাগ ও শহীদ মিনারে পাল্টাপাল্টি জমায়েত, উত্তেজনা রাজনৈতিক অঙ্গনে ◈ গুলিস্তানে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ১১ ইউনিট ◈ যে কারণে নিজেদের সব কূটনীতিককে আরব আমিরাত ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ! ◈ তিন দি‌নের সফ‌রে ভারতে আস‌ছেন মে‌সি, খেল‌তে পা‌রেন কোহলি-ধোনির সঙ্গে ক্রিকেট ◈ এশিয়া কাপের ভবিষ্যৎ আবার অনিশ্চিত! পি‌সি‌বি‌কে ৩৭০ কো‌টি টাকার ভয় দেখা‌চ্ছে সম্প্রচারকারী সংস্থা

প্রকাশিত : ২৫ জুন, ২০২৩, ০৪:০৪ সকাল
আপডেট : ২৫ জুন, ২০২৩, ০৪:০৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ে 

ড. সেলিম জাহান

ড. সেলিম জাহান: শিক্ষকই তো তিনি আমার না, প্রথাগত অর্থে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন না। আমাকে পড়াননি তিনি, শ্রেণিকক্ষে তাঁর বক্তৃতা শুনতে বসিনি, আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি, সেই বিভাগেরই ছাত্র ছিলাম না আমি। তবু তিনি আমায় শিখিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে ধার করে নানান শব্দ শিখেছি, সাধারণ বাক্য ভেঙে-চুরে নতুন করে বাক্য-গঠন শিখেছে, লেখার কায়দাও অনেকটা রপ্ত করেছি তাঁর কাছ থেকে। বক্তৃতার শব্দ-চয়ন, স্বর-প্রক্ষেপন, উপস্থাপন সেটাও অনেকটাই শেখা তাঁর কাছে। তাই সরাসরি না পড়ালেও, শিক্ষক আমার অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি ঝওঈ নামে পরিচিত আমাদের প্রজন্মের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছেই। ২৩ জুন তাঁর জন্মতিথি। জন্মদিনের অন্তর্ময় শুভেচ্ছা তাঁকে।

সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালীন অবস্থায় তাঁকে খুব কাছে, থেকে চেনা-জানার একাধিক সুযোগ তেমন একটা হয়নি আমার। হ্যাঁ, বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভায় গিয়েছি বটে আমি কখনো-সখনো, তার লেখাও পড়েছি এখানে-সেখানে, কিন্তু তাঁর মতো একজন ব্যক্তিত্বকে চেনা-জানার জন্যে যে নৈকট্যের প্রয়োজন, তা সত্তরের দশকে আমার ছিলো না। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে আমার চেনা-জানার বলয় দৃঢ় হলো আশির দশকে আমি উচ্চশিক্ষা সমাপান্তে দেশে ফিরে এলে। একাধিক অঙ্গনে তখন আমাদের যৌথ পদচারণা, সভা-সমিতিতে, লেখালেখির জগতে, রেডিও-টিভির বলয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায়। দেখা হতো, কথা হোত, আলাপ-আলোচনা হতো কখনও দু’জনে, কখনো অনেকের সঙ্গে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকার সম্পাদক। প্রায়শই গবেষণামূলক নানা প্রবন্ধ নিয়ে তাঁর কাছে যেতাম। বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপ করতেন আমার সঙ্গে। ছেপেছেন আমার একাধিক প্রবন্ধ, প্রশংসা করেছেন লেখার, পরামর্শও দিয়েছেন নানান সময়ে নানান বিষয়ে। পত্র-পত্রিকায় লেখা বেরুলেও উল্লেখ করেছেন সে লেখার দেখা-হলেই। রেডিও-টেলিভিশনের নানান অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম দু’জনে। বাংলাদেশ বেতারে প্রভাতী অনুষ্ঠাণ ‘আজকের ঢাকায়’ এক সপ্তাহে তাঁর ধারাবাহিক কথিকা ‘কথার কথা’ যেত, অন্য সপ্তাহে আমার নিয়মিত কথিকা ‘যা না বললেই নয়’। বাংলাদেশ বেতারের স্বর্ণকণ্ঠ বালক কৌশিক আহমেদের উপস্থাপনায় আর প্রয়াত কবি আবু তাহেরের প্রযোজনায় হতো সে জননন্দিত সে অনুষ্ঠান। তাঁর কথিকা ধারণের জন্যে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নির্ধারিত সময়ে নিয়ম করে উপস্থিত হতেন, আমার কথিকা ধারণের জন্যে অনুষ্ঠান সংঘঠক মনোয়ারা আপাকে বাতি নিয়ে আমাকে খুঁজতে বেরুতে হতো। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, অনুষ্ঠানের সময়েই স্টুডিওতে কৌশিকের পাশে বসেই আমি পড়ে দিয়েছি আমার কথিকা। প্রযুক্তির কুশীলব এবং উপস্থাপকের উদ্বেগে স্টুডিওর বাতাস তখন ঘণ হয়ে আসতো। 

