শিরোনাম
◈ যা ঘটেছিল সেদিন, বর্ণনা দিলেন সেই এইচএসসি পরীক্ষার্থী ◈ পিএসসি সংস্কারের দাবিতে শাহবাগ ব্লকেড, পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি ◈ বাংলাদেশে ধর্ষণ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, প্রশ্নের মুখে রাষ্ট্রের ভূমিকা ◈ সরকারি চাকরিতে আসছে বড় পরিবর্তন ◈ বাংলা‌দে‌শে রাজ‌নৈ‌তিক অ‌স্থিরতার ধু‌য়ো তু‌লে আগ‌স্টে সফ‌রে আস‌ছে না ভারতীয় ক্রিকেট দল ◈ একযোগে ১৫ নেতাকে অব্যাহতি দিল ছাত্রদল ◈ পাকিস্তান চীনের ‘জীবন্ত পরীক্ষাগার’, ৮১% সামরিক সরঞ্জাম চীনা: দাবি ভারতের জেনারেল রাহুল সিংয়ের ◈ ক্রোম ব্রাউজারে ভয়ংকর নিরাপত্তাত্রুটির সন্ধান, নিরাপদ থাকতে যা করতে হবে ◈ পাটগ্রামে থানায় হামলার প্রসঙ্গ টেনে জামায়াত আমিরের মন্তব্য: ‘এই পরিস্থিতিতে কী নির্বাচন হবে?’ ◈ পাটগ্রাম থানায় হামলা ও ভাঙচুর: স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মাইদুলসহ গ্রেফতার ৪, বিএনপির অস্বীকৃতি

প্রকাশিত : ০৪ জুলাই, ২০২৫, ০৮:২৯ রাত
আপডেট : ০৫ জুলাই, ২০২৫, ১২:০৪ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বেদনাদায়ক মব জাস্টিস আর কত দিন?

শাহাজাদা এমরান: কুমিল্লার ১৭টি উপজেলার মধ্যে মুরাদনগর অন্যতম বৃহৎ একটি। ৫ আগস্টের পর থেকেই সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত রয়েছে। শুধু রাজনৈতিক পরিস্থিতি নয়, এই মুরাদনগর উপজেলা এখন গোটা বাংলাদেশের আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই গত সপ্তাহে ধর্ষণকাণ্ডের মতো একটি বেদনাদায়ক, নির্মম ও ঘৃণিত ঘটনা ঘটেছে। এর রেশ এখনো শেষ হয়নি।

ধর্ষণকাণ্ডের ঘটনা যখন চলছিল, ঠিক তখনই ৩ জুলাই বৃহস্পতিবার মব সন্ত্রাস সৃষ্টি করে একই পরিবারের মা, মেয়ে ও ছেলেসহ মোট তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আমরা আর কতদিন এই বেদনাদায়ক মব সন্ত্রাসকে ধারণ