শিরোনাম
◈ পাসপোর্ট অফিসে ভোগান্তি কিছুটা কমেছে, জনবল বাড়ানোর তাগিদ  ◈ কিরগিজস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ঘরে থাকার পরামর্শ দূতাবাসের ◈ কিরগিজস্তানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা: সাহায্য চাইলেন বাংলাদেশিরা  ◈ সংসদ ভবন এলাকায় দুই প‌ক্ষে‌র সংঘর্ষে শিক্ষার্থী নিহত ◈ আবারও বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১১৮৪৬০ টাকা ◈ ভেবেছিলাম দেশের সমস্যা ক্ষণস্থায়ী, এখন আরও বেড়েছে: এডিটরস গিল্ড ◈ দেশের উন্নয়ন দেখে বিএনপি’র মাথা খারাপ হয়ে গেছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ যুক্তরাষ্ট্র স্মার্ট প্রাণিসম্পদ প্রকল্পে ৩৪ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিবে ◈ সিটি টোলের নামে চাঁদাবাজি বন্ধ হলে কাঁচাবাজারে দাম কমবে: সাঈদ খোকন ◈ নরসিংদীতে পৃথক বজ্রপাতের ঘটনায় মা-ছেলেসহ চারজন নিহত

প্রকাশিত : ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ০১:৫৫ রাত
আপডেট : ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ০১:৫৫ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মিনার মাহমুদ : সাংবাদিকতার এক নিঃসঙ্গ সামুরাই

লুৎফর রহমান হিমেল

লুৎফর রহমান হিমেল: সাহসীরা কি কাপুরুষের মতো আত্মহত্যা করতে পারেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে নানাজন নানা কথা বলবেন, জানি। আমার কাছেও আছে উত্তর। সাহসীরাও নিজেকে কখনো সখনো এভাবে সরিয়ে নিতে পারেন পঙ্কিল দুনিয়া থেকে। যেমনটি মধ্যযুগে জাপানি বীরযোদ্ধা সামুরাইরা করতেন, নিজেদের আত্মসম্মান রক্ষায় হারাকিরি নামের আ-ত্ম-হ-ন-নে-র পথে যেতেন তারা। ‘জীবনের চেয়ে সম্মান বড়ো’ এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন তারা। শুরুর কথাগুলো এ জন্যই লিখলাম, যারা বাংলাদেশে সৎ ও মেধানির্ভর সাংবাদিকতা করেন তাদের জন্য ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ আজকের দিনটি একটি আলোচিত ও স্মরণীয় দিন। এদিন রাজধানীর একটি হোটেলে কপর্দকহীন অবস্থায় আ-ত্ম-হ-ন-ন করেন দেশে নতুন ধারার সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃত  মিনার মাহমুদ। সাংবাদিকতায় আমি তার চেয়ে নবীন তখন। সাংবাদিকতায় প্রবেশের পর থেকেই এই ‘মিনার’ নামটি শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। অগ্রজ-সিনিয়রদের কথায়, মিনার সত্যিকার অর্থেই ‘মিনারের’ মতোই ‘উঁচু’ মাপের সাংবাদিক ছিলেন। এসব শুনে আমার মনের মধ্যেও তার প্রতি ‘মিনারের’ মতোই উঁচু একটি ধারণা তৈরি হতে শুরু করে। সাংবাদিকতা থেকে নিরুদ্দেশ মানুষটির সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি, তিনি আমেরিকায় ‘স্বেচ্ছানির্বাসইেষ্ফ আছেন। এরমধ্যে ২০১২ সালের ২৯ মার্চ খবর বেরোয়, তিনি দেশে ফিরেছিলেন, সাংবাদিকতায় নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে নিজেকে এই পৃথিবী থেকেই সরিয়ে নিয়েছেন। ওই খবরে সেদিন আমার মতো আরো অনেক সাংবাদিকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো।

