মাসুদ রানা: সলিমুল্লাহ খান অত্যন্ত দুর্বিনীতভাবে পশ্চিমবঙ্গবাসীদের ইনসাল্ট করে বলেছেন, “শেক্সপীয়ারের রচনাবলীতো অনুবাদ করতে পারে নাই গর্দভেরা।” এটি হচ্ছে ছোটোমুখে বড়ো কথা বলার মতো অসভ্য-স্পর্ধা, যা মানব-সমাজে ফিৎনা বা কোঁদল তৈরি করে, এবং এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কিংবা এক অঞ্চলের মানুষের বিরুদ্ধে অন্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যে অন্ধ বিদ্বেষ ও ঘৃণার জন্ম দেয়। ফলে, এতে মানব-সমাজ জ্ঞানে আলোকিত হওয়ার চেয়ে বরং বিদ্বেষ ও ঘৃণার অন্ধ আবেগে ডুবতে থাকে।
সলিমুল্লাহ খানের জন্ম ১৯৫৮ সালে। আর, অবিভক্ত বাংলার কলকাতায় শেক্সপীয়ারের বিখ্যাত ‘মার্চেণ্ট অফ ভ্যানিস’ নাটকের বাংলা গদ্যানুবাদ হয় ১৮৫৩ সালে। অর্থাৎ, আজকের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়, সলিমুল্লাহ খানের জন্মের ১০৫ বছর আগে শেক্সপীয়ারের রচনা বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। অনুবাদকের নাম হরচন্দ্র ঘোষ। হরচন্দ্র ঘোষ ছিলেন ছিলেন সে-সময়ের বিখ্যাত সাহিত্যিক, নাট্যকার ও অনুবাদ, যিনি বাংলা, ইংরেজি, ও ফরাসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি ছিলেন হুগলির মহসীন কলেজের ছাত্র এবং অনুবাদের জন্য তখনকার গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যাণ্ডের কাছ থেকে ১৯৪১ সালে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেন।
শেক্সপীয়ারের মার্চেণ্ট অফ ভেনিস নাটকটিকে দেশীয় রূপ দিয়ে তিনি ‘ভানুমতির চিত্তবিলাশ’ নামে অত্যন্ত মুনশিয়ানার সাথে অনুবাদ করেছেন। আজ, আমি ইণ্টারনেট আরকাইভে গিয়ে ভানুমতির চিত্তবিলাশ পড়লাম।
শেক্সপীয়ারের রচনার প্রথম বঙ্গানুবাদ পড়ে দারুণ লেগেছে আমার এই ভেবে যে, এটি সলিমুল্লাহ খানের জন্মের ১০৫ বছর আগে একজন দক্ষ বহুভাষী নাট্যকার দ্বারা কৃত। কিন্তু একই সাথে খুবই খারাপ লেগেছে এই ভেবে যে, পূর্বগামী বিদ্বানদের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ও সৌজন্য নেই সলিমুল্লাহ খানের, যিনি অনায়াসে বিদ্বেষ বশে বলে দিতে পারেন, “শেক্সপীয়ারের রচনাবলীতো অনুবাদ করতে পারে নাই গর্দভেরা।”
হরচন্দ্র ঘোষ শুধু একটিতে থেমে থাকেননি। তিনি ১৮৬৪ সালে বাংলায় অনুবাদ করেন শেক্সপীয়ারের বিয়োগান্তক দ্বন্দ্ব ও প্রেমের নাটক রোমিও এ্যাণ্ড জুলিয়েট, যার বাংলা নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘চারুমুখ চিত্তহারা’। একই নাটকের আরও অনুবাদ করেছেন রাধামধব কর, যোগেন্দ্রনারায়ণ দাস ঘোষ ও হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। হেমচন্দ্র মূল শিরোনাম ‘রোমিও-জুলিয়েট’ অক্ষুণ্ণ রেখেই এই অনুবাদ করেন ১৮৯২ সালে। এভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীতেই শেক্সপীয়ার অনেক নাটকের বঙ্গানুবাদ প্রধানতঃ কলকাতায়। অথচ বাংলার এই অনুবাদ সাহিত্যকে এক তুড়িতে তুচ্ছ করে সবাইকে ‘গর্দভ’ বানিয়ে দিলেন আমাদের দুর্বিনীত বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান।
আমি বুঝি না, আমাদের জাতির শিক্ষিত মানুষেরা এতো অভদ্র, অসভ্য ও দাম্ভিক হয় কীভাবে? এগুলো কি তারা পরিবার থেকে শেখে নাকি বিদ্যালয় থেকে? যেখান থেকেই তা এ-শিক্ষা সলিমুল্লাহ খান ও তাঁর মতো তথাকথিত শিক্ষিত পেয়ে থাকুন না কেনো, এর প্রতি সামাজিক প্রত্যাহার গড়ে তোলা দরকার। কারণ, দুর্বীনিত লোকের হাততালি পেলে, অসভ্যতার শীর্ষাহোরণের চেষ্টা করে এবং সমাজের বোধ ও জ্ঞানের জগতকে দুর্বিসহ করে তোলে। বিনয়ী জ্ঞানী যদি রূপতঃ আলোক ছড়ানো সূর্য হয়, জ্ঞানীর ভানকরা দুর্বীনিত তথ্যবাজেরা হচ্ছে রূপতঃ ধ্বংসাত্মক বারুদ-গোলক বা বোমা, যা বিকট শব্দ বিস্ফোরিত হয়ে নিজেকে সত্তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে অন্যকে আহত ও নিহত করের। বাংলাদেশে এখন প্রকৃত জ্ঞান ও বিনয়ের সাঙ্ঘাতিক আকাল চলছে। এর পরিবর্তন প্রয়োজন। আর, এর জন্য সঠিক সংবোধ ও সুরুচি জাগ্রত করাটা জরুরি। ১৯/০৩/২০২৪। লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড