শরিফুল হাসান: পানাম নগরী আর সোনারগাঁও। ঐতিহাসিক সব স্থাপনা অন্য দেশগুলোর থাকলে তারা কতো কী যে করতো তাই ভাবি। মাঝে মধ্যে দেখি এই যেমন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজে কুইন্স লেনের একশ বছর আগের একটি ছবি দেয়া হয়েছে এবং বর্তমান ছবি দিয়ে দেখানো হয়েছে জায়গাটা হুবহু এক আছে। আর আমাদের বাংলাদেশে? ঐতিহাসিক স্থাপনগুলো আমরা অযত্নে অবহেলায় ধ্বংসের পাশাপাশি রীতিমতো দখল করি। বেশ কয়েকবছর পর সোনারগাঁও এলাম। পানাম নগরী যে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি, এইটুকুও যে আছে তাইবা কম কী?
ইতিহাস বলছে, নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ে প্রায় ৪৫০ বছর আগে বারো ভূঁইয়ার দলপতি ঈশা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। ঈশা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবির নামে সোনারগাঁও এর নামকরণ করা হয়। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেতো মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়তো পালতোলা নৌকা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠে পানাম নগরী।
পানামে ছিল মসলিনের জমজমাট ব্যবসা। মূলত পানাম ছিলো বাংলার সেই সময়কার ধনী ব্যবসায়ীদের বসতক্ষেত্র। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছিলো ঢাকা-কলকাতা জুড়ে। এখন কিছু ভবন ছাড়া প্রাচীন সেই নগরীর তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই। তারপরও ঐতিহাসিক পুরনো বাড়িগুলো ঘুরলে ভালো লাগে এই ভেবে যে আমাদেরও অনেক কিছু ছিল। ১৬১১ সালে মোঘলদের সোনারগাঁ অধিকারের পর সড়ক ও সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানী শহরের সাথে পানাম এলাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর থেকে উত্তর দিকে হাঁটাপথেই পৌঁছানো যায় অর্ধ্বচন্দ্রাকৃতি পানাম পুলে। এই পুল পেরিয়েই পানাম নগর এবং নগরী চিরে চলে যাওয়া পানাম সড়ক।
পানাম নগরীর দুই ধারে ঔপনিবেশিক আমলের মোট ৫২টি স্থাপনা রয়েছে। এর উত্তরদিকে ৩১টি এবং দক্ষিণদিকে ২১টি স্থাপনা অবস্থিত। স্থাপনাগুলোর স্থাপত্যে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সাথে মোঘল শিল্পরীতির মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। পানাম নগরী নিখুঁত নকশার মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কূপসহ আবাস উপযোগী নিদর্শন রয়েছে। নগরীর পানি সরবরাহের জন্য দুপাশে খাল ও পুকুরের অবস্থান লক্ষ করা যায়। এমনকি সেই সময়ের টয়লেটগুলো দেখতেও ভালো লাগে।
পানাম নগরের আশে পাশে আরো কিছু স্থাপনা আছে যেমন- ছোট সর্দার বাড়ি, ঈশা খাঁর তোরণ, নীলকুঠি, বণিক বসতি, ঠাকুর বাড়ি, পানাম নগর সেতু ইত্যাদি। আফসোস, গত কয়েকশ বছরে পানাম নগরের বিস্তির্ণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয় অনেক বাড়িঘর। বর্তমানে পানাম নগরে রাস্তার দুইধারে পুরানো যেসব ভবন দেখা যায় তা মূলত ব্রিটিশদের সহায়তায় গড়ে উঠা উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দির হিন্দু উচ্চ বর্ণের ব্যবসায়ীদের তৈরি।
ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর এসব ব্যবসায়ীদের প্রতিপত্তিও হ্রাস পায়। ফলে ভবনগুলো ক্রমে পরিত্যক্ত হতে থাকে। আস্তে আস্তে তা আশপাশের মানুষ দখল করে। শুনতে অবাক লাগলেও সত্য হলো, স্বাধীনতার আগে পরেও বাড়িগুলো ১০-১৫ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হতো। আর এভাবেই মূল বাসিন্দাদের অবর্তমানে বাড়িগুলো অযত্নে ক্ষয়ে যেতে থাকে। আশার কথা হলো, ২০০৯ সালে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে পানাম নগরীকে মোটামুটি দখলমুক্ত করা হয়।
আফসোস লাগে এই কারণে যে সোনারগাঁও ঘিরে আমাদের দারুণ সব পরিকল্পনা হতে পারতো। কারণ, বাংলাদেশের লোকশিল্পের সংরক্ষণ, বিকাশ ও সর্বসাধারণের মধ্যে লোকশিল্পের গৌরবময় দিক তুলে ধরার জন্য ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের উদ্যোগে বিশাল এলাকা নিয়ে এখানে লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কতো কিছু হতে পারতো সোনারগাঁও আর পানামকে ঘিরে! শুধু পানাম আর সোনারগাঁও কেন সারাদেশে আমাদের কতো ইতিহাস ঐতিহ্য নদীনালা খালবিল পরিবেশ আমরা অযত্নে অবহেলায় ধ্বংস করছি। পুরান ঢাকার প্রাচীন সব ছবি নিয়ে আমি প্রথম আলোয় টানা একটা সিরিজ করেছিলাম একাল সেকাল। আমার ভীষণ কষ্ট লাগে। আচ্ছা, আর কবে আমাদের বোধ জাগবে? আর কবে?
লেখক: অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান, ব্র্যাক