জাহিদ হোসেন: রবীন্দ্রসংগীত কীভাবে গাইতে হবে তাঁর উপর বিশ্বভারতীর স্বত্ব ছিল ২০০১ সাল পর্যন্ত। নজরুলের গানের উপর এমন কোনো স্বত্ব কারো ছিলো না। স্বত্ব থাকা বা না থাকায় এঁদের গানের কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। শিল্প বা সাহিত্যের ইতিহাসে দুটি মত দেখা যায়। প্রথমটি হলো, একটা কাঠামো ঠিক করে দেয়া যাতে কৌলিন্য বজায় থাকে। স্বাধীনতার নামে এত কষ্টে গড়ে তোলা সমাজ আর তার নানান প্রতিষ্ঠান যেন ভেঙ্গে না পড়ে। আপাতদৃষ্টিতে এই মত শুনতে ভালোই লাগে। তবে এর বিপদ হলো এতে প্রগতির ধারা ব্যাহত হয়। বিদ্যমান বিশ্বাস ও প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্য মেনে নিলে তাঁদের পছন্দের ঐ বৃত্তের মধ্যেই আবদ্ধ থাকতে হয়। এগোনো যায় না। মানুষ পুরাতনকে ভেঙ্গেছে বলেই নতুনকে গড়তে পেরেছে।
দ্বিতীয় পক্ষের মত হচ্ছে, মানুষ যা খুশি লিখুক, বলুক, বাজাক, গান করুক, নাচুক। যা টেকার তাই টিকবে। সময় সিদ্ধান্ত নেবে। আমি এই দ্বিতীয় পক্ষের অনুসারী। শিল্পের জন্যে শিল্পীর স্বাধীনতা থাকা দরকার। এই স্বাধীনতা হওয়া দরকার অসীম। নিরঙ্কুশ। অর্থাৎ একজন শিল্পী যা খুশি আঁকবে, লিখবে, গাইবে, বলবে, নাচবে। ভালো না লাগলে দেখবো না, শুনবো না, সরে আসব। কিন্তু বাঁধা দেবো না। কোনটা ভালো কোনটা খারাপ এই 'বিচার' করার যোগ্যতা আমার নেই। আমার কাঁঠাল খেতে ইচ্ছা না করলে খাবো না, কিনবো না, কিন্তু আমি বলতে পারবো না, ‘আজ থেকে কাঁঠাল খাওয়া নিষেধ’।
সক্রেটিসের সময় কি বাজে লেখা কেউ লেখেনি, বাজে কথা কেউ বলেনি? সেগুলো নেই কোথাও কিন্তু সক্রেটিস এখনও আছে। তাই কিছু বাজে যাচ্ছেতাই মনে হলে রে রে করে তেড়ে আসার দরকার নেই। বাধার প্রাচীর তুলে হিরো আলম রোদ্দুর রায়দের ‘দমন’ করে ‘সংস্কৃতি রক্ষা করতে চাইলে কমলকুমার মজুমদার বা নবারুণ ভট্টাচার্যও জন্মাবে না, এই খেয়ালটা রাখতে হবে। আরেকটা কথা বলা দরকার। রাষ্ট্র এসে মাঝখানে মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে রেফারির মতো দাঁড়াতে পারে। কিন্তু তা কোনো অবস্থাতেই ‘বন্ধ করা’র জন্যে নয়। বরং সাময়িক ভাবে সীমানা নির্দেশ করে দেওয়ার জন্যে। যেমন রাষ্ট্র এসে বলতে পারে যে, ধানের হাটে রসগোল্লা বিক্রি করা যাবে না।
অর্থাৎ ধানের জন্যে আলাদা আর রসগোল্লার জন্য আলাদা স্থান ঠিক করে দিতে পারে। কিন্তু ধান বা রসগোল্লা বিক্রিই করা যাবে না, বিক্রি করলে শাস্তি হবে এমন ‘নিষিদ্ধ করা’র নিয়ম মানবজাতির অগ্রগতির অন্তরায়। মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ইতিহাস সাক্ষী, অজস্র সৃষ্টির বুদবুদে প্রগতির প্রবহমান ঝর্ণাধারায় যা সুন্দর ও প্রয়োজনীয়, তা-ই টিকে থাকে। স্বতঃস্ফুর্ত প্রকাশে বাঁধা দিলে কী হয় তা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি/সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি? অতএব, একটু নাচ গানেই যে ঈমান আর সংস্কৃতি ধসে পড়ে, তা এমনিতেও টেকার জিনিস না। এই কথাটা সব ধর্মের দফাদার আর সংস্কৃতির চৌকিদারদের মনে রাখা দরকার।