বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় নতুন ৬৫টি প্রজাতির জলজ প্রাণীর সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে পাঁচটি সারা বিশ্বে প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন প্রজাতিগুলো বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন গবেষকরা। সামুদ্রিক মাছ ও পরিবেশবিষয়ক ‘ইএএফ-ন্যানসেন জরিপ-২০২৫’-এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। সূত্র: বণিক বার্তা
জরিপটি চলতি বছরের ২১ আগস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৩১ দিন বঙ্গোপসাগরে পরিচালিত হয়। নরওয়ের ড. ফ্রিডটজফ ন্যানসেন (ডিএফএন) মিশন ও বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর এটি পরিচালনা করে। এতে সহযোগিতা করেছে জাতিসংঘের বিশ্ব কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও)।
বাংলাদেশে ২০১৮ সালের পর পরিচালিত দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ মেরিন ইকোসিস্টেম জরিপে অনেক তথ্যই উঠে এসেছে। বিশেষ করে সামগ্রিকভাবে মাছের মজুদ কমে যাওয়া, বঙ্গোপসাগরের কোথাও অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া আবার কোথাও স্বল্প বৃদ্ধি, মাইক্রোপ্লাস্টিকের উচ্চ ঘনত্ব ও জেলিফিশের অস্বাভাবিক বিস্তারের বিষয়টি বেশ ভালো করেই তুলে আনা হয়েছে।
রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জরিপটির ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। এফএও, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং নরওয়েজিয়ান উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা (নোরাড) যৌথভাবে এর আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের শুরুতে জরিপ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন ডিএফএন জরিপের ক্রুজ লিডার ও নরওয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন রিসার্চের (আইএমআর) গবেষক ড. ইরিক অলসেন, টিম লিডার ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সায়েদুর রহমান চৌধুরী, মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও ডিএফএন সার্ভের কো-ক্রুজ লিডার ড. আব্দুল্লাহ আল-মামুন।
নতুন প্রজাতির সন্ধানের বিষয়ে গবেষক দলের সদস্য ও মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জরিপে প্রাথমিকভাবে ৬৫টি নতুন প্রজাতির সন্ধান পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে পাঁচটি পৃথিবীতেই প্রথম বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছি। তবে এগুলোর জেনেটিক পরীক্ষা করা হবে। সেজন্য দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিশেষায়িত ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। সেখানকার প্রতিবেদন পাওয়ার পরই এগুলো পৃথিবীতে প্রথম কিনা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
উপস্থাপনাকালে আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আগে বাংলাদেশে ৪৭৫টি সামুদ্রিক প্রজাতি রেকর্ড করা ছিল। এ জরিপে ৬৫টি নতুন প্রজাতি সংযোজন হয়েছে। এর ফলে দেশের সমুদ্র প্রজাতির সংখ্যা ৪৭৫ থেকে বেড়ে হবে ৫৪০টি। তবে নতুনগুলোর এখনো নামকরণ করা হয়নি। এসব প্রজাতি জীববৈচিত্র্যে যুক্ত হলেও এর ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে।’
জরিপে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, নরওয়ে এবং এফএওর ৪০ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল জীববৈচিত্র্য নমুনা সংগ্রহ, প্রজাতি ডকুমেন্টেশন ও লার্ভা শনাক্তকরণ পরিচালনা করে। প্ল্যাংকটন দল ৩২টি স্টেশন থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ৯ হাজার ৭৯৪টি মাছের লার্ভা শনাক্ত করেছে, যার মধ্যে টিউনা লার্ভাও রয়েছে। এছাড়া ৪১৮টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাও সংগ্রহ করা হয়েছে। জেলিফিশ রেকর্ড করা হয়েছে সব ট্রল স্টেশনে এবং তাদের বিচরণ ও ঘনত্ব চিত্রায়িত করা হয়েছে মানচিত্রের মাধ্যমে।
ফলাফলে জানানো হয়, পূর্ব উপকূলের তুলনায় পশ্চিম উপকূলে তুলনামূলক মৎস্য উৎপাদন বেশি হয়। এছাড়া ২০১৮ সালের জরিপের তুলনায় এবারের জেলিফিশের উপস্থিতি উদ্বেগজনক বলেও তুলে ধরা হয়। সাত বছর আগে করা জরিপে জেলিফিশের ঘনত্ব ও বৈচিত্র্য ছিল মূলত গভীর জলে। এবার সেটি অনেক ওপরে পাওয়া গেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। গবেষণার জালে ব্যাপক জেলিফিশ ধরা পড়ে। ইকোসিস্টেম কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে সেটিরই তার প্রমাণ। তবে এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বব্যাপী একটি উদ্বেগের বিষয়।
গবেষকরা জানান, ২০১৮ সালের অনুসন্ধানে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন ১০টির বেশি প্রজাতি গবেষণায় ব্যবহৃত ২৮টি স্টেশনে পাওয়া গিয়েছিল। তবে ২০২৫ সালের জরিপে পাওয়া গেছে মাত্র পাঁচটি। অর্থাৎ মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং কয়েকটি বড় প্রজাতি হারিয়েছে, যেটি একটি সতর্কবার্তা।
বায়োমাস ব্যাপকভাবে কমেছে বলেও জরিপে উঠে এসেছে। ২০১৮ সালের জরিপে ছোট পেলাজিক (জলস্তরের মধ্যম অংশে বসবাসকারী প্রজাতি) ছিল প্রায় ১ লাখ ৫৮ হাজার। কিন্তু চলতি বছর তা ৩৩ হাজারে নেমে এসেছে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
আরো জানানো হয়, সমুদ্রসীমায় বড় মাছের সংখ্যা কমছে। ফলে খাদ্য নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বড় মাছ ধরা হচ্ছে, বিপরীতে জেলিফিশের মতো অপ্রয়োজনীয় প্রাণী বাড়ছে। এসব কারণে পুরো ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং পুরো খাদ্যশৃঙ্খল ব্যাহত হচ্ছে। ওভারফিশিং ঘটছে।
ট্যাক্সোনমিক (জীববৈচিত্র্য বা জীবের শ্রেণীবিন্যাস) অনুসন্ধানের বিষয়ে বলা হয়, গবেষকরা ৩০০ প্রজাতির মাছ সংগ্রহ করেছেন, যার মধ্যে ২৬০ প্রজাতি ছিল শূন্য থেকে ২০০ মিটার গভীরতা এলাকার। বাকি ৪০টি মেসোপেলাজিক প্রজাতি ২০০ মিটারের বেশি গভীরতা থেকে সর্বাধিক দুই হাজার মিটার পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়।
এ সময় গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান তার উপস্থাপনায় বলেন, ‘বাংলাদেশে মৎস্য ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট অগ্রগতি করেছি। নতুন আইন ও নিয়ম হয়েছে। মৎস্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাও রয়েছে। কয়েকটি জাতীয় নীতি বাস্তবায়ন করেছি। বাংলাদেশের মৎস্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। কিন্তু যদি বিশ্বের কোনো মৎস্য বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করি, কোথায় আমাদের অভাব আছে, তারা অন্তত দুটি জিনিস বলবে। আমরা আউটপুট কন্ট্রোলের পরিবর্তে ইনপুট কন্ট্রোলের ওপর নির্ভর করছি। ইনপুট কন্ট্রোল বলতে জালের ধরন, যন্ত্রপাতি, মাছ ধরা বন্ধের সময়, নিষিদ্ধ সময় ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করছি। আমরা কিছু প্রচেষ্টা নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টা করছি। সেটি হচ্ছে কতটি জাহাজ অনুমোদন দেব। এগুলোই ইনপুট কন্ট্রোলের মধ্যে আসে। কিন্তু আউটপুট কন্ট্রোল নেই। আমরা কত মাছ সমুদ্র থেকে আহরণ করতে চাই এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কতটুকু রেখে দিতে চাই সেটি নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে আউটপুট কন্ট্রোল। আমরা এখনো সেখানে পৌঁছাইনি। দ্বিতীয় সমস্যা হলো আমরা মৎস্যসম্পদে সত্যিকারের ইকোসিস্টেমে পৌঁছাইনি। ইকোসিস্টেম রক্ষা করা খুবই প্রয়োজন।’
গবেষক এরিক অলসেন বলেন, ‘একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে পুরো ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র সমানভাবে উৎপাদনশীল—এটি সঠিক নয়। নির্দিষ্ট কিছু উৎপাদনশীল অঞ্চল আছে, সেগুলোর যত্ন নিতে হবে। পৃষ্ঠের পানি অক্সিজেনে সমৃদ্ধ। কিন্তু যখন আমরা ৮০-৯০ মিটার গভীরে যাই, অক্সিজেন প্রায় নেই। এগুলো কোনো জীব বা মাছের উপযোগী না। আমাদের জরিপে দেখা যায়, শুরুতে অক্সিজেনের মাত্রা খুব বেশি ছিল, প্রায় ৪ দশমিক ৫ মিলিলিটার (প্রতি লিটারে)। তারপর ৭০-৮০ মিটার গভীরে এটি দ্রুত কমে প্রায় শূন্যে পৌঁছায়। ৮০০ মিটার গভীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ সময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘সমুদ্রের মাছের সংস্থান প্রকৃতির অমূল্য দান হলেও অতি আহরণ, অবৈধ ও অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য আহরণ এবং ক্ষতিকর জাল ব্যবহারের কারণে সামুদ্রিক মাছের সংস্থান কমে যাচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে মাছের মজুদ কমছে, যা গভীর উদ্বেগের বিষয়।’
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের। সম্মানিত অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হাকন আরাল্ড গুলব্রান্ডসেন ও বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াওকুন শি।