শিরোনাম
◈ এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকে কোপালেন এনসিপি নেতা ◈ কমলাপুরে ট্রেনের শৌচাগারে এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণ, কর্মচারী আটক ◈ ভারতীয় পাইলটকে আটককারী সেই পাকিস্তানি মেজর টিটিপির হামলায় নিহত ◈ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও বাড়লো ◈ ‘তোমাদের হাতে ১২ ঘণ্টা সময় আছে’, এবার ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও ইরানি জেনারেলের ফোনকল ফাঁস ◈ এবার ইয়েমেন থেকে ইসরায়েলে হামলা ◈ আজ নতুন গিলাফে সজ্জিত হবে কাবা ◈ ইউনূসের আহ্বান: অপতথ্য দমনে মেটাকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে ◈ এনসিপিকে ‘শাপলা’ প্রতীক বরাদ্দ দিতে কোনো আইনি বাধা নেই: ১০১ আইনজীবীর বিবৃতি ◈ চীন সফরে তৃতীয় দিনেও ব্যস্ত সময় পার করলো বিএনপির প্রতিনিধি দল — বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা ও হাই-টেক খাতে সহযোগিতার আশ্বাস

প্রকাশিত : ০২ এপ্রিল, ২০২৩, ০৮:১৫ রাত
আপডেট : ০৩ এপ্রিল, ২০২৩, ০৯:৩৫ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কর্ণফুলীর বঙ্গবন্ধু টানেল, স্বপ্ন ও সম্ভাবনাময় স্বর্ণযুগের হাতছানি

কর্ণফুলীর বঙ্গবন্ধু টানেল

শেখ দিদার, চট্টগ্রাম: বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার ও অর্থনীতির হৃদপিণ্ড বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে বানিজ্যিক রাজধানী বলা হলেও কার্যকর বানিজ্যিক রাজধানী হয়ে উঠেনি চট্টগ্রাম। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন দুঃসাহসী ও দূরদর্শী যুগান্তকারি সিদ্ধান্তের ফলে আমূল পরিবর্তনের সাথে সাথে কার্যকর বানিজ্যিক রাজধানীতে রুপান্তরিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম। সরকারের বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি যা উপমহাদেশের প্রথম কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সুরঙ্গ সড়ক(বঙ্গবন্ধু টানেল) নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ হওয়ার পাশাপাশি চট্টগ্রাম নগরীকে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলা হবে । ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনার চীন সফরকালে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে (সরকারের সঙ্গে সরকারের) সমঝোতা স্মারক সই হয়। চীন সরকারই সিসিসিসিএলকে এই টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে।

এ বিষয়ে ওই বছরের ৩০ জুন সেতু কর্তৃপক্ষ ও সিসিসিসিএল এর মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয়। সেতু কর্তৃপক্ষ, চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল) ও অভি অরূপ অ্যান্ড পার্টনার্স হংকং লিমিটেড যৌথভাবে টানেল নির্মাণের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা করে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটি কর্ণফুলী নদীর তলদেশে মাল্টি-লেন টানেল নির্মাণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। মোট ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ২ শতাংশ সুদে প্রকল্প সাহায্যের বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। দেশের প্রথম টানেলের নামকরণ করা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে চীনের চায়না কমিউনিকেশনস ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসিএল) লিমিটেড। যদিও ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার লক্ষে এ প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল প্রায় ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। 

২০১৫ সালে অনুমোদিত হলেও প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। তখন প্রাথমিক ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে এক হাজার ৯২৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে মোট চারটি লেন রয়েছে। আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ উড়ালসড়ক। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার এই টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।

বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামে পরিবর্তনের হাওয়া :

স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা, কর্ণফুলী, পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের পরিবর্তন ইতিমধ্যে অনেকাংশই দৃশ্যমান । এ টানেল ধরেই কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ উন্নত হচ্ছে এবং পাশাপাশি রেল সংযোগও যুগান্তকারী সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। নির্মাণাধীন এই সড়কের দুপাশেই শিল্প কারখানা এবং আবাসনের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।ইতিপূর্বে কর্ণফুলীর উত্তর পাড়ে চট্টগ্রাম মহানগর আর টানেল নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় দক্ষিণপাড়ও দ্রতই রূপ পেতে যাচ্ছে শহরে। তারই ধারাবাহিকতায় নতুন করে চট্টগ্রাম মহানগর মাষ্টার প্ল্যানের কাজ শুরু করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এতে করে বিস্তৃত হবে মহানগরীর আয়তন। যার ফলে অনেকটা অদ্যুষিত গ্রামীণ জনপদ হিসেবে পরে থাকা নদীর দক্ষিণ পারেও এখন উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে । চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে কর্ণফুলী টানেলের ভেতর দিয়ে যানবাহন উঠবে কক্সবাজার মহাসড়কে। এ লক্ষ্যে প্রস্তুত হচ্ছে আনোয়ারা থেকে শিকলবাহা পর্যন্ত প্রায় দশ কিলোমিটার ছয় লেনের সড়ক যার কাজও টানেলের নির্মাণের সঙ্গে শেষ হবে। এছাড়াও এগিয়ে চলেছে দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপনের কাজ শীগ্রই এ লাইনে ট্রেন চালানোর টার্গেট সরকারের। কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড় আনোয়ারায় আগে থেকেই রয়েছে কাফকো (কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড, সিইউএফএল (চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড), কোরিয়ান ইপিজেড এবং বিভিন্ন ভারি শিল্প কারখানা। বঙ্গবন্ধু টানেল সেখানে শিল্পায়নের গতিকে আরও বেগবান করবে। চায়না ইকোনমিক জোন বাস্তবায়ন বড় একটি ধাপ এগিয়ে দেবে এই টানেল। কেননা এর মাধ্যমে সুগম হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে আনোয়ারা উপজেলা নতুন করে রূপ পাচ্ছে উপশহরে। পরিবর্তন ঘটছে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায়। টানেলের সংযোগ সড়কের জন্য শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে আনোয়ারা কালাবিবির দীঘি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ কিলোমিটার সড়কের ছয় লাইনের কাজ চলছে দ্রতগতিতে। ভৌগোলিক কারণে একদিকে সমুদ্র বন্দরের পাশে অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের ফলে আনোয়ারা হবে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ এক মাধ্যম। আনোয়ারার জনসাধারণ টানেল নিয়ে দেখছে নতুন দিনের স্বপ্ন। ইতিমধ্যে স্থানীয়রা গোয়াল পাড়া এলাকার নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু টানেলের সঙ্গে মিল রেখে নাম দিয়েছে টানেল নগর। টানেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে উপজেলায় জায়গা-জমির মূল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা, দোকানপাট, শপিংমল ও অসংখ্য অভিজাত রেস্টুরেন্ট। টানেলের কাজ সম্পূর্ণ হলে নতুন করে সৃষ্টি হবে আর্থ-সামাজিক অবস্থান। বাড়বে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ।আনোয়ারাকে ঘিরে সরকারের মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু টানেল, পারকি সমুদ্র সৈকতে আধুনিক মানের পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ, চায়না ইকোনমিক জোন, পিএবি সড়কের ছয় লাইন প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ হলে আনোয়ারা শুধু উপশহর নয়, একটি আন্তর্জাতিক বাজারে পরিণত হবে। চট্টগ্রাম শহরকে ওয়ান সিটি টু টাউন স্বপ্নের দ্বার উন্মোচনে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।পারকি সমুদ্রে সৈকতের পাশে চলছে বিশ্বমানের পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ। পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে ১৩ দশমিক ৩৬ একর জমিতে ৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে এই পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হচ্ছে। এটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠবে পারকি সমুদ্র সৈকত।১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে জি টু জি পদ্ধতিতে আনোয়ারা গহিরায় এলাকায় ৭৭৪ একর জমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল চায়না ইকোনমিক এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এতে ৩৭১টি শিল্প কারখানা স্থাপন করা হবে। এসব কারখানায় প্রায় দুই লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। একদিকে বিদেশী সব শিল্প-কারখানা অন্যদিকে টানেলের মূল পয়েন্ট হওয়ায় এখানকার মানুষের জীবনমান একশ বছর এগিয়ে গেছে। আনোয়ারার উন্নয়নে যে ক’টি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়িত হলে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম এগিয়ে যাবে।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ এই টানেলকে ঘিরে  বাড়ছে বিনিয়োগের সুযোগ :
কর্ণফুলী টানেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজটি হাতে নেওয়া হয়েছে। মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে সাগরিকা থেকে টানেল পর্যন্ত সাগরপাড়ে ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ রিং রোড নির্মাণ করা হয়েছে। ওই সড়ক যাবে টানেলের ভেতর দিয়ে। সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর্ণফুলী টানেল চালুর প্রথম বছর ৬৩ লাখ গাড়ি টানেলের ভেতর দিয়ে চলাচল করবে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা-হালিশহরে বাস্তবায়ধীন আউটার রিং রোড কাজ করবে টানেলের অ্যাপ্রোচ সড়ক হিসেবে। নগরী থেকে টানেল অতিক্রম করে মেরিন ড্রাইভ কক্সবাজার যাবে আনোয়ারা উপজেলা হয়ে। সেই আনোয়ারাতেই বাস্তবায়িত হবে চীনা ইকোনমিক জোন। উত্তর দিকে এই মেরিন ড্রাইভ চলে যাবে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর পর্যন্ত। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদস্যভূক্ত অনেকে বিনিয়োগ করছে আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায়। এর মধ্যে রয়েছে কর্ণফুলীর খোয়াজনগরে বেলামি টেক্সটাইল, এটিপি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, হ্যারডস গার্মেন্টস, জিএসএল এক্সপোর্ট, বেঞ্চমার্ক অ্যাপারেল। এ ছাড়াও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আনোয়ারায় কারখানা স্থাপনের জন্য কাজ করছে। চায়না স্পেসালাইজড ইকোনোমিক জোনের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইকোনোমিক জোনের রাস্তাঘাট এবং ইউলিটির জন্য ২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। তাছাড়া ১৫টি বিদেশি কোম্পানি ইতোমধ্যে এখানে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সূত্রে জানা যায়, কর্ণফুলী টানেলের কারণে মিরসরাই থেকে কক্সবাজারে নতুন কানেকটিভিটি তৈরি হবে। তাছাড়া কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ও এয়ারপোর্ট কাছে হওয়ার কারণেও ইকোনোমিক জোনের বাইরেও বিনিয়োগ হতে পারে। তাছাড়া আমরা বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগকারীদের চায়না এবং মিরসরাই ইকোনোমিক জোনে বিনিয়োগ জন্য উৎসাহিত করে থাকি। তাছাড়া ইতিপূর্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) নির্মাণাধীন কর্ণফুলী টানেলের সংযোগ সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার একটি প্রকল্পও অনুমোদন দিয়েছে। ফলে আনোয়ারা উপজেলা সংযোগ সড়কসহ কর্ণফুলী টানেল সংযোগ সড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ (শিকলবাহা-আনোয়ারা সড়ক)' প্রকল্পটির জন্য একনেক সভায় ৪০৭ কোটি ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

বঙ্গবন্ধু টানেলে টোল চলাচল ব্যবস্হাপনা:
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নবনির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের ভেতর চলতে হলে কোন গাড়িকে কত টোল দিতে হবে, তার একটি তালিকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এই তালিকা অনুযায়ী গাড়িভেদে ২০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা দিতে হবে। সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত টোলের এই হার গত ২০ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের অনুমোদন পেয়েছে। এখন তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। সেতু কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করা টোল অনুযায়ী, টানেলের মধ্য দিয়ে যেতে হলে প্রাইভেট কার, জিপ ও পিকআপকে দিতে হবে ২০০ টাকা,মাইক্রোবাসের জন্য দিতে হবে ২৫০ টাকা টোল দিতে হবে। ৩১ বা এর চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের জন্য ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। টানেল দিয়ে যেতে হলে ৫ টনের ট্রাকে ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাকে ৫০০ টাকা, ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাকে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে।ট্রেইলরের (চার এক্সেল) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০০ টাকা। চার এক্সেলের বেশি হলে প্রতি এক্সেলের জন্য দিতে হয় ২০০ টাকা করে।টানেলের ভেতরে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি চলাচলের বিষয়টি আপাতত বিবেচনায় নেই। তাই টোলের হার নির্ধারণের তালিকায় এই দুই ধরনের গাড়ির জন্য টোল আদায়ের বিষয়টি রাখা হয়নি। যদিও কর্ণফুলীর শাহ আমানত সেতুতে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য ৭৫ টাকা, জিপের জন্য ১০০ টাকা, মাইক্রোবাসের জন্য ১০০ টাকা, ৩১ বা এর চেয়ে কম আসনের বাস  এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের বাসের জন্য  যথাক্রমে ৫০ ও ১৫৫ টাকা, ৫ টনের ট্রাক, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাক ও  ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাকে যথাক্রমে ১৩০, ২০০ ও ৩০০ টাকা, ট্রেইলরের (চার এক্সেল) এর জন্য ৭৫০ টাকা টোল দিয়ে যাতায়াত করতে হয় সেক্ষেত্রে টোলের পরিমাণ নির্ধারণে সমন্বয় করার পরামর্শ  বিশেষজ্ঞদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী,  টানেল চালু হওয়ার পর ২০২৫ সালে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। এ ছাড়া ২০৩০ সালে যানবাহন চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছে  ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সালে যানবাহনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৬২ হাজার।বঙ্গবন্ধু টানেলের টোল হার সহনীয় পর্যায়ে রাখা না হলে তা ব্যবহারে চালকেরা অনাগ্রহী হবেন বলে মন্তব্য করেছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার। তিনি আরো বলেন, ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে যাওয়ার জন্য বিকল্প হিসেবে শাহ আমানত সেতু রয়েছে। তাই টানেলের টোল নির্ধারণে এই সেতুর টোল হারের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। যদি টোলের হার বেশি হয়ে যায়, তাহলে এই বিপুল বিনিয়োগে করা টানেলে প্রত্যাশিত যান চলাচল করবে না।

বঙ্গবন্ধু টানেলের সংযোগ সড়কের নকশা জটিলতা নিরসনে অগ্রাধিকার:
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধনের আগেই টানেলের দুই প্রান্তের সংযোগ সড়কের সংযোগস্থলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। এতে করে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষে চালু হলেও ত্রুটিমুক্ত ও আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রকৃত সুফল পেতে লাগবে 'বাড়তি সময়'। বর্তমান নকশায় টানেলের উত্তর প্রান্তের প্রবেশ মুখে মিলিত হয়েছে পাঁচটি সড়ক। সড়কগুলো হলো- আউটার রিং রোড, কাটগড় সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, এয়ারপোর্টমুখী সড়ক, পতেঙ্গা বিচমুখী সড়ক এবং টানেলের প্রবেশ পথ। এতে এই মোড়ে যানজটের সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছে সিএমপি। আনোয়ারা প্রান্তের বিভিন্ন সড়ক থেকে আসা যানবাহনের চাপ টানেলটি নিতে পারবে না বলেও জানিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), অথচ নতুন করে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা প্রণয়নে ২০২৩ সাল লেগে যাবে।

সিএমপি সূত্রে জানা যায়, আনোয়ারা প্রান্তে কোরিয়ান ও চায়না ইপিজেড, কর্ণফুলী সার কারখানা, পারকি সৈকতসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, বাঁশখালী ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং টেকনাফ পর্যন্ত প্রস্তাবিত নতুন মেরিন ড্রাইভ সড়কের যানবাহনের চাপ নিতে পারবে না। অথচ এই টানেল ব্যবহার করে মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণসহ টেকনাফের সাবরাংয়ে নতুন পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। তার আগপর্যন্ত বর্তমানের ত্রুটিপূর্ণ ট্রাফিক নকশার আওতাতেই টানেলের ভেতর ট্রাফিক পুলিশ দিয়ে ম্যানুয়ালি যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যা কার্যকর ব্যবস্থা হবে না বলে জানিয়েছে সিএমপি। এছাড়াও সিএমপি কমিশনারকে প্রধান করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে নতুন ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রণনয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই কমিটির আওতায় দুটি কারিগরি উপ-কমিটি গঠন করে। উপ-কমিটির মধ্যে পতেঙ্গা প্রান্তের নকশা তৈরি করবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) আর আনোয়ারা প্রান্তের নকশা করবে সেতু বিভাগ যার কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। সেখানে টানেলের দুই প্রান্তে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সুপারিশ থাকবে।

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণকাজের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ বলেন এই মাসের সম্পূর্ণ তথ্য এখনো পর্যন্ত হাতে আসেনি গত ফেব্রুয়ারী মাসের তথ্য অনুযায়ী ইতিমধ্যেই প্রায় ৯৬ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন । যান্ত্রিক স্থাপনার কাজ এখনো চলছে। এরই মধ্যে অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক আরো বলেন, ক্রস প্যাসেজ ও টানেল–সম্পর্কিত টোল প্লাজার নির্মাণকাজও প্রায় শেষের দিকে রয়েছে। টানেলের যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক ও সিভিল ওয়ার্ক চলছে এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করতে ব্যাপক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই টানেলের নির্মাণকাজ শেষ হবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।

তাছারাও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, টানেলের দুটি সুড়ঙ্গের ভেতরে রাস্তার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আবার দুটি সুড়ঙ্গের মধ্যে যোগাযোগের জন্য তিনটি ক্রস প্যাসেজ বা সংযোগ সড়কের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। টানেলের সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, দক্ষিণের কাজ শেষ হলেও উত্তর সুড়ঙ্গের (পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারামুখী) পূর্তকাজসহ টানেলের বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক (ইলেকট্রো মেকানিক্যাল) কাজ বাকি। এসব কাজ দ্রুততম সময়ে শেষ হওয়ার কথা। এছাড়া টানেলের উভয় প্রান্তে স্ক্যানার বসানোসহ সার্ভিস এরিয়া (কার্যালয়সহ আবাসিক) ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শেষে যান চলাচলের উপযোগী হবে টানেল।এখন টানেলের ভেতরে অগ্নি প্রতিরোধক বোর্ড, ডেকোরেটিভ বোর্ড স্থাপনের কাজ চলছে। এ ছাড়া সুড়ঙ্গের ভেতরে বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক কাজ চলমান। টানেলের দুই প্রান্তে ১৫ মেগাওয়াটের একটি করে দুটি সাবস্টেশন থাকবে। এখন বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক কাজগুলো চলছে অগ্রগতিও সন্তোষজনক রয়েছে। সম্পাদনা: ইস্রাফিল ফকির  

প্রতিনিধি/আইএফ 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়