শিরোনাম
◈ পাসপোর্ট অফিসে ভোগান্তি কিছুটা কমেছে, জনবল বাড়ানোর তাগিদ  ◈ কিরগিজস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ঘরে থাকার পরামর্শ দূতাবাসের ◈ কিরগিজস্তানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা: সাহায্য চাইলেন বাংলাদেশিরা  ◈ সংসদ ভবন এলাকায় দুই প‌ক্ষে‌র সংঘর্ষে শিক্ষার্থী নিহত ◈ আবারও বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১১৮৪৬০ টাকা ◈ ভেবেছিলাম দেশের সমস্যা ক্ষণস্থায়ী, এখন আরও বেড়েছে: এডিটরস গিল্ড ◈ দেশের উন্নয়ন দেখে বিএনপি’র মাথা খারাপ হয়ে গেছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ যুক্তরাষ্ট্র স্মার্ট প্রাণিসম্পদ প্রকল্পে ৩৪ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিবে ◈ সিটি টোলের নামে চাঁদাবাজি বন্ধ হলে কাঁচাবাজারে দাম কমবে: সাঈদ খোকন ◈ নরসিংদীতে পৃথক বজ্রপাতের ঘটনায় মা-ছেলেসহ চারজন নিহত

প্রকাশিত : ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ০৭:০২ সকাল
আপডেট : ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ০৭:০২ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

পহেলা বৈশাখ, বাঙালি ও বাংলাদেশ

শামীম আহমেদ

শামীম আহমেদ: পহেলা বৈশাখ নিয়ে আমার প্রায় সব স্মৃতিই প্রাক-বৈবাহিক। বিয়ের আগে আমি বেশ আয়েশী মানুষ ছিলাম। যমে-মানুষে টানাটানি ধরণের ঘটনা না হলে সকালে ঘুম থেকে ওঠা আমার জীবনের সবচেয়ে অপছন্দের কাজ। স্কুলে বাধ্য হয়ে উঠতে হয়েছে। তবুও মাঝে মাঝে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারিনি, বা অসুস্থতার অজুহাতে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছি। নটর ডেমে সে সুযোগ ছিল না। মতিঝিলে ক্লাসে যেতে হতো দুটো বাস পাল্টে, মিরপুর ৬ নাম্বার থেকে সকাল সাড়ে ৬টায়। তাও মাঝে মাঝে হিসাব-নিকাশ হতো কয়টা ক্লাস মিস হলেও উপস্থিতির হার ৮০ শতাংশের উপর থাকবে! সে অনুযায়ী যদি সকালের একটা দুটো ক্লাস মিস দেয়া যায়!! ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তাই বলতে গেলে বেহেশতের দরজা পেয়ে গেলাম। ক্লাস-টাস করা লাগে না। বছরে দুজন শিক্ষকের কাছ থেকে শুধুমাত্র ৮০% ক্লাস করেছি - এই মর্মে সার্টিফিকেট আনলেই হয়। যেহেতু আবুল বারকাত স্যারের গুড লিস্টে ছিলাম, তাই একটা সার্টিফিকেট কনফার্ম। অন্যটা যে কোন একজন শিক্ষককে পটিয়ে নেয়াই যেত। 

যেহেতু স্ট্যাটিসটিকসে দুর্বল ছিলাম, তাই ফরিদ স্যারের স্ট্যাটিসটিকসের সকাল ৮টার ক্লাসে গিয়েছিলাম দুই-একদিন। গিয়ে বুঝলাম তার পড়ানো (বলা উচিৎ চোথা দেখে দেখে ব্ল্যাকবোর্ডে সমানে লেখা ও মোছা) বোঝা সম্ভব না, তখন সেই ক্লাসও বাদ দিলাম। তাই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঘুমটা খুব আনন্দের ছিল। দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে ক্যাম্পাসে যেয়ে আবুল বারকাত স্যার বা আকাশ স্যারের ক্লাসগুলো করতে বা হারুন স্যারের সাথে আড্ডা দিতে ভালো লাগত। তারপর সন্ধ্যা বেলা রাজীব ভাইয়ের ঈঈউচঝ এ ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রজেক্ট করা। 

