তসলিমা নাসরিন: ছবির এই ঘরটি ভাস্কর শামীম সিকদারের ঢাকার বাড়ির দোতলার একটি ঘর, যে ঘরটিতে আমি ১৯৯৪ সালের জুন জুলাই মাসের বেশির ভাগ সময় আত্মগোপন অবস্থায় ছিলাম। তখনকার সরকার আমার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ করে মামলা করেছিল, গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছিল। ওদিকে ধর্মান্ধ মৌলবাদিরা আমার ফাঁসির দাবিতে দেশে তাণ্ডব চালাচ্ছে। গ্রেফতার করলে, জেলে পাঠালে ধর্মান্ধ পুলিশ বা কয়েদি আমাকে খুন করতে পারে বেহেস্তের লোভে, এ কারণে প্রাণ বাঁচাতে আমাকে আত্মগোপন করতে হয়েছিল।
এই ঘরটিতে যে এক জলজ্যন্ত প্রাণী বাস করছে, তা তাঁর বাড়ির আর কাউকে জানতে দেননি তিনি। আমাকে তিনি ইজেল, ক্যানভাস আর রঙতুলি দিয়েছিলেন ছবি আঁকতে। অনেকগুলো ছবি এঁকেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি কত বড় লেখক জানি না, তবে ছবি আঁকা চালিয়ে গেলে তুমি অনেক বড় শিল্পী হতে পারবে’। না শিল্পী হওয়া আমার হয়নি। ছবি আঁকার কোনও প্রাথমিক জ্ঞান আমার ছিল না। তিনিও শেখাননি। বলেছিলেন, যা মন চায়, যেভাবে মন চায়, আঁকতে। আমি তা-ই করেছিলাম। সবকটা ছবি এখনও হয়তো তাঁর সেই বাড়িতেই আছে।
আত্মগোপন অবস্থা থেকে বেরিয়ে জামিন নিয়েছিলাম হাইকোর্টে গিয়ে। তার কিছুদিনের মধ্যে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। শামীম সিকদারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি আর। তবে বহু বছর পর একবার ফোনে কথা হয়েছিল। বলেছিলেন তিনি লণ্ডনে চলে যাচ্ছেন, ওখানেই থাকবেন। ফেসবুকে প্রায়ই খুঁজতাম তাঁকে। পাইনি। সেইসব অন্ধকার নামে আমার আত্মজীবনীর চতুর্থ খণ্ডর অনেকটা জুড়ে আছে তাঁর বাড়িতে থাকার বর্ণনা । বইটি শামীম সিকদারকে এবং আরও কজনকে উৎসর্গ করেছি, যাঁরা আমাকে দুঃসময়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন। বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বইটিকে বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছিল।
নীচের ছবিটি সম্পর্কে বলি, এক রাতে আমার বাবা আর দাদা এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। হয়তো আমাকে শেষ দেখা দেখার জন্য এসেছিল। তখনও ভয়ঙ্কর রকম অনিশ্চিত জীবন আমার। পুলিশ আর মোল্লাÑ দুই গোষ্ঠী আমাকে হণ্যে হয়ে খুঁজছে। এক গোষ্ঠী চাইছে জেলে ভরতে, আরেক গোষ্ঠী চাইছে ফাঁসি দিতে। আমার বাবা আমাকে আমার প্রিয় ফল আম খাওয়াতে চাইছেন। বাবার পেছনে দেখা যাচ্ছে শামীম সিকদারের বানানো লম্বা জিভ বের হওয়া ‘রাজাকার’ নামের কাঠের ভাস্কর্য। আর পেইন্টিংস? সব আমার আঁকা। ইজেলে রাখা ক্যানভাসে তখনও শামীম সিকদারকে আঁকার কাজ চলছে। ফেসবুক থেকে