রাহাত মুস্তাফিজ: ময়ূরী অ্যাডাল্ট ফিল্মের নায়িকা ছিলেন। আমাদের মিডিয়াপাড়া অবশ্য ময়ূরী, মুনমুন, পলী, নাসরিনদের সিনেমাকে ‘অশ্লীল সিনেমা’ হিসেবে চিহ্নিত করতো। অ্যাডাল্ট ফিল্ম আর অশ্লীল ফিল্মের মধ্যে বোঝাপড়া বা বোধের ক্ষেত্রে যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান এই ব্যাপারটা আমাদের মিডিয়া বা ইন্টেলেকচুয়ালরা ভেবে দেখেছেন বলে আমার জানা নেই। তো এই চিহ্নিতকরণ বা দাগকরণ নিয়ে আমার আপত্তি আছে। আই মিন হু দ্যা হেল আর ইউ বলার যে ওইটা অশ্লীল, এইটা শ্লীল? এই অথোরিটি আপনাদের কে দিয়েছে? আপনি/আপনারা কোন বয়সের ফিল্ম এইটা নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা বলতে পারেন। মানুষের রুচির পাহারাদারিত্ব করার রাইট আপনাদের নেই। গণরুচির বিষয়টিকে আসতে হবে অর্গানিক উপায়ে, মেকানিক্যালি গণরুচি তৈরি করা যায় না। যায় না বলেই নাট্যকার মামুনুর রশীদের ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কেন্দ্রিক হাহাকার অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছু নয়। তো রুচির ঠিকাদারি ব্যক্তিবিশেষের কান্ধে দিতে চাই না বলেই সেন্সরশিপের বিপক্ষে আমার অবস্থান। সেন্সরের নামে ওই দায়িত্বে থাকা লোকগুলি আসলে তাদের নিজস্ব রুচি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আদর্শ ও রাজনীতির চর্চা করে থাকে। এনিওয়ে, এই পোস্টের উদ্দেশ্য ময়ূরী এবং তার শিশু মেয়েটিকে করা একজন ইউটিউবারের আপত্তিকর প্রশ্ন নিয়ে।
দেখুন প্রশ্ন করাতে সমস্যা নেই। এমনকি স্টুপিড প্রশ্নেও সমস্যা দেখি না। সেক্ষেত্রে আমাদের বলার রাইট আছে। কিন্তু ওই ইউটিউবার কেবল স্টুপিড টাইপ প্রশ্নই করেনি, তার আসল উদ্দেশ্য ছিল সোশ্যাল শেইমিংকে উসকে দিয়ে আলোচিত হওয়া এবং সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পালে বাতাস দেওয়া। ওই ইউটিউবারের কখনও মনেই আসবে না যে ময়ূরীর সাথে অ্যাডাল্ট ফিল্মের সেইসব দৃশ্যগুলিতে আলেক্সাণ্ডার বো, মেহেদি, সোহেল খান, শাহিন আলমেরাও পারফর্ম করেছিল। তাদের শিশু সন্তানদের ওই একই প্রশ্ন করতে সে চাইবে না। কারণ সে জানে পাবলিক একজন অ্যাডাল্ট সিনেমার হিরো ‘মেহদির সন্তানের কাছে’ বাপের সেইসব সিনেমা দেখেছে কি না এটা শুনতে চায় না; পাবলিক ময়ূরী-পলী-মুনমুনদের সন্তানের কাছে তাদের মায়েদের সিনেমার বিষয়ে মতামত জানতে আগ্রহী। একজন পুরুষ সামাজিকভাবে স্বীকৃত বা অস্বীকৃত উপায়ে এক হাজার নারীর সঙ্গে শোয়ার অভিজ্ঞতালব্ধ হলেও কেবল পুরুষ বলেই তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে তার শোয়াশুইয়ির ইতিহাস ‘অযোগ্যতা’ নয়। কিন্তু একজন নারীর বেলায় স্লাট, বেশ্যা, মাগী ট্যাগ অবধারিত। এমনকি মৃত্যুর পরেও তার কবরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আদমের সচ্চরিত্রবাণ সন্তানেরা বলতে দ্বিধা করবে নাÑ ওই যে দ্যাখ মাগীর কবর।
একটা শিশুকে তার মায়ের অ্যাডাল্ট ফিল্ম বিষয়ে প্রশ্ন করা যায় না। ওই প্রশ্নটা ইন্টেনশনাল ছিল। আবারও বলি, অ্যাডাল্ট ফিল্মে পারফর্ম করার কারণে ময়ূরী কিংবা তার মেয়ের লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই এবং সমাজেরও লজ্জা পাওয়ার কোনও কারণ দেখি না। ময়ূরী-পলীদের ওই জাতীয় পারফর্মেন্সের ভোক্তা এই সমাজই ছিল। সমাজ যদি ফুলে ফুলে ঠোকাঠুকির ঠিক পরদিন বাচ্চার জন্ম চিৎকার শুনতে চায়, তাই শুনবে। অন্যদিকে সমাজ ঠোঁটে-অধরে ফরাসি লড়াই দেখতে আগ্রহী হয়ে থাকলে, তাকে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ দেখানোটাই বরং অশ্লীলতা। সত্যি কথা বলতে বাংলাদেশের সমাজ কঠিন চুম্বন দৃশ্য কিংবা যৌনতা দেখতেই আগ্রহী। নিতান্তই ‘ধর্ম ভণ্ড’ বলে পেটে এক. মুখে আরেক কথা বলে। ময়ূরী তার ফিল্মের পারফর্মেন্সের কারণে আজও অনুশোচনায় ভুগতে থাকলে তার কারণ সোসাইটি, তার কারণ ওই বদমাইশ টাইপ ইউটিউবাররা। এরাই অতীতকে সামনে এনে মানুষকে লজ্জার মুখোমুখি করতে তৎপর হয়।
ভাবতে অবাক লাগে পাশের দেশ ভারতে পর্যন্ত একজন প্রাক্তন হার্ডকোর পর্নোশিল্পী সানি লিওনে বলিউডের মেইনস্ট্রিম ফিল্মের শিল্পী হিসেবে মর্যাদার আসনে আসীন হতে পারছে, অথচ ময়ূরী-মুনমুন-পলীদের অতীতের নিতান্তই সফট অ্যাডাল্ট কন্টেন্টের জের এতবছর পরেও টানতে হচ্ছে। আমার জানামতে ওনাদের এখন কেউ কাজ দেয় না। এমনকি তথাকথিত ‘সুস্থ সিনেমায়ও’ তারা কাজ পান না। সানি তার ক্লিভেজ দেখিয়ে দিব্যি বি-টাউনে ইন্টিগ্রেটেড হয়ে গেছে; বিগ বস-কপিল শর্মা শোতে বিশেষ অতিথি হচ্ছে; অথচ আমাদের মুনমুন-ময়ূরীরা হিজাব-বোরকা ধরেও পাবলিক শেইমিংয়ের হাত থেকে বাঁচতে পারছেন না। তাদের সন্তানদেরও ওই লজ্জার ভাগ দেওয়ার জন্য ভিউ ব্যবসায়ী ইউটিউবার-সাংবাদিকরা মোবাইল-ক্যামেরা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এদের তাই মাইর দিয়ে কাজ হবে না। এরা সোশ্যাল ক্যান্সার। ক্যান্সার নিরাময় করে মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও শিক্ষা ব্যবস্থাকেই নিতে হবে। লেখক, ব্লগার, আইনজীবী ও নারী অধিকারকর্মী। ২৬.৪.২৪। ফেসবুক থেকে