বিয়ের পর অবশ্য সেই আনন্দ আর থাকল না। ব্র্যাকে চাকরি করা শুরু করেছি। আফগানিস্তান প্রজেক্টে বেশীদিন থাকা হলো না, কারণ বউ কনসিভ করেছে। রিসার্চ ডিভিসান অর্থাৎ জঊউ তে জয়েন করলাম। বাসা নিকেতন, মহাখালিতে অফিস। সেই অফিসেও সকালে ঠিক সময়ে আসা আমার জন্য কঠিন ছিল। মাঝে মাঝেই আধঘন্টা, একঘন্টা দেরী হতো, অফিস ম্যানেজার মান্নান ভাই ঝাড়ি দিয়ে কারিগরি ত্রুটি দেখিয়ে ফর্মে সাক্ষর নিয়ে উপস্থিতি দিয়ে দিতেন, বেতন কাটা থেকে বেঁচে যেতাম। ওয়াটারএইডে দুর্ভাগ্যবশত দেশপ্রধান খায়রুল ইসলাম স্যারের মুখোমুখি ঘরে আমার অফিস। মাঝে মাঝে দেরি হয়ে যায়। সকাল বেলা খায়রুল স্যারের মেজাজ থাকে ভীষণ খারাপ। আফ্রিকান কফি পান করে দুপুরের খাবারের সময় আসলে স্যারের মুড আস্তে আস্তে ভাল হতো। তাই সকাল সকাল দেরী করে উনার সামনে দিয়ে যাওয়া ছিল বিপজ্জনক। সেই বিপদ থেকে বাঁচাতেন প্রতিষ্ঠানের বর্তমান দেশপ্রধান হাসিন আপা। উনি অফিসে আসলে উনার রুমে ডেকে নিতেন। ব্যাগ-ট্যাগ উনার রুমে রেখে, কোন একটা প্রকল্পের কাগজপত্র নিয়ে হন হন করে উনার রুম থেকে আমার রুমে যেতাম, যাতে খায়রুল স্যার মনে করেন সকালেই এসেছি, অন্য কাজ শেষে রুমে ঢুকছি! তবে সব জায়গায় জানপ্রাণ দিয়ে কাজ করতাম। রাত ২-৩টায় লেখালেখি ইমেইল ছিল আমার নিত্যসঙ্গী, তাই হয়ত ঘুমজনিত দেরী সবাই স্নেহের চোখে দেখতেন। 

বিয়ের পর ব্যাপারটা পাল্টে গেল। বউ পহেলা বৈশাখ ব্যাপক পছন্দ করে। আমিও পছন্দ করি, তবে সেটা ঘুম ভেঙে, ভিড় ঠেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়ার মতো না। আর যেহেতু সারা রাত কাজ করতাম, ভোর ৫টায় সেজেগুজে নিকেতন থেকে রমনায় যাওয়ার ঝোল থাকত না। তাও বিবাহিত মানুষের দায়িত্ব পালনের স্বার্থে বিয়ের বছর আমি জীবনে প্রথম পহেলা বৈশাখে গেলাম স্ত্রী ও শ্যালিকা সান্নিধ্যে। তারপর থেকে ঢাকায় যতদিন থেকেছি প্রতি বছর রমনায় গিয়েছি, মঙ্গল শোভাযাত্রা দেখেছি, চারুকলায় ঢুঁ মেরেছি। ঘামতে ঘামতে ঘুরে বেড়িয়েছি মেয়ের হাত ধরে। মেয়ের জন্মের প্রথম বছর কেবল ও আমাদের সাথে যায়নি, কারণ বয়স মাত্র ৫ মাস। কিন্তু তার ১ বছর ৫ মাস বয়স থেকে পরবর্তী ৭-৮ বছর আমরা নিয়মিত পহেলা বৈশাখের উৎসবে গিয়েছি। গরম, রোদ, ঘামে কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু লাখো মানুষের মিলনমেলা, হৈচৈ, গান-বাজনা আমাদের আনন্দ দিয়েছে। এখন ক্যানাডায় এসেও আমার মেয়ে যে দেশের প্রতি, সংস্কৃতির প্রতি চমৎকার শ্রদ্ধাশীল, তার একটা বড় কারণ মেয়েকে নিয়ে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা বলে আমি মনে করি। 

বাংলাদেশীদের নিজস্ব উৎসব মূলত তিনটি। স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ, বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর আর পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল। আর বাকি যা যা উৎসব তা ধর্মীয় বা পশ্চিমা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে একটা গোষ্ঠীর যেকোন কিছুতেই আপত্তি। যেকোন আনন্দে, যেকোন উৎসবে, যেকোন উদযাপনে। বিশেষ করে গোঁড়া মুসলিমদের দেখলে মনে হয়, ইসলাম মানেই শোক, ইসলাম মানেই বুক চাপড়ে আহাজারি করা; যে কারণে অন্য ধর্মের মানুষ ধর্মীয় আচারের মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পায়, সেখানে মুসলমানদের সব আয়োজনেই কোথায় যেন একটা চাপা শোক, হতাশা, সবকিছুই পরকালকেন্দ্রিক, এই জগতে কেবলই বিরহগাথা। 

আমি ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু আমার মনে হয় ধর্মের ব্যাখ্যায় অনেক লিবারেল হবার সুযোগ আছে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার সময় অনেক কিছুরই সুযোগ ছিল না, বিজ্ঞান ছিল অনেক পশ্চাদপদ। এখন কি আমরা মসজিদে মসজিদে লাখ লাখ এসি লাগানোর জন্য মানুষের কাছে চাঁদা তুলতে দেখি না? এই চাঁদা তোলার সময় কি কেউ বলে নবী (সাঃ) এর সময়  মসজিদে ফ্যান ছিল না, এসি ছিল না, তাই আমাদেরও এসব লাগবে না? অথচ ইসলামের ওই সময়েও মেলার উদাহরণ পাওয়া যায়। পহেলা বৈশাখ কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্যে আমি বাঙালির নিজস্ব উদযাপনটাকেই দেখি। সেই শোভাযাত্রায় প্যাঁচা বা হাতির মাথা থাকলেই কি আমি সেটার পূজারি হয়ে যাই? এতই সোজা? ২০২৪ সালে এসে একটা শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করলেই সেটা পুজো হয় না; হাতি যে হাতি, এবং প্যাঁচা যে প্যাঁচা - দেবতা নয়, সেটি কাউকে বোঝানোর জন্য বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাই যথেষ্ট। 

পহেলা বৈশাখে দেশে থাকা আমি মিস করি। দিনের বেলার রোদকে নয়, কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রার ওই আধঘন্টা কিংবা সন্ধ্যার দিকে রাস্তার ধারে খাবার, শিশুদের হাতে দেশীয় খেলনা, শাড়ি - পাঞ্জাবির বাহার, চারিদিকে রঙ আর রঙকে। এই সেমিস্টারে আমি যখন ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা, অর্থনীতি ও লোকালয় পড়িয়েছি, তখন অন্তত ৩টা ক্লাস আমি তাদের পড়িয়েছি বাংলাদেশ নিয়ে। গ্রামীন ব্যাংক, ব্র্যাক, আড়ং আর বিকাশ ছিল আমার পড়ানোর মূল বিষয়। পড়ানোর সময় আমি শিক্ষার্থীদের বলেছি তোমরা হয়ত এত এত বাংলাদেশ দেখে বিরক্ত হচ্ছো, কিন্তু আমি যখন সামাজিক ব্যবসা নিয়ে পড়াব, তখন আমাকে বাংলাদেশ নিয়ে পড়াতেই হবে। গ্রামীন ব্যাংক, বিকাশ, ব্র্যাক, আড়ং, গার্মেন্টস শিল্প -  যেকোন অর্থেই বিশ্বের জন্য সামাজিক অর্থনীতির উন্নয়ন মডেল। তাদেরকে আমি এ-ও বলি বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ, কিন্তু বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, সৌদি আরবের কোন মিল নেই। তোমাদের উচিৎ সুযোগ পেলে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, তাহলে তোমরা বুঝতে পারবে মডারেট মুসলিম দেশ মানে কী! তাহলে তোমরা বুঝতে পারবা আমরা কেন পাকিস্তানকে যুদ্ধে হারিয়েছি। এই সেই বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশকে আমি পশ্চিমা বিশ্বে পড়াই, সেখানে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের পথে কোন অন্তরায় থাকতে পারে না। একটা ভদ্র সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা, সহাবস্থান করা। যারা নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা হোক ধর্মীয় মৌলবাদ কিংবা প্রগতিশীল মৌলবাদ - তাদের ঠেকিয়ে দেবার জন্যেই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সবাইকে পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই। ১ বৈশাখ ১৪৩১। লেখক ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়