পত্রিকান্তরে তখন যা জানা গেলো তার সারমর্ম দাঁড়ালোএমন — মিনার মাহমুদ একজন কলমযোদ্ধা, সাংবাদিকতার সামুরাই। তিনি নিজের পেশার স্খলন দেখে আত্মসম্মান বাঁচাতে আসলে হারাকিরির পথই বেছে নিয়েছেন। নিজের আত্মসম্মানতো বাঁচিয়েছেনই সঙ্গে পেশার সম্মান বাঁচানোর পথও বাতলে দিয়ে গেছেন। সামুরাইদের আত্মসম্মান ধরে রাখার সর্বশেষ উপায় যেমন ছিলো ওই হারাকিরি, ঠিক তেমনই মিনার মাহমুদের সামনেও আর আত্মসম্মান রক্ষার কোনো পথ খোলা ছিলো না হয়তো।
হারাকিরি শব্দটি সম্পর্কে আগে থেকে সেভাবে আমার সবিস্তার কোনো ধারনা ছিল না। মিনার মাহমুদের আত্মত্যার পূর্বে লিখে যাওয়া ডায়েরির কথাগুলো যখন প্রকাশ্যে এলো, কী বুকভরা অভিমান, অবহেলা নিয়ে চলে গেছেন তিনি, তখনই হারাকিরি পদবাচ্যটি আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। মনে হলো, মিনার যে সাংবাদিকতা করতেন, মিনার শব্দটির মতোই বুক উঁচু করে সাহসের সঙ্গে কলম নামের তরবারি চালাতেন, সেই যুগ আর বহাল নেই। এখন এই মাঠ যারা দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের বেশিরভাগই অসৎ আর নীতি-মেধাহীন মানুষের দল। তিনি চেষ্টা করেছিলেন মহান পেশাটিতে আবার ফিরতে, পারেননি। যার ফলে নাকে খত দেওয়াও আর সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। এ অবস্থায় তিনি হারাকিরির পথই সঠিক হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। অথচ মাত্র ২৯ বছর বয়েসেই সফল সম্পাদক। কতোটা মেধাবী হলে ওই বয়েসেই একটি জনপ্রিয় প্রকাশনা বের করে ফেলা যায়। ১৯৮৭ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়েসেই সম্পাদক হিসেবে মিনার মাহমুদের যখন আবির্ভাব ঘটে, ৩২ পৃষ্ঠার নিউজপ্রিন্ট ‘বিচিন্তা’ তখন তাকে কিংবদন্তীতুল্য সাফল্য এনে দেয়। শুধু তাই নয়, বারুদ পত্রিকা ‘বিচিন্তা’ হয়ে উঠে তারুণ্যের সম্মিলন স্থল। পত্রিকাটিতে যারা কাজ করতেন তাদের গড় বয়স ছিলো তখন ২৪।

উত্তাল সেই সময়ে অকপটে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কলম চললো বিচিন্তার। এই রাজধানী শহর ঢাকা তখন স্বৈরাচারের চোখ রাঙানিতে থরথর করে কাঁপতো। পুলিশি রাষ্ট্রে টুঁশব্দটি করবার জো ছিলো না। কিন্তু এমন ভয়ানক পরিবেশেই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কলম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মিনার এবং তার তরুণ-তুর্কি সাঙ্গপাঙ্গরা। বিচিন্তার লেখনীতে কেঁপে উঠে স্বৈরাচার এরশাদের মসনদ। স্বৈরাচার বিদায় নিলেও মিনার বিচিন্তার কলম বেশিদিন চালাতে পারেননি প্রাণপ্রিয় রাজধানী শহরটিতে। সেই শহর থেকে তাকে প্রবাসে চলে যেতে হয় ফেরার হয়ে। পরে মিনার যখন ফিরলেন নিজের শহরে, ততোদিনে শহরের মানচিত্র যেমন পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে অনেক কিছুই। যারা তাকে শহরছাড়া করেছিলো, তারা তখনো ক্ষমতাবান প্রভাবশালীদের সহযোগী। সেখানে মিনার মাহমুদের কোথাও সম্মানজনক জায়গা হয়নি জীবন চালানোর জন্য। বুকভরা অভিমান ছিলো, দ্বিতীয়বারের মতো তাই বিদায়ের আয়োজন করলেন, তবে বিদেশ নয় সেটি একেবারে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার। 
যুক্তরাষ্ট্রের স্বেচ্ছা পরবাস থেকে দেশে এসে তিনি দেখেন, যাদের তিনি একদিন ক্যারিয়ার গড়ে দিয়েছিলেন, তারাই কেউ তাকে সহযোগিতা করেনি। পাহাড় সমান অভিমান ছিলো হয়তো। কিন্তু পাঁচ পৃষ্ঠার সুইসাইড নোটে সেসব অভিমানের ছিটেফোঁটাও লেখেননি তিনি। যেভাবে কায়দা করে অপলেখা এড়িয়ে সংবাদ লিখতে হয়, ঠিক সেভাবেই কায়দা করে সুইসাইড নোটের এক জায়গায় তাই লিখেছিলেন, আমার মৃত্যুর জন্য কেউই দায়ী নয়।

আহা পেশাদারিত্ব সুইসাইড নোটেও ষোলোআনা তার প্রতিফলন। সত্যিই কি তার মৃত্যুর জন্য কেউই দায়ী নয়? মিনার মাহমুদের আত্মহত্যা তাই পত্রিকার পাতার মামুলি কোনো আত্মহত্যার খবর নয়। বরং এটি সমাজের একটি মহান পেশার বর্তমান চালচিত্র। মিনার মাহমুদ হয়তো চলে যাওয়ার আগে নীরবে আমাদের বলে গেছেন, আসলে সাংবাদিকতার বর্তমান জগৎটা আমার জন্য নয়। আমার জগতটা শেষ হয়ে গেছে সেই আশির দশকেই। আজকে এখানে শুধু আপসের খেলা, যে খেলায় আমি অভ্যস্ত নই। লুৎফর রহমান হিমেল । সম্পাদক, স্বদেশ প্রতিদিন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়