এল আর বাদল :সরকারি নথি ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর বলছে, দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় ১৪ মাসে ১৩ বার বিদেশ সফর করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়াও সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টারাও নিয়মিত বিদেশ সফর করছেন। এর মধ্যে কোনো কোনো উপদেষ্টাকে 'গুরুত্বহীন' নানা অনুষ্ঠানেও তাদের অংশ নিতে দেখা গেছে বলেও সমালোচনা রয়েছে।
জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফর করে মাত্রই দেশে ফিরলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, যেই সফরে তার সঙ্গী হয়েছিলেন সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের কয়েকজন প্রতিনিধিও। --- বিবিসি বাংলা
সরকারি একটি নথিতে দেখা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এই সফরে অন্তত একশোজন তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন।
যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গেলো সপ্তাহে একটি ফেসবুক পোস্টে দাবি করেছেন, প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী ছিলেন ৬২ জন।
বিশাল বহর নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাষ্ট্র সফরের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা সমালোচনাও দেখা দেয়।
গত মাসের শেষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি জনগণের করের টাকায় বিদেশ সফরে এত বড় প্রতিনিধি দল পাঠানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিবৃতিও দেয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "আমরা ভেবেছিলাম গত বছরের চেয়ে এবার প্রতিনিধি দলের সংখ্যা আরো কমবে। কিন্তু সেটা আরো বেড়েছে"।
গত বছরের ডিসেম্বরে উপদেষ্টা কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ যাত্রা নিয়ে বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হলেও তার কিছুই মানা হচ্ছে না বলেও দাবি করছেন বিশ্লেষকরা।
সরকারের অর্থ ব্যয় করে উপদেষ্টা কিংবা কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর এবং এতে বাংলাদেশের অর্জন কতখানি তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশাল বহর নিয়ে বিদেশ সফর কিংবা উপদেষ্টা ও আমলাদের বিদেশ সফর নিয়ে নানা সমালোচনাও হয়েছিল। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন সরকার কেন একই পথে হাঁটছে সেই প্রশ্নও তুলছেন বিশ্লেষক ও সাবেক আমলাদের কেউ কেউ।
বিশাল বহর নিয়ে সফর কেন?
গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে যান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
সফর সংক্রান্ত একটি সরকারি নথিতে দেখা যায়, এই সফরে তার সঙ্গী হয়েছিলেন কয়েকজন উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, সচিব, রাজনীতিবিদ, নিরাপত্তা দল ও কর্মকর্তাসহ অন্তত একশ জন।
বিশাল বহর নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে টিআইবির বিবৃতির পর গত ২৬শে সেপ্টেম্বর নিজের ভেরিফাইড পেজে একটি পোস্ট দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
আলম লিখেন, ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে সদস্যসংখ্যা শেখ হাসিনা আমলের তুলনায় কম তো বটেই, বরং অনেক বেশি লক্ষ্যনির্ভর ও পরিশ্রমীও।
সেখানে তিনি দাবি করেন, গত বছর এই জাতিসংঘ সম্মেলনে ৫৭ জন অংশ নিয়েছিলেন। এবার এই সংখ্যা ৬২ জন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের নির্ধারিত বক্তৃতার সময় সফরসঙ্গীদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনের উপস্থিতির সুযোগ থাকে।
যে কারণে এত বিশাল সংখ্যক সফরসঙ্গী নিয়ে জাতিসংঘ অধিবেশন যোগ দেওয়ার বিষয়টির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
সাবেক সচিব আব্দুল আউয়াল মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এই সরকারের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তারা প্রত্যাশার ধারে কাছেও যেতে পারেন নাই। এখন কোনো কোনো ঘটনায় তিন চারজন একসাথে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে পিকনিকে যাচ্ছে।"
যদিও এই প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মি. আলম ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, এই বছরের প্রতিনিধি দলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই নিরাপত্তা কর্মী, যারা প্রধান উপদেষ্টাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়োজিত রয়েছে।
এছাড়াও তিনি জানিয়েছিলেন, এই বছরের প্রতিনিধি দলের মধ্যে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি রয়েছেন যারা ৩০শে সেপ্টেম্বরের রোহিঙ্গা সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
তবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রশ্ন তুলে বলেছেন, "এই যে একশোর ওপরে মানুষ গেলো। যদি এত মানুষ যেতে হয় তার যৌক্তিক ভিত্তি থাকতে হবে। তারা রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে পুরো রাষ্ট্রের স্বার্থ প্রমোট করার জন্য যাচ্ছে তাদের সুনির্দিষ্ট কার কী ভূমিকা, কীভাবে ভূমিকা পালন করছে?"
গত জুনে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। সেই সফরে বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সাথে বৈঠকও করেন অধ্যাপক ইউনূস। সেবারও তিনি বড় প্রতিনিধি দল নিয়ে গিয়েছিলেন বলে আলোচনা হয়েছিল।
ওই সফরে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সম্ভাব্য বৈঠকের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তা না হওয়ায় এ নিয়ে নানা সমালোচনাও দেখা যায়।
উপদেষ্টাদের ঘনঘন বিদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে প্রায় ১৪ মাস হলো। এই সময়ে সরকারের উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীসহ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা তৈরি হতে দেখা গেছে।
এ বছরের অগাস্ট ও সেপ্টেম্বরে দুই দফায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর করেছেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। এসব জায়গায় বেশিরভাগই ছিল বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত অনুষ্ঠান।
আরেক ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও গত এক বছরে অন্তত তিন বার বিদেশ সফর করতে দেখা গেছে। গত বছরের অক্টোবরে সুংযুক্ত আরব আমিরাত, নভেম্বরে সুইজারল্যান্ড, চলতি বছরের জুনে মরক্কো সফরে যান।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য দুইজন ছাত্র উপদেষ্টার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের উদাহরণ টেনে বিবিসি বাংলাকে বলেন, এই সংস্কৃতি ছিল বিগত সরকারের আমলে। আগে আওয়ামী লীগের সময়ে যা হয়েছে এখনো কেন সেই ধারাবাহিকতা দেখা যাবে?
সরকারি নথিপত্রে দেখা গেছে, উপদেষ্টা কিংবা আমলারা গত এক বছরে বিভিন্ন সময়ে যে বিদেশ সফর করছেন তার মধ্যে অনেক সফরের গুরুত্ব কতখানি তা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে।
সাবেক সচিব আব্দুল আউয়াল মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, "বিদেশ সফরের নামে আমাদের দেশে নৈরাজ্য চলে। এখানে কোনো নিয়মনীতি নাই। বিবেকের দায় নেই। সুযোগ পেলেই বিদেশ যায়, অর্থের অপচয় হয়, কাজের ক্ষতি হয়। এটা একটা নেশার মতো হয়ে যায়।"
তিনি বলছিলেন, বর্তমান সরকার জুলাই-অগাস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন সরকার। এই সরকার অতীতের নিয়মের পরিবর্তন আনতে পারেনি। বরং তাদের সেই পথেই হাঁটছে।
নিজেদের নির্দেশনা মানছে সরকার?
গত বছরের অগাস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ডিসেম্বরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিদেশ ভ্রমণ সংক্রান্ত ১৩ দফা বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়।
সেখানে বিদেশ সফরে নিরুৎসাহিত করাসহ একই অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা ও সচিবের বিদেশ ভ্রমণ পরিহার করতেও বলা হয়েছিল। কিন্তু সে সব নির্দেশনা কতটুকুই বা মানা হচ্ছে?
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়ার সইয়ে এই নির্দেশনা জারি করা হয়।
ওই ১৩ দফা নির্দেশনায় সাধারণভাবে বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা, বছরের সম্ভাব্য বিদেশ ভ্রমণের একটি তালিকা জানিয়ে রাখা, বিদেশ ভ্রমণের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ডেটাবেজ তৈরি করা (প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এর কাঠামো তৈরি করে দেবে এবং এর তথ্য সংরক্ষণ করবে), সব স্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের একাধারে বিদেশ ভ্রমণ পরিহার করা, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও সচিব একসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ সাধারণভাবে পরিহার করতে হবে।
এছাড়াও জাতীয় স্বার্থে অনুরূপ ভ্রমণ একান্ত অপরিহার্য হলে তেমন অপরিহার্যতার বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অধীন অধিদপ্তর বা সংস্থা প্রধানেরা একান্ত অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থ ছাড়া একসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণে যাবে না বলেও নির্দেশনায় বলা হয়েছিল।
অন্যদিকে, বিদেশে অনুষ্ঠেয় সেমিনার বা কর্মশালা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের জন্য উপদেষ্টা ও সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণের প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আমন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ থেকে কোন পর্যায়ের কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং অপরাপর অংশগ্রহণকারী দেশ থেকে কোন পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাতে অংশ নিচ্ছেন, সেই তথ্যও যুক্ত করতে বলা হয়েছিল সরকারের নির্দেশনায়।
কিন্তু এ নির্দেশনা কতখানি মানা হচ্ছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক আমলা ও বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
সাবেক সচিব আব্দুল আউয়াল মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, "বিদেশ যাত্রা নিয়ে সরকারের নিজের নির্দেশনা সেটি প্রতিপালিত হচ্ছে না কারণ হচ্ছে সরকার নিজেই ব্যর্থ। সরকার নিজেরা নির্দেশনা দিয়ে নিজেরাই সেটি ভঙ্গ করছে।
প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে সার্কুলার হয়, সেই নিয়ম তারাই ভাঙেন। তাহলে এরকম সার্কুলার হওয়ার দরকার নাই। সার্কুলার জারি হলে সেই নীতি ভাঙলে সরকারের ইমেজ নষ্ট হয়। বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়," যোগ করেন মি. মজুমদার।