টেলিভিশনে আমার উপস্থাপিত অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেশ ক’বার এসেছেন। মনে আছে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফলতম  ছাত্রদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করার সময়ে আমি জোর দিয়েছিলাম যারা ব্যর্থ হয়েছে। সে অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমার বক্তব্যের জোর সমর্থন করেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে বড় গভীর বিশ্লেষণ করেছিলেন সে সমস্যার। জননন্দিত সে অনুষ্ঠান শেষে নানান গুণীজনের কাছ থেকে অভিনন্দনমূলক বার্তা পেয়েছিলাম দূরালাপনীতে। মধ্য আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে একটি ঘটনার কথা মনে আছে। প্রতি মঙ্গল ও বৃহস্পতিবারে কলাভবনের ২০২৮ এ আমার ক্লাস থাকতো, মঙ্গলবারের আমার পরেই ওখানে ক্লাস নিতেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বৃহস্পতিবারে প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুকের পোশাকী নাম)। 

মঙ্গলবার আমি সতর্ক থাকি। ঘণ্টা বাজলেই ক্লাস ছেড়ে দিই। স্যারকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। অনেক সময় স্যার এসে গেছেন জানলে শিক্ষার্থীরাও আমাকে চোখ দিয়ে জানান দেয়। আমি মুখের বাক্য অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসি। একদিন স্যার আমাকে বললেন, ‘এতো তাড়াহুড়ো করো কেন? পড়ানোটা শেষ করেই বার হও’। ‘আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন’! আমি নম্র স্বরে বলি। ‘তাতে কী? আমি তোমার বক্তৃতা শুনি। কতো কিছু শিখি অর্থনীতির’, হাসতে হাসতে বলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। নির্ভুলভাবে ‘কেইনসের মূল্য তত্ত্ব’ আউড়ে যান, তিনদিন আগে আমি যা বলেছি শিক্ষার্থীদের। আমি হতবাক।

আর দশজনের মতো অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখার আমিও পরম ভক্ত। দেদার লেখা পড়েছি তাঁর। কিন্তু তাঁর অজস্র লেখার মধ্যে তিনটি আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। প্রথমটি ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’, তাঁর প্রয়াত স্ত্রী নাজমা জেসমিন চৌধুরীর স্মরণে লেখা, দ্বিতীয়টি ‘আমার পিতার মুখ’, তাঁর পিতাকে নিয়ে লেখা এবং তৃতীয়টি ‘আমার বান্ধবেরা’, তাঁর সমসাময়িক ছাত্রবন্ধুদের নিয়ে লেখা। অসামান্য সে লেখাগুলোর বহু অংশই আমি এখনও গড় গড়িয়ে বলে যেতে পারবো। 

শেষের কথা বলি। ঘটনাটি বেনুর মুখে শোনা। কোথাও বেনুর সঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম দেখা। নানান কথার মধ্যে বেনু আমার উল্লেখ করে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাঁকে বলেছিল, ‘ও তো আপনার পরম ভক্ত’। সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্মিতহাস্যে বলেছিলেন, ‘আমিও তো ওর বিরাট ভক্ত’। তাঁর জবাবে বেনু উদ্বেলিত হয়েছিলো এবং বাড়ি ফিরে খুব গর্বিতভাবে আমাকে এ গল্প বলেছিলো। নানান জনের কাছ থেকে বহু প্রশংসা আমি জীবনে পেয়েছি, কিন্তু অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এ প্রশস্তিটুকু আমি চিরকাল আমি মাথায় তুলে রাখবো। শুভ জন্মতিথি জানাই তাঁকে। লেখক: অর্থনীতিবিদ 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়