মহসিন কবির: অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের নয় মাস পর দেশ ছাড়লেন দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এটা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন জন পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন।
আওয়ামী লীগপন্থী অপরাধীদের ‘সেফ এক্সিট’ নিশ্চিত করছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার-এমন অভিযোগ তুলে ক্ষোভ ঝাড়লেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ। বৃহস্পতিবার সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে তিনি ক্ষোভ ঝাড়েন।
ফেসবুক পোস্টে হাসনাত লিখেছেন, ‘খুনিকে দেশ থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়, পুলিশ আসামি ধরলেও আদালত থেকে জামিন দেয়া হয়। শিরীন শারমিনকে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে বাসায় গিয়ে পাসপোর্ট করে দেয়া হয়। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল জানুয়ারিতে হওয়ার কথা থাকলেও মে মাসে এসেও শুরু হয়নি। আর আপনারা বলছেন আওয়ামী লীগের বিচার করবেন?’ তিনি আরও লেখেন, ‘তা ইন্টেরিম, এখন পর্যন্ত কী কী বিচার ও সংস্কার করেছেন?’
রাষ্ট্রপতির মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনের কার্যালয়ের ফোন কলেই সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ দেশত্যাগ করতে পেরেছেন বলে জানালেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। আজ বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে এ দাবি করেন তিনি।
আবদুল হান্নান মাসউদ লিখেছেন, ‘আব্দুল হামিদকে বিমানবন্দরে আটকানো হলো, তারপর নাকি চুপ্পুর (মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের আরেক নাম) অফিস থেকে ফোন কল পেয়ে ছেড়ে দেয়া হলো। এরপরও কি ইন্টেরিমকে জুলাই বিপ্লবীরা সাপোর্ট করে যাবে!’ তিনি লেখেন, ‘হয় চুপ্পুকে সরান-লীগকে ব্যান করেন, আর না হয় নিজেরা সরে যান।’
অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে থাকা দুই উপদেষ্টাকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। একইসঙ্গে উপদেষ্টা হিসেবে আরও ছাত্র প্রতিনিধি চান তিনি। আজ বৃহস্পতিবার নিজের ভ্যারিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া পোস্টে এসব দাবি করেন মাহফুজ আলম।
‘কৈফিয়ত কিংবা বাস্তবতা’ শিরোনামে দেওয়া পোস্টে তথ্য উপদেষ্টা লেখেন, ‘ক্ষমতার ভরকেন্দ্র অনেকগুলো। ফলে কাজের দায় সরকারের, কিন্তু কাজ করে ক্ষমতার অন্যান্য ভরকেন্দ্র। জোড়াতালি দিয়ে গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব না, সম্ভব নয় নূতন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ‘
তিনি লেখেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরের পর সহযোগী ভূমিকায় নেই৷ কিন্তু, ঠিকই প্রশাসন, বিচারবিভাগ, পুলিশে তারা স্টেইক নিয়ে বসে আছেন। এস্টাবলিশমেন্ট দ্বিদলীয় বৃত্তে ফিরতে এবং ছাত্রদের মাইনাস করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
তথ্য উপদেষ্টা লেখেন, ‘প্রায় তিন ডজন নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ছাত্র মাত্র দুজন। ছাত্র প্রতিনিধিদেরকেও এস্টাবলিশমেন্ট রাষ্ট্রপতি অপসারণের ঘটনার পর থেকে কোণঠাসা করে রেখেছে। আমরা দুজন সর্বোচ্চ ব্যালেন্সিং এক্ট করতে পারছি, কিন্তু প্রভাবক হিসাবে কাজ করতে হলে সরকারে সুষম ছাত্র প্রতিনিধিত্ব লাগবে।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের কয়েকটি দল হয়ে যাওয়াতে তারা এখন বিভক্ত, তদুপরি অন্য রাজনৈতিক দলের মতোই তারা ট্রিটেড হচ্ছেন। এজন্য নাগরিক কমিটিই ছিল দীর্ঘমেয়াদে অভ্যুত্থানের ফোর্স হিসাবে টেকসই। যাই হোক! এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্লাটফর্ম দেশব্যাপী ছাত্রদের গুছিয়ে উঠতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অভুত্থানের ছাত্র-জনতা বিভক্ত ও দ্বিধান্বিত।’
মাহফুজ আলম লেখেন, ‘সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র কম্প্রোম্পাইজড।মিডিয়া ও ব্যবসায়ে লীগের আধিপত্য কমেনি। লীগের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে হাত দেয়া যায়নি৷ পুরাতন দ্বিদলীয় বন্দোবস্ত টিকে গেছে। বিচার বিভাগ এখনো দ্বিদলীয় বৃত্তে বন্দী।’
তিনি লেখেন, ‘বাম-ডানের কালচারাল ক্যাচাল জুলাইকে দুর্বল করেছে এবং শাহবাগ-শাপলাকে চিরন্তন করে তুলেছে। ডানপন্থীরা ভুল রাজনীতি করেছেন এবং নূতন বাস্তবতায় আবগের বশে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা রেখেছেন। বামপন্থীরা প্রথম থেকেই সরকারের প্রতি স্কেপ্টিক্যাল এবং অভ্যুত্থানের পক্ষে জোরদার ভূমিকা রাখতে অসফল।’
সরকারের এ উপদেষ্টা লেখেন, ‘সবচেয়ে ডেডিকেটেড ছাত্রকর্মীরা ক্রেডিট, দলবাজি আর কোরামবাজির খপ্পরে পড়েছেন। আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ হাতেগোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে, কিন্তু ডিমোরালাইজড হয়েছে সমগ্র ছাত্র- জনতা। ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের পক্ষের প্রতিষ্ঠান ও নূতন সিভিল সোসাইটি গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক এলায়েন্সের ক্ষেত্রে ছাত্র- জনতার কোনো হিস্যা নেই। ’
তিনি লেখেন, ‘শহিদ-আহতদের ক্ষেত্রে এবং বিচারের প্রশ্নে সরকারসহ সকল অংশীজন অসফল। অভ্যুত্থান শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হয়নি৷ এস্টাবলিশমেন্ট ও রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থবাদী চিন্তা ও কর্মের সাথে সাথে ছাত্রদের অনভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাব এ জন্য দায়ী। ‘
মাহফুজ আলম লেখেন, ‘সর্বোপরি ছাত্রদের মাইনাস করে (ছাত্রদের ব্যর্থতা অনস্বীকার্য বটে) দ্বিদলীয় বন্দোবস্তে ফেরার জন্য এস্টাবলিশমেন্ট অপেক্ষমান। ছাত্রদের পরিপূর্ণ অসহযোগিতার মুখে ইতোমধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। ’
সমাধান হিসেবে তিনি লেখেন, ‘সমাধান? রাষ্ট্র ও এস্টাবলিশমেন্টে ছাত্রদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা এবং ফ্যাসিবাদী শক্তি ও তার দালালদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আঘাত করা। এগুলো করার পূর্বশর্ত হল, ছাত্রদের মধ্যে সততা, আদর্শ, নিষ্ঠা ও ঐক্য ফিরিয়ে আনা। পুরাতন বন্দোবস্তের সৈনিকদের অকার্যকর করে তোলা।’
মোঃ সোলায়মান হোসেন নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, দেশ ছাড়েন নি , পালিয়েছেন। মোহাম্মদ জাকির মাহমুদ নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, একজন হত্যা মামলার আসামী কিভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। কাওছার হোসেন জয় নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, এটা কেন , তারা সাবেক রাষ্ট্রপতি ছিল এজন্য সব অপরাধ ক্ষমা করেছেন নাকি।
নির্বান হাসান নিশাত নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, উনি ৭ বারের এমপি ২ বার রাষ্ট্র প্রধান। মানে ৪০ বছর রাষ্ট্রকে সেবা দিয়েছেন। যারা উনার সমালোচনা করছে তাদের অনেক বয়স ৪০ বছরও হয়নি। এই ৪০ বছরের দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। ওহহ অভিযোগ এসেছে, তিনি নাকি কথিত জুলাই আন্দোলনে হামলাকারী!! । নুরে আলম লিটন নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, যে দেশের রাষ্ট্রপতি হত্যা মামলার আসামি হয় সে দেশ কিভাবে চলবে আগামীতে। বোঝার বিষয়।
এমডি সাইদুর রহমান নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, সামন্য এলাকা ভিত্তিক মামলার জন্য ৫ বছরের মধ্যে কোনো পাসপোর্ট করতে পারিনাই,,,,,আর এই তারা দেশ ত্যাগ করে!। মনিম হাসান সোজুন নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন,উনি তো পালিয়ে যাননি উনি মিডিয়ার সামনে দিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে গিয়েছেন।
ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় তাকে ‘চিকিৎসার জন্য’ যেতে দেওয়া হয়েছে। দুজন আত্মীয় তার সঙ্গে ছিলেন।
ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকার হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর আওয়ামী লীগের সময়ে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তার মেয়াদ শেষে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। বঙ্গভবন ছাড়ার পর রাজধানীর নিকুঞ্জের বাসায় থাকছিলেন আবদুল হামিদ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ৯ মাস পর দেশ ছেড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বুধবার দিনগত রাত ৩টা ৫ মিনিটে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে তিনি দেশ ছাড়েন।
গত ১৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর থানায় আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করা হয়। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং ওবায়দুল কাদেরের নামও রয়েছে।