জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পেহেলগামে সম্প্রতি এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারান ২৬ জন। পাকিস্তান এই হামলা চালিয়েছে বলে বরাবরই দাবি করে আসছিল ভারত। অবশেষে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলোর ওপর ‘অপারেশন সিঁন্দুর’ নামে অভিযান পরিচালনা করে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী।
ভারতের হামলার জবাবে পাল্টা হামলা চালায় পাকিস্তানও। দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ জনে। তবে ভারত দাবি করেছে, হামলায় পাকিস্তানের ৭০ জঙ্গি নিহত হয়েছে।
'অপারেশন সিঁন্দুর’ নামকরণের তাৎপর্য
এই অভিযানের মাধ্যমে কাশ্মীর উপত্যকায় সীমান্তপারের জঙ্গি ঘাঁটিতে আঘাত হানে ভারতীয় সেনাবাহিনী। শুধু সেনা কৌশল নয়, অভিযানের নামেও স্পষ্ট প্রতীকী বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
সরকারি সূত্রের বরাতে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই অভিযানের নাম দিয়েছেন ‘অপারেশন সিঁন্দুর’। নামটির পেছনে রয়েছে গভীর আবেগ, প্রতিশোধ ও প্রতীকী অর্থ। হিন্দু সংস্কৃতিতে সিঁন্দুর বিবাহিত নারীর সৌভাগ্যের প্রতীক। পহেলগামে যে ২৬ জন নিরীহ মানুষকে নিশানা করে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন নবদম্পতি। অনেক নারী চোখের সামনে হারিয়েছেন তাদের স্বামীকে।
অভিযানটির প্রতীকী ব্যাখ্যাও উঠে এসেছে সেনাবাহিনীর প্রকাশিত একটি পোস্টারে—সেখানে সিঁন্দুর এর ইংরেজি বানানের একটি স্থানে রয়েছে সিঁন্দুরের বাটির চিত্র। বাটির পাশে ছড়িয়ে পড়া লাল গুঁড়ো যেন একেকজন বিধবার ছিটকে পড়া সিঁন্দুর, একেকটি বিধ্বস্ত সংসার। পোস্টারের নিচে লেখা “ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জয় হিন্দ।”
পাকিস্তানের যেসব স্থানে হামলা হয়েছে
পাকিস্তানের সেনা মুখপাত্র লেফটেনান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী জানিয়েছেন যে ভারত তার দেশের ছয়টি জায়গায় ২৪টি স্থাপনায় বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ভাওয়ালপুরের আহমেদপুর শারকিয়া, মুরদিক, শিয়ালকোট এবং শকরগড় ও পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের কোটলি ও মুজফফরাবাদে এইসব হামলা হয়েছে।
আহমদপুর শারকিয়া (ভাওয়ালপুর)- পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের আহমদপুর শারকিয়া একটি ঐতিহাসিক শহর। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর দাবি এই শহরের শুভান মসজিদে চারটি হামলা হয়েছে। এই হামলায় একটি তিন বছরের শিশু কন্যাসহ পাঁচজন মারা গেছেন এবং ৩১ জন আহত হয়েছেন বলে তিনি দাবি করেছেন।
মুরিদকে- পাকিস্তানের পাঞ্জাবের শেখুপুরা জেলার মুরিদকে লাহোর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। জামাত-উদ-দাউদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন দাওয়া ওয়া আল ইরশাদের কেন্দ্র এই শহরটি। সেনা মুখপাত্র বলছেন মুরদিকের উম-আল-কারা মসজিদ এবং তার আশপাশের এলাকাকে লক্ষ্য করে ভারতীয় হামলা হয়েছে যাতে একজন নিহত হয়েছেন এবং দুজন নিখোঁজ রয়েছেন।
মুজফফরাবাদ- পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজফফরাবাদের বিলাল মসজিদে হামলা হয়েছে বলে দাবি করেছেন পাকিস্তানের সেনা মুখপাত্র। ওই শহরে বিবিসির সংবাদদাতা তাবান্দা কোবাব জানান, যে অঞ্চলে হামলা হয়েছে, সেখান থেকে মানুষজন পালাচ্ছেন। রাস্তায় গাড়ির লম্বা লাইন পড়ে গেছে।
কোটলি- নিয়ন্ত্রণ রেখার খুব কাছে অবস্থিত কোটলিতে যে হামলা হয়েছে ততে একটি ১৬ বছর বয়সী শিশু কন্যা এবং একজন ১৮ বছর বয়সী কিশোর মারা গেছে। দুজন নারীও আহত হয়েছেন ওই হামলায়।
শিয়ালকোট- ভারত-শাসিত কাশ্মীরের জম্মু অঞ্চল থেকে মাত্র ৪৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিয়ালকোটে দুটি গোলা এসে পড়েছে বলে পাক সেনা মুখপাত্রের দাবি। তার কথায়, কোটলি লোহারাণে এসে পড়া ওই দুটি গোলার একটি বিস্ফোরিত হয়নি। এখানে কেউ হতাহত হননি।
শকরগড়- পাঞ্জাব প্রদেশের শকরগড় একটি তহশিল শহর। ভারতীয় পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর এবং জম্মুর খুব কাছেই অবস্থিত এই শহরটি। দুটি ভারতীয় গোলা এই শহরে ছোঁড়া হয়েছিল। একটি চিকিৎসা কেন্দ্রে সামান্য কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের সেনা মুখপাত্র।
তবে ভারত সরকার দাবি করেছে যে তারা নয়টি জায়গায় হামলা চালিয়েছে, এবং কোনও ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের সামরিক স্থাপনা তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল না। ক্ষেপণাস্ত্র হামলাগুলো মুজাফফরাবাদ, কোটলি, বাহাওয়ালপুর, রাওয়ালকোট, চকস্বরী, ভিম্বার, নীলুম উপত্যকা, ঝিলাম এবং চকওয়ালে স্থাপনাগুলিকে লক্ষ্য করে করা হয়েছিল, এই সমস্ত এলাকাগুলোকে গোয়েন্দা সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী শিবির স্থাপনের জন্য সন্দেহ করেছিল।
সময়কাল
এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের স্থানীয় সময় বুধবার রাত ১টা ৫ মিনিটে সামরিক হামলা চালানো হয়। হামলা চলে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী যৌথভাবে অপারেশন সিঁন্দুর নামে এই হামলা চালিয়েছে।
হামলার বর্ণনা
ভারতের কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ভূমিকা সিং সংবাদ সম্মেলনে জানান, পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর এবং পাকিস্তান মিলিয়ে মোট নয়টি জঙ্গি ঘাঁটিকে নিশানা করা হয়েছে এই অভিযানে। সেগুলোকে পুরো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদকে মদত দিচ্ছে।
পাকিস্তানের ভাওয়ালপুরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সৃষ্ট আগুনের শিখা
সামরিক বাহিনীর দুই অফিসার জানান, প্রথমে হামলা চালানো হয়েছিল শুভান আল্লাহ মসজিদে। সন্ত্রাসী স্থান মারকাজ শুভান আল্লাহ বাহাওয়ালপুরে অবস্থিত। এটি জইশ-ই-মোহাম্মদের সদর দপ্তর। ২৬/১১ মুম্বাই হামলার জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এখান থেকেই। এরপর মুরদিকেতে বিলাল মসজিদে ছিল জইশ-ই-মুহম্মদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র, কোটলির মসজিদে লস্করের ঘাঁটিতে অভিযান চালিয়েছে ভারত। এর মধ্যে মুরদিকে ঘাটিতে অজমল কাসাব এবং ডেভিড হেডলি প্রশিক্ষণ পেয়েছিল বলে জানান কর্নেল সোফিয়া।
যেসব অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছে
হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত এই অভিযানে উচ্চ-নির্ভুলতা এবং দীর্ঘ-পাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হ্যামার বোমা, স্ক্যাল্প ক্রুজ মিসাইল এবং লয়টারিং মিউনিশন।
হ্যামার স্মার্ট বোমা শক্তিশালী পরিকাঠামো যেমন রিইনফোর্সড বাঙ্কার এবং লস্কর-ই-তৈবা ও জৈশ-ই-মুহাম্মদের প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত বহুতল ভবন ধ্বংস করতে ব্যবহৃত হয়েছে। এই নির্ভুল-নির্দেশিত, স্ট্যান্ডঅফ মিউনিশনটি লঞ্চের উচ্চতার ওপর নির্ভর করে ৫০-৭০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
অন্যদিকে, স্ক্যাল্প একটি দীর্ঘ-পাল্লার, বায়ু থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্রুজ মিসাইল। এর পরিসীমা ২৫০ কিলোমিটারের বেশি এবং এটি গভীর হামলার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এর মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য অস্ত্র হল লয়টারিং মিউনিশন। মূলত লুকিয়ে নজরদারি চালানোর জন্য, কোথায় জঙ্গি ঘাঁটি রয়েছে, তাতে কী কী রয়েছে বা কারা-কতজন রয়েছে, তা জানতে এই যন্ত্র ব্যবহার করে সেনাবাহিনী। ড্রোনের মাধ্যমে ফুটেজ দেখে হামলার নির্দিষ্ট ছক করতে সক্ষম হয় ভারতীয় সেনা।
পেহেলগামে হামলার সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা প্রথম থেকেই অস্বীকার করে আসছে পাকিস্তান। তারা নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে। আমেরিকা, চিন, রাশিয়া-সহ বিভিন্ন দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনীতির মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের বার্তা দিয়েছিল। কিন্তু মোদি সেনাবাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিলেন। তার পর ১৫ দিনের মাথায় ভারত পাকিস্তানে হামলা চালায়।