শিরোনাম
◈ বাংলাদেশের পুলিশ কি কার্যকর হয়ে উঠছে? ◈ শীর্ষক শিরোনাম: সংকটময় মোড়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত: ডিসিসিআই ◈ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো বায়োলজিক্যাল যুবক: সৌদি অধ্যাপকের দাবি ◈ ট্রায়া‌লের জা‌র্সিতে ভুল লোগো, বিতর্কে ফুটবল ফেডা‌রেশন ◈ শিগগিরই জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের বিদ্যুৎ ◈ এনবিআরের অচলাবস্থা নিরসনে জরুরি হস্তক্ষেপ চান ব্যবসায়ীরা ◈ সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন মেনে নেবে না জাতি: গোলাম পরওয়ার ◈ এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র চত্বরে প্রবেশে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ◈ তরুণ তারকা ফুটবলার ইয়ামাল জম্ম‌দি‌নেই পা‌চ্ছেন মেসির ১০ নম্বর জার্সি ◈ সংবিধান নিয়ে কঠোর অবস্থানে ইসলামী আন্দোলন: পিআর ছাড়া নির্বাচন নয়

প্রকাশিত : ২৮ জুন, ২০২৫, ০২:১৩ দুপুর
আপডেট : ২৮ জুন, ২০২৫, ০৯:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

দুবাই যখন প্রায় ভারতের অংশ হয়ে গিয়েছিল 

১৯৫৬ সালের শীতকাল- দ্য টাইমসের সংবাদদাতা ডেভিড হোল্ডেন বাহরাইন দ্বীপে এসে নেমেছিলেন। তখন বাহরাইন ছিল একটি 'ব্রিটিশ প্রোটেক্টরেট'। 'প্রোটেক্টরেট' ব্যবস্থা হলো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্বাধীনতা থাকলেও বহির্দেশীয় সম্পর্ক এবং শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য শক্তিশালী যুক্তরাজ্যের ওপরেই নির্ভর করতে হতো মধ্য প্রাচ্যের এই দ্বীপটিকে।

হোল্ডেন একসময়ে ছিলেন ভূগোলের শিক্ষক। তারপরেই অনেক আশা নিয়ে এই আরব দেশটিতে চাকরি নিয়ে চলে আসা তার। তবে ভারত সম্রাজ্ঞী রাণী ভিক্টোরিয়ার সম্মানে আয়োজিত এক 'দরবার'-এ অংশ নিতে পারবেন, এতটাও আশা করেননি তিনি।

উপসাগরীয় অঞ্চলে যেখানেই গেছেন তিনি, সে দুবাই হোক বা আবুধাবি অথবা ওমান– সব জায়গাতেই ব্রিটিশ ভারতের ছাপ খুঁজে পেয়েছেন ডেভিড হোল্ডেন।  

তিনি লিখেছিলেন, ব্রিটিশ রাজ এখানে কিছুটা আধিভৌতিক দোলাচলের একটা পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। এমন একটা পরিবেশ, যেখানে অসঙ্গতিও যেমন আছে, তেমনই রয়েছে ফেলে আসা সময়কে ধরে রাখার একটা প্রচেষ্টা…সার্ভেন্টদের এখানে বেয়ারা বলা হয়, লন্ড্রিম্যানদের ডাকা হয় ধোবি বলে আর ওয়াচম্যানরা হলেন চৌকিদার। 

ব্রিটিশ ভারতের প্রাচীন প্রথা মেনে রবিবারগুলোয় দুপুরের ভোজে অতিথিদের সামনে হাজির করা হয় পাহাড় প্রমাণ ভারতীয় কারি, লিখেছিলেন হোল্ডেন।

ওমানের সুলতান পড়াশোনা করেছেন ভারতের রাজস্থানে। তিনি আরবিতে যতটা না স্বচ্ছন্দ, তার থেকে উর্দু অনেক ভালো বলতে পারতেন। তার সৈন্যরা আসতেন 'কুয়াইতি' প্রদেশ থেকে, যে অঞ্চল এখন পূর্ব ইয়েমেন। তাদের সাজ ছিল অধুনালুপ্ত হায়দ্রাবাদের সেনাবাহিনীর মতো।

অ্যাডেনের গভর্নর নিজে লিখেছিলেন, এখানে এলে যে কারোরই দৃঢ় ধারণা হবে যে, এখানকার ঘড়িগুলো বোধহয় ৭০ বছর আগেই থেমে গেছে; সেই সময়ে ব্রিটিশ রাজের সোনালী যুগ, সিংহাসনে ভিক্টোরিয়া, তখন একদম নতুন আর বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার আরেক নাম হয়ে উঠেছেন (ব্রিটেনের দুই নাট্য ব্যক্তিত্ব) গিলবার্ট আর সালেভান জুটি, কিপলিং ভাঙছেন একের পর এক প্রচলিত বিশ্বাস। - দিল্লি থেকে হায়দ্রাবাদ হয়ে দক্ষিণ আরবের উপকূলের সংযোগ এতটাই জোরালো ছিল। 

অনেক আরব দেশই ছিল ব্রিটিশ ভারতের অধীন

এখন হয়ত অনেকেই ভুলে গেছেন যে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আরব উপদ্বীপের এক-তৃতীয়াংশই ব্রিটিশ ভারত সাম্রাজ্যের শাসনাধীন ছিল। 

অ্যাডেন থেকে কুয়েত পর্যন্ত ছিল একের পর এক 'প্রোটেক্টরেট'। সবগুলোই ছিল দিল্লির শাসনাধীন, তদারকি করতেন 'ইন্ডিয়ান পলিটিকাল সার্ভিসের অফিসারেরা, আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে ছিল ভারতীয় বাহিনী আর জবাবদিহি করতে হত ভারতের বড়লাটের কাছে।

'ইন্টারপ্রেটেশন অ্যাক্ট, ১৮৮৯' অনুযায়ী এই সব 'প্রোটেক্টরেট' আইনতই ভারতের অংশ বলে ধরা হত।

জয়পুরের মতো আধা-স্বাধীন ভারতীয় দেশীয় রাজ্যগুলোর যে বর্ণানুক্রমিক তালিকা ছিল, তার প্রথম নামটিই ছিল আবু ধাবির। লর্ড কার্জন যখন বড়লাট ছিলেন, সেই সময়ে তো তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন, "কেলাত প্রদেশ (বর্তমানের বালোচিস্তান) বা লুস বেলার মতো ওমানকে ভারতীয় সাম্রাজ্যের একটি দেশীয় প্রদেশ হিসাবে গণ্য করা হোক।"

পশ্চিম দিকে বর্তমানের ইয়েমেনের অ্যাডেন পর্যন্ত ভারতীয় পাসপোর্ট দেওয়া হত। অ্যাডেনই তখন ছিল ভারতের পশ্চিম প্রান্তের শেষ বন্দর। বম্বে প্রদেশের অধীন ছিল এই বন্দর শহর। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী যখন ওই শহরে গিয়েছিলেন ১৯৩১ সালে, সেখানে অনেক তরুণ আরব নিজেদের ভারতীয় জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচয় দিতেন।

যুক্তরাজ্য বা ভারতের জনসাধারণের মধ্যে খুব কম মানুষই তখন জানতেন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আরব অঞ্চলেও বিস্তার ঘটিয়েছে।

ভারতীয় সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ মানচিত্র খুবই গোপনে প্রকাশ করা হত। প্রথমের দিকে তুরস্ক আর পরে সৌদি আরব যাতে কোনো রকম ইন্ধন না পেয়ে যায়, সেজন্য আরব এলাকাগুলোর ব্যাপারে কোনো নথিও জনসমক্ষে আনা হত না।
 
'র‍য়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি'র এক ভাষণে একজন বলেছিলেন, একজন ঈর্ষাকাতর শিখ যেমন তার প্রিয় পত্নীকে পর্দার আড়াল করে রাখেন, তেমনই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাজকর্ম এতটাই রহস্যে মোড়া ছিল যে কেউ যদি দুরভিসন্ধি নিয়ে এমন কিছু প্রচার করার চেষ্টা করত যে ওখানে ভয়াবহ কিছু একটা হচ্ছে, তার কথা বিশ্বাস করানো কঠিন হত।

১৯৪৭-এই ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয় আরব অঞ্চল

তবে ১৯২০ নাগাদ রাজনীতি বদলাতে থাকে। ভারতের জাতীয়তাবাদীরা তাদের দেশটিকে সাম্রাজ্যবাদীদের গড়া কোনো দেশ নয়, বরং মহাভারতে যে ভৌগলিক অবস্থানের কথা বলা হয়েছে, তার ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটা সাংস্কৃতিক পরিসরের কল্পনা করতে শুরু করেছিলেন। লন্ডনও দেখল যে সীমানা নতুন করে আঁকার সুযোগ এসেছে। অ্যাডেনকে ১৯৩৭ সালের পয়লা এপ্রিল ভারতের থেকে পৃথক করার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল বিভক্তি। এর পর বেশ কয়েকটি বিভক্তি।

রাজা ষষ্ঠ জর্জের একটা টেলিগ্রাম জোর গলায় পড়ে শোনানো হয়েছিল:

"প্রায় ১০০ বছর ধরে ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল অ্যাডেন। আমার ভারতীয় সাম্রাজ্যের থেকে অ্যাডেনের রাজনৈতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে সেটি এখন আমার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে।" 

তবে উপসাগরীয় অঞ্চল আরও এক দশক পর পর্যন্ত ভারত সরকারের অধীন ছিল। 

স্বাধীনতার পরে ভারত না পাকিস্তান– কোন দেশকে পারস্য উপসাগর চালাতে দেওয়া হবে, তা নিয়ে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা সামান্য কিছু আলোচনা করেছিলেন। তেহরানে ব্রিটিশ প্রতিনিধি দলের এক সদস্য তো বিস্মিত হয়ে লিখেছিলেন, "দিল্লির কর্মকর্তারা সম্ভবত ঐকমত্যে পৌঁছিয়েছেন যে পারস্য উপসাগর নিয়ে ভারত সরকার আগ্রহী নয়।"

উপসাগরীয় অঞ্চলের এক বাসিন্দা উইলিয়াম হে লিখেছিলেন, উপসাগরের আরবদের সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব ভারতীয় বা পাকিস্তানিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া স্পষ্টতই অনুচিত হবে।

ব্রিটিশ রাজ ভেঙ্গে ভারত আর পাকিস্তানের স্বাধীনতার মাত্রই কয়েক মাস আগে, পয়লা এপ্রিল ১৯৪৭ সালে দুবাই থেকে শুরু করে কুয়েত পর্যন্ত উপসাগরীয় রাজ্যগুলো অবশেষে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল।

আরও সময় পরে, যখন ভারতীয় আর পাকিস্তানী কর্মকর্তারা কয়েকশো দেশীয় রাজ্যকে তাদের সদ্য গঠিত নিজ নিজ রাষ্ট্রে সংযুক্ত করার কাজ শুরু করছেন, তখন কিন্তু সেই তালিকায় উপসাগরীয় রাজ্যগুলো আর নেই।

খুব কম মানুষই বিস্মিত হয়েছিলেন এবং ৭৫ বছর পরেও যে ভারত অথবা উপসাগরীয় অঞ্চলে ওই ঘটনার গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করা গেছে, তা নয়। 

ভারতীয় সাম্রাজ্যের শেষ উপনিবেশ

তখন ওই ছোট একটা প্রশাসনিক হাতবদল না হলে খুব সম্ভব ছিল যে 'পার্সিয়ান গাল্ফ রেসিডেন্সি' ভারত বা পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরে যে কোনো একটি দেশের সঙ্গে সংযুক্ত হত, যেভাবে উপমহাদেশের প্রতিটি দেশীয় রাজ্যই জুড়ে গিয়েছিল দুটির মধ্যে কোনো একটি দেশের সঙ্গে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি যখন ভারত থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার কথা ঘোষণার সঙ্গে আরব অঞ্চল থেকেও সরে আসার প্রস্তাব দিলেন, তখন থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

তাই যুক্তরাজ্য আরও ২৪ বছর উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের একই ভূমিকা পালন করে গেছে। তবে আগে যেমন ভারতের বড়লাটের অধীন ছিল তারা, 'আরব রাজ' তখন সরাসরি চলে যায় হোয়াইটহলের অধীনে।

উপসাগরীয় অঞ্চলের বিশেষজ্ঞ পল রিচের কথায়, গোয়া যেমন পর্তুগিজদের শেষ একমাত্র বসতি ছিল, বা ফরাসি-ভারতের শেষ এলাকা ছিল পন্ডিচেরি, তেমনই ভারতীয় সাম্রাজ্যের শেষ উপনিবেশ ছিল এই উপসাগরীয় অঞ্চল।

তবে শেষ দিকেও সেখানে সরকারি নোট বলতে ভারতীয় টাকা আর সহজতম যাতায়াতের জন্য ছিল 'ব্রিটিশ ইন্ডিয়া লাইন' জাহাজ কোম্পানি এবং ৩০টি আরব রাজন্য-শাসিত রাজ্য পরিচালিত হত 'ব্রিটিশ রেসিডেন্ট'দের দ্বারা।

এরা সবাই ছিলেন ইন্ডিয়ান পলিটিকাল সার্ভিস-এর অফিসার।

সুয়েজের পূর্বদিকের সব ঔপনিবেশিক দায়-দায়িত্ব থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তের অধীনেই শেষমেশ ১৯৭১ সালে ব্রিটিশরা উপসাগর থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যায়।

সেবছর জুলাই মাসে ডেভিড হোল্ডেন লিখেছিলেন: "ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বর্ণযুগের সময় থেকে এই প্রথমবার উপসাগরের সব এলাকাই ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপের হুমকি ছাড়া নিজেরাই নিজেদের জীবনধারণের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। একই সঙ্গে ব্রিটিশদের সুরক্ষায় নিজেদের তারা যে নিরাপদ মনে করত, সেই সুবিধাও অবশ্য তাদের আর থাকবে না।

ব্রিটিশ রাজের শেষ অবশিষ্ট যা ছিল – বেশ কিছু বছর ধরেই এটা অবশ্যম্ভাবীই ছিল, যদিও কোনো দিক থেকে দেখতে গেলে মনোমুগ্ধকর, ফেলে আসা সময়কে ধরে রাখার একটা প্রচেষ্টা… … তবে এখন সত্যিই শেষ।"  উৎস: বিবিসি বাংলা

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়