এম আমির হোসেন: বেনজীর ধরা পড়ার পর দুর্নীতি নিয়ে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। কিছুদিন পরপর শীর্ষ দুর্নীতিবাজের খবর বের হয়। আর মানুষ এগুলো নিয়ে মেতে থাকে। বাংলাদেশে এমন বেনজীরের নজির অসংখ্য আছে। কেউ হয়তো বেনজীরের মতো, কেউ বেনজীরের কাছাকাছি কিংবা কেউ বেনজীরের চেয়েও এগিয়ে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ আছে। কিন্তু এই ক্ষোভকে কোনো রাজনৈতিক দল কাজে লাগাতে পারে না। এর অন্তর্নিহিত কারণ কী? ধর্ম, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি নিয়ে যেমন আমাদের যখন-তখন অনুভূতিতে আঘাত লাগে তদ্রুপ দুর্নীতি নিয়ে কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগতে খুব একটা দেখা যায় না এ দেশে। বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে ভারতের আম আদমি পার্টির মতো কোনো রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোটায়। এমনকি শাহবাগের মতো আন্দোলন গড়ে উঠার সম্ভাবনাও কম।
বাংলাদেশের সব শ্রেণি বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ প্রায় শতভাগ দুর্নীতিবাজ। কেউ হয়তো কম, কেউ একটু বেশি দুর্নীতিবাজ। কেউ টেক্স ফাইলে কম ট্যাক্স দেওয়ার জন্য দুর্নীতি করে, কেউ রাজউকের প্ল্যানের বাইরে বাড়ি বানিয়ে দুর্নীতি করে, কেউ জমি/ফ্ল্যাটের দাম কম দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন খরচ কমাতে দুর্নীতি করে, কেউ বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে দুর্নীতি করে, কেউ হাসপাতালে বেড পেতে দুর্নীতি করে, কেউ বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস বিলে দুর্নীতি করে। কেউ অফিস ফাঁকি দিয়ে দুর্নীতি করে, কেউ পদোন্নতি-পদায়নে দুর্নীতি করে। কেউ টকশোতে ডাক পেতে দুর্নীতি করে, কেউ নিজের সৃষ্টি প্রকাশ করতে দুর্নীতি করে, কেউ সরকারি খরচে হজ্বে যেতে দুর্নীতি করে, কেউ পুরস্কৃত হতে দুর্নীতি করে। এমনকী রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারগুলো জিতে নিতেও ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। দুধওয়ালা দুধে পানি দিয়ে দুর্নীতি করে, দোকানদার ভালো নোটের ভিতরে ছেড়া নোট দিয়ে দুর্নীতি করে। যে বড়ো সে বড়ো লেভেলের দুর্নীতি করে, যে ছোটো সে বড়ো লেভেলের দুর্নীতি করতে পারে না বলে ছোটো লেভেলের দুর্নীতি করে।
সবাই কেবল অন্যের দুর্নীতির সমালোচনা করে। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য যে ঈমান ও সততার দরকার তা নেই কারও মধ্যে। এ দেশের সিস্টেমটাই এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক দুর্নীতিতে না জড়িয়ে কোনো উপায়ও থাকে না। দুর্নীতি না করলে পদেপদে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। নিজের করা দুর্নীতি প্রকাশিত হবার আশঙ্কা নিয়ে সব মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত থাকতে হয়। তখন গলায় জোর থাকে না, সৎসাহস থাকে না। তাই এ দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন বা গণ-আন্দোলন গড়ে উঠার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
বড়ো কোনো দুর্নীতিবাজ ধৃত হলে বাঙালি উপরে উপরে টুকটাক গালি দিলেও মনে মনে তার বিপুল সম্পদ অর্জন নিয়ে ঈর্ষা করে। নিজে যদি এর কিয়দংশও অর্জন করতে পারতো তবে তার জীবন সফল হতো এমন ভাবনা ভাবতে থাকে। সেইসব দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতাবানরা নিজেদের আত্মীয় হলে গর্ববোধ করে। তাদের সাপোর্ট নিয়ে যদি নিজেও টুকটাক উচ্ছিষ্ট অর্জন করতে পারে এই ভাবনায় মশগুল থাকে। নিজের সন্তান পুলিশ, প্রশাসন, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, ভূমি অফিসে চাকরি পেলে খুশি হয় ব্যাপক দুর্নীতি করার সুযোগ পাবে বলে। আমাদের দেহ, মন, সংস্কৃতিতে দুর্নীতি তার মূল-কন্দ ছড়িয়ে রেখেছে। একে উপড়ানো এতো সহজ নয়। উপড়ানোর মতো কেউ নেই, উপড়ানোর আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করারও কেউ নেই। যাদেরকে নিয়ে এ আন্দোলন করবে কিংবা যারা করবে তারা নিজেরাও একএকজন দুর্নীতিবাজ কেউ ছোটো কিংবা কেউ বড়ো। এটা হলো আজকের বাংলাদেশের বাস্তব দুর্নীতি-চিত্র। লেখক: চিকিৎসক