শিরোনাম
◈ পঞ্চম টি-টো‌য়ে‌ন্টি পরিত্যক্ত হওয়ায় অ‌স্ট্রেলিয়ার বিরু‌দ্ধে সিরিজ জিতলো ভারত   ◈ ভোটের নিরাপত্তা পরিকল্পনা: রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে সাজানো হবে দেশ ◈ শিক্ষকদের আন্দোলন যৌক্তিক নয়, ১৩ থেকে ১০ম গ্রেডে আনার যুক্তি নেই: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ◈ জামায়াতসহ ৮ দলের কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি ◈ প্রাথমিক শিক্ষকদের অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি ঘোষণা ◈ অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েও যে কারণে সাধারণ জীবনে ইলন মাস্ক, এত সম্পদ দিয়ে কী করেন? ◈ কারও দলীয় স্বার্থ বাস্তবায়ন অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়: তারেক রহমান ◈ যুক্তরাষ্ট্রে শত শত ফ্লাইট বাতিল, যাত্রীদের চরম ভোগান্তি ◈ কিছু দল জোরপূর্বক দাবি আদায় করতে চায় : আমীর খসরু ◈ ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করলে জনগণই প্রতিরোধ করবে: আইজিপি

প্রকাশিত : ০৮ নভেম্বর, ২০২৫, ১০:৫০ দুপুর
আপডেট : ০৮ নভেম্বর, ২০২৫, ০৯:১২ রাত

প্রতিবেদক : এল আর বাদল

কয়েকশ কারখানা বন্ধ ও লাখো শ্রমিক বেকার, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগের

এল আর বাদল : বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করছেন উদ্যোক্তারা৷ কয়েকশ কারখানা বন্ধ ও লাখো শ্রমিক বেকার হয়েছেন বলে তথ্য দিচ্ছেন তারা৷ তবে রপ্তানির পরিসংখ্যানে পরিস্থিতি ততটা খারাপ দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা৷

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধের খবর পাওয়া গেছে৷ ফলে চাকরি হারাচ্ছেন সেসব কারখানার শ্রমিকেরা৷ আগের মাসগুলোর প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় থাকলেও টানা তিন মাস ধরে রপ্তানিতে নেতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ এর মধ্যে বিমানবন্দরের কার্গো হাউজের আগুনে পুড়ে ৫১৬টি কারখানার ১০০ কোটি টাকার বেশি মালামাল পুড়েছে বলে দাবি করেছেন পোশাক শিল্পের মালিকেরা৷ ---- ড‌য়ে‌চে‌ভে‌লে

পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র সভাপতি মাহমুদ হাসান বাবু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আসলে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি৷ একেবারে যে খুব খারাপ অবস্থায় চলে গেছি, বিষয়টি এমন না৷ তবে এই ১৪ মাসে আরও ভালো করার সুযোগ ছিল৷ বিশেষ করে চীন ও ভারতের উপর যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে আমরা বেশ কিছু সুবিধা পেতে পারতাম৷ কিন্তু সেই সুযোগ আমরা হাতছাড়া করেছি৷ 

বিশেষ করে এক ধরনের অভিভাবকশূন্য অবস্থায় আমরা আছি৷ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমরা বারবার চিঠি দিয়েছি, কিন্তু সেখান থেকে কোন সদুত্তর বা দেখা করার সুযোগ পাইনি৷

তবে এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, কয়েকদিন আগেও প্রধান উপদেষ্টার সামনে তিনি বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন৷ এ প্রসঙ্গে মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘‘প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব একটি দায়িত্বশীল পদ৷ তিনি আমার কথা না বুঝে যেটা বলেছেন সেটা ঠিক হয়নি৷ আমি বলেছি, নবনির্বাচিত বিজিএমইএর কমিটি নিয়ে দেখা করার সুযোগ চেয়েও পাইনি৷ উনি উল্টোটা বুঝেছেন৷''

তবে কিছু কারখানা বন্ধ হওয়াকে খারাপ কিছু নয় বলে মনে করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম৷ কয়েকদিন আগে তিনি বলেছেন, ‘‘নন-কমপ্লায়েন্স কারখানা বন্ধ হওয়া খারাপ কিছু নয়৷ এটি শিল্পের সুষ্ঠু ও টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ৷

৩৫৩ কারখানা বন্ধ, বেকার সোয়া লাখ শ্রমিক: বিজিএমইএ'র তথ্য

তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্প, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান ভিত্তি ও কর্মসংস্থানের অন্যতম বড় উৎস৷ খাত সংশ্লিষ্টদের হিসাবে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ সরাসরি এবং আরও প্রায় দুই কোটি মানুষ পরোক্ষভাবে এই খাতের ওপর নির্ভরশীল৷ বিজিএমইএ-এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে মোট ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন৷

সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে সাভারে, যেখানে ২১৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, এর মধ্যে ১২২টি স্থায়ীভাবে এবং ৯২টি অস্থায়ীভাবে৷ প্রায় ৩১ হাজার শ্রমিক এখানে কাজ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ছেইন অ্যাপারেলস, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন ও সাফওয়ান আউটারওয়্যারের মতো বড় কারখানাও রয়েছে৷ গাজীপুরে ৭২টি কারখানা বন্ধ হয়ে ৭৩ হাজারেরও বেশি শ্রমিক বেকার হয়েছেন, যেখানে বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়া বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে৷

বিজিএমএমইএ'র সাবেক সহ-সভাপতি এ বি এম শামসুদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যদি সত্যি কথা বলি, তাহলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকেরা ভালো নেই৷ নির্বাচিত সরকারের দিকে চেয়ে বসে আছে বায়াররা৷ ছোট ফ্যাক্টরিগুলো টিকতে পারছে না৷ তারা বন্ধ করে চলে যাচ্ছে৷ এর মধ্যে সরকার শ্রম আইন সংশোধন করে আরেক বিপদ তৈরি করেছে৷ আসলে এখানে আমাদের কোনো অভিভাবক নেই৷ এতিমের মতো টিকে আছে সেক্টরটি৷

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আখতার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তো শ্রমিকরাও অংশ নিয়েছিলেন৷ 

বৈষম্য নিরসনের যে দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল, সেটা নিরসন হয়নি৷ উল্টো কাজ হারিয়ে শ্রমিকেরা বেকার হয়ে যাচ্ছেন৷ শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না৷ শ্রমিকেরা যে কাতারে ছিলেন সেই কাতারেই রয়ে গেছেন৷ যারা বেকার হয়েছেন তাদের সংসার কোনভাবেই চলছে না৷ নতুন কিছু গার্মেন্টস হলেও সেখানে তো সবার কর্মসংস্থান হচ্ছে না৷

কার্গো ভিলেজে আগুন: ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি

সর্বশেষ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডে ৫১৬ পোশাক কারখানার প্রায় ১০০ কোটি টাকার স্যাম্পল বা নমুনা পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ৷ এতে সরবরাহ চেইন ব্যাহত হওয়ার ফলে রপ্তানি কার্যক্রম অন্তত এক মাস পিছিয়ে পড়তে পারে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সংগঠনটি৷

প্রত্যক্ষ এ ক্ষতির বাইরে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার কম নয় বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়৷ এর আগে গত ১৮ অক্টোবর কার্গো ভিলেজে দুর্ঘটনার পরপরই সদস্য কারখানার ক্ষয়ক্ষতির তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় বিজিএমইএ৷ শেষ পর্যন্ত ৫১৬টি কারখানা তাদের ক্ষয়ক্ষতির এসব তথ্য জানিয়েছে৷ এতে দেখা যায়, ৫১৬ কারখানার সম্মিলিত ক্ষতির পরিমাণ ৮০ লাখ ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৯৬ কোটি টাকা৷

রপ্তানির পরিসংখ্যান যা বলছে

পোশাক খাত দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস৷ সাম্প্রতিক এই সংকট শুধু শিল্প মালিকদের নয়, বরং সার্বিক অর্থনীতির ওপরও গুরুতর প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক৷ তিনি বলেন, ‘‘অ্যামেরিকার বাজারে মন্দা, চাহিদা কম এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে রপ্তানি কমছে৷ অনিশ্চয়তার মধ্যে বড় ক্রেতারা কার্যাদেশ দেবে না৷ এখন নির্বাচিত সরকার এলে হয়ত পরিস্থিতি বদলাতে পারে৷''

সর্বশেষ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী নতুন অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ জুলাই মাসে দেশের সার্বিক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়েছিল৷ এরপর টানা তিনমাস ধরে নেতিবাচক ধারা চলছে৷ সবশেষ অক্টোবরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে সাত শতাংশেরও বেশি৷ এতে দেখা যায়, রপ্তানি কম হয়েছে ৫১ কোটি ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ছয় হাজার ১২০ কোটি টাকার মতো৷ 

গত বছরের অক্টোবরে রপ্তানি হয় ৪১৩ কোটি ডলারের পণ্য৷ এবছরের অক্টোবরে তা ৩৬২ কোটি ডলারে নেমে এসেছে৷ কিন্তু সার্বিকভাবে অর্থবছরের প্রথম চার মাসের হিসাবে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে৷ চলতি বছরের হিসাবে তা আরো বেশি৷

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. গোলাম মোয়াজ্জেম অবশ্য মনে করেন মালিকরা যতটা খারাপ বলছেন পরিস্থিতি ততটা খারাপ নয়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘গার্মেন্টস মালিকরা যা বলছেন তার সঙ্গে কিন্তু রপ্তানি সূচক মিলছে না৷ মালিকরা বলছেন, গার্মেন্টস বন্ধ হচ্ছে, অর্ডার নেই, শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছেন৷ কিন্তু আমাদের রপ্তানি সূচক দুই অংকের ঘরেই রয়েছে৷ 

শুধুমাত্র গত মাসে এক অংকে নেমেছে৷ অর্থাৎ আমাদের রপ্তানি আগের মতোই রয়েছে৷ হতে পারে বড় কারখানাগুলো থেকে রপ্তানি বেশি হচ্ছে, ছোট কারখানাগুলো হয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ আসলে নির্বাচিত সরকার ছাড়া সঠিক বিনিয়োগ হয় না৷

৭৮ শতাংশ পোশাক শ্রমিক পর্যাপ্ত খাদ্য জোগাতে পারেন না

দেশের তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের প্রায় ৩২ শতাংশ ন্যূনতম মজুরির কম আয় করেন এবং ৭৮ শতাংশ শ্রমিক পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য জোগাতে পারেন না৷ প্রতি আট জনের একজন শ্রমিক ঋণের জালে আটকা পড়েছেন৷ সাব-কন্ট্রাক্টেড ও মিশ্র ধরনের কারখানায় ১২ ঘণ্টার শিফট বা অতিরিক্ত কাজ করা সাধারণ ঘটনা৷ 

বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের (বিএলএফ) ‘বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে জবরদস্তিমূলক শ্রম ও শিশুশ্রম : ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ ও সমাধানে দিকনির্দেশনা' শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়৷

গত ২৮ অক্টোবর গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়৷ গবেষণা প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, পোশাক সরবরাহ শৃঙ্খলের নিম্নস্তরে এখনো জবরদস্তিমূলক শ্রম ও শিশুশ্রম বিদ্যমান৷ শিশুশ্রমিকদের প্রায় ৮০ শতাংশ সাব-কন্ট্রাক্টেড বা মিশ্র চুক্তিভিত্তিক কারখানায় কাজ করে৷ তাদের ৯৯ শতাংশ সপ্তাহে ৩৬ ঘণ্টার বেশি কাজ করে এবং চাকরিতে জয়েন করার ক্ষেত্রে বয়স-সংক্রান্ত নথি জাল করার ঘটনাও খুবই সাধারণ বিষয়৷

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়