শিরোনাম
◈ চলতি বাজেটে রাজস্ব খাতে বরাদ্দ বাড়ছে, আগামী বাজেটের রূপরেখা দেবে অন্তর্বর্তী সরকার ◈ খুনিকে দ্রুত জীবিত গ্রেপ্তার চাই, বন্দুকযুদ্ধের নাটক দেখতে চাই না: ইনকিলাব মঞ্চ ◈ আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের দাপট, গোল্ডসহ ১১ পদক অর্জন ◈ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্যাখ্যা দেননি. ইনকিলাব মঞ্চ কর্মসূচি দেবে সোমবার ◈ হাদি হত্যা মামলায় নতুন মোড়, সেই ফয়সালসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যাংকে শত কোটি টাকার লেনদেন ◈ বাংলাদেশের দুর্বল ব্যাংক কিনতে চীনকে প্রস্তাব, সহজ হবে লেনদেন, কমবে ডলারের চাপ (ভিডিও) ◈ চূড়ান্ত হলো বিএনপির ৩০০ আসনের মনোনয়ন, শিগগিরই ঘোষণা ◈ ধ্বংস্তূপ থেকে আবার দেশকে টেনে তুলবে বিএনপি: তারেক রহমান (ভিডিও) ◈ ভোটের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলবে: ইসি ◈ ভারত সফ‌রে মে‌সি ৮৯ কো‌টি টাকা পে‌লেও উদ্যোক্তা শতদ্রু দ‌ত্তের ২২ কোটি টাকা ফ্রিজ করলো তদন্তকারী অ‌ফিসাররা

প্রকাশিত : ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১২:৪৩ দুপুর
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০৩:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ভারতের করণীয় কী?

স্ক্রলে মন্তব্য প্রতিবেদন: বাংলাদেশের ছাত্রনেতা ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্ককে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগস্টে পতনের পর থেকেই যে সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল, হাদির মৃত্যুর পর তা এখন প্রকাশ্য বৈরিতায় রূপ নিয়েছে। এই উত্তেজনার পেছনে শুধু কূটনৈতিক ভুল নয়, ভারতের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক ভাষ্যের বেপরোয়া ভূমিকারও বড় দায় রয়েছে। যে মুহূর্তে সংযম, স্পষ্টতা ও দায়িত্বশীলতার প্রয়োজন ছিল, সেই সময়েই ভারতের জনপরিসরের বড় একটি অংশ বাংলাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ভারতবিরোধী মনোভাবের আগুনে ঘি ঢালছে।

হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার অনেক আগেই ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্ক ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ধারণা ছিল, শেখ হাসিনার শাসন অব্যাহত থাকবে- এই রাজনৈতিক বাজিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল ভারত এবং তার পতনের পর পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তারা ছিল ধীর, অনিচ্ছুক ও অস্বস্তিকর অবস্থায়।

এই ধারণা আরও দৃঢ় হয় যখন শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর ভারতে অবস্থান করতে থাকেন এবং তার বহু রাজনৈতিক সহযোগী ও সমর্থকও সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নেন। বহু বাংলাদেশির কাছে এটি প্রমাণ করে যে, ভারত আর নিরপেক্ষ প্রতিবেশী নয়, বরং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়া এক সক্রিয় রাজনৈতিক পক্ষ।

হাদির হত্যাকাণ্ড সেই সন্দেহগুলোকে আরও ভয়ংকর মাত্রায় নিয়ে গেছে। তিনি শুধু আরেকজন আন্দোলনকারীই ছিলেন না। তিনি জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে জড়িত একটি প্রজন্মের প্রতীক। এই প্রজন্ম জবাবদিহি, মর্যাদা ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবি তুলেছিল। তার মৃত্যু শুধু দেশের ভেতরের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধেই নয়, বরং কথিত বহিরাগত মদদের বিরুদ্ধেও ক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

আইনি প্রক্রিয়া চলমান থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্তরা ভারতে পালিয়েছে- এই ব্যাপক বিশ্বাস দায়মুক্তির এক শক্তিশালী বয়ান তৈরি করেছে। এ সপ্তাহে ঢাকা ও নয়াদিল্লির একে অপরের হাইকমিশনার তলব করা কেবল কূটনৈতিক বিরক্তির প্রকাশ নয়; এটি এমন এক সময়ে বিশ্বাস ও শালীনতার ভেঙে পড়ার সংকেত, যখন এই দুটিই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। তবে সবচেয়ে অস্থিতিশীলকারী শক্তিটি কূটনীতি নয়, বরং কথাবার্তা ও বয়ান। এর প্রতিফলন দেখা গেছে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার কাভারেজে, যা সীমান্তের দুই পাশেই আবেগ আরও উসকে দিয়েছে।

ময়মনসিংহের ২৭ বছর বয়সী দীপু চন্দ্র দাসকে বৃহস্পতিবার রাতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে জনতা পিটিয়ে হত্যা করে। তার মৃতদেহ গাছে বেঁধে আগুন দেয়া হয়। বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ দ্রুত হস্তক্ষেপ করে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। অন্তর্বর্তী সরকার হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেয়।

কিন্তু ভারতের বড় একটি অংশের গণমাধ্যম এই জবাবদিহি বা দ্রুত গ্রেপ্তারের বিষয়টি তুলে না ধরে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত দেশ হিসেবে উপস্থাপন করে। নৃশংসতার গ্রাফিক বিবরণ বাড়িয়ে দেখানো হয়। একটি অপরাধকে রূপ দেয়া হয় পুরো একটি সভ্যতার বিরুদ্ধে অভিযোগে। এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয় না, ন্যায়বিচারও এগিয়ে নেয় না। বরং এটি সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে আরও কঠোর করে, ভয় গভীর করে এবং এমন এক সময়ে বৈরী বয়ান শক্তিশালী করে, যখন সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল সংযম ও নির্ভুলতা।

শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে ভারতের অনেক গণমাধ্যম বাংলাদেশের অস্থিরতার জবাবে বিশ্লেষণের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। জুলাইয়ের আন্দোলনকে তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান হিসেবে দেখার বদলে বহু ভারতীয় টিভি চ্যানেল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম একে ইসলামপন্থী, উগ্রবাদী বা চরমপন্থী বলে চিহ্নিত করেছে।

এই উপস্থাপন শুধু ভুলই নয়, বরং আগুনে ঘি ঢালার শামিল। এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উদ্বেগকে প্রতিবেশী দেশের পরিবর্তনের ওপর চাপিয়ে দেয় এবং জনপ্রিয় প্রতিবাদকে ধর্মীয় উগ্রতার তকমা দিয়ে অকার্যকর করে তোলে। এই বয়ান বাংলাদেশের অস্থিরতার রাজনৈতিক ও সামাজিক শিকড় মুছে দিয়ে তার জায়গায় একটি সরলীকৃত ও ভীতিকর চিত্র বসিয়ে দেয়। এটি ভারতীয় দর্শকদের বলে- পাশের দেশে যা ঘটছে তা ন্যায়বিচার ও শাসনব্যবস্থার লড়াই নয়, বরং একটি নিরাপত্তা হুমকি। আর বাংলাদেশিদের কাছে বার্তা যায়- ভারত তাদের নাগরিক হিসেবে নয়, বরং নিয়ন্ত্রণযোগ্য সমস্যা হিসেবে দেখে।

আরও বিপজ্জনক হলো, ভারতপন্থী গণমাধ্যম ও ডানপন্থী রাজনৈতিক ভাষ্যে বাংলাদেশকে উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য ভূখণ্ডগত ও নিরাপত্তাগত হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করার প্রবণতা। প্রমাণ ও প্রেক্ষাপট ছাড়াই অনুপ্রবেশ, অস্থিতিশীলতা ও সীমান্ত অশান্তির আশঙ্কা তোলা হয়। এটি সাংবাদিকতা নয়। এটি নিরাপত্তাকরণ (সিকিউরিটিজেশন)। একবার বাংলাদেশকে হুমকি হিসেবে ফ্রেম করা হলে, সেখানকার প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনাই ভয় দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়।

সহযোগিতা সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। সংযমকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। উত্তেজনা তখন এড়ানো নয়, অনিবার্য বলে মনে হয়। এর ফল ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান। ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিক্ষোভ, এমনকি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পোস্টের কাছেও প্রতিবাদ দেখাচ্ছে যে, কী দ্রুত দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা রাস্তায় নেমে এসেছে। জনরোষ আর শুধু রাজনৈতিক অভিজাত বা কর্মী মহলে সীমাবদ্ধ নেই; এটি গণঅনুভূতিতে পরিণত হচ্ছে। আর যখন তা ঘটে, তখন নীরব কূটনীতির জায়গা সংকুচিত হয়ে যায়।

বাংলাদেশে ভারতের প্রতি নরম বলে মনে হওয়া যেকোনো কর্তৃপক্ষ বৈধতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়ে। ভারতে গণমাধ্যম চালিত বয়ান নীতিনির্ধারকদের কঠোর অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয়, যেখানে সূক্ষ্মতা বা সমঝোতার জায়গা থাকে না। এ কারণেই দায়িত্বশীলতা এত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্কে ভারত বড় শক্তি। তার গণমাধ্যমের আওয়াজ বড়, প্রভাব বেশি এবং সীমান্ত ছাড়িয়ে বয়ান গড়ার ক্ষমতাও প্রবল। এই প্রভাবের সঙ্গে দায়িত্বও আসে। বাংলাদেশের সংকটকে প্রধানত নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে দেখা শুধু বিশ্লেষণগত ভুল নয়, কৌশলগত আত্মঘাতী সিদ্ধান্তও বটে। এতে ক্ষোভ গভীর হবে, অবিশ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং এক প্রতিবেশী দেশ ধীরে ধীরে নিজেকে ভারতের বিপরীতে সংজ্ঞায়িত করবে।

ইতিহাসের সতর্কবার্তা

ইতিহাস স্পষ্ট সতর্কতা দেয়। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব দশকের পর দশক ধরে ওঠানামা করেছে- হস্তক্ষেপ বা দম্ভের ধারণা তৈরি হলে তা বেড়েছে, আর সম্মানজনক ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণে তা কমেছে। বর্তমান পরিস্থিতির পার্থক্য হলো- এই বৈরিতা ছড়াচ্ছে অভূতপূর্ব দ্রুততা ও ব্যাপকতায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, চাঞ্চল্যকর টিভি বিতর্ক ও উসকানিমূলক শিরোনাম ক্ষণিকের ক্ষোভকে রূপ দিচ্ছে কাঠামোগত বিচ্ছিন্নতায়। ভারত এখনো ভিন্ন পথ বেছে নিতে পারে। এর শুরু হওয়া উচিত হাদির হত্যাকাণ্ডের তদন্তে স্বচ্ছ সহযোগিতা দিয়ে।

তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো- বাস্তবতাকে বিকৃত করা গণমাধ্যম বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করা। ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানগুলো এমন ভান করতে পারে না যে টিভি স্টুডিও ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো শূন্যে কাজ করে। বেপরোয়া ফ্রেমিংয়ের মুখে নীরবতা নিজেই এক ধরনের সমর্থন। দায়িত্বশীল আচরণ মানে বাংলাদেশকে সমালোচনার বাইরে রাখা বা প্রকৃত নিরাপত্তা উদ্বেগ উপেক্ষা করা নয়। এর মানে হলো বিশ্লেষণ ও উত্তেজনার পার্থক্য বোঝা। এর মানে হলো- এক প্রতিবেশীর রাজনৈতিক রূপান্তরকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হুমকি না ভাবা। এবং এর মানে হলো- আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা সন্দেহ দিয়ে নয়, বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়ে রক্ষা করা।

ওসমান হাদির মৃত্যু হওয়া উচিত ছিল সহমর্মিতা ও সংযমের মুহূর্ত। কিন্তু সেটি এখন গভীর বিভাজনের অনুঘটকে পরিণত হচ্ছে। ভারত যদি তার গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক ভাষ্যকে তথ্যভিত্তিক না করে উত্তেজক হিসেবেই চলতে দেয়, তবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এমন এক বৈরিতার চক্রে আটকে যাবে, যা বর্তমান সংকটের বহু পর পর্যন্ত টিকে থাকবে। এখানে শুধু দ্বিপক্ষীয় সৌহার্দ্য নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় পারস্পরিক বিশ্বাসের মৌলিক কাঠামোই ঝুঁকির মুখে। একবার সেটি ভেঙে পড়লে, তা পুনর্গঠনে লাগতে পারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

(অশোক স্বেইন, লেখক সুইডেনের উপশালা বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ও সংঘাত গবেষণার অধ্যাপক। তার এ লেখাটি অনলাইন স্ক্রল থেকে অনুবাদ করেছে মানবজমিন )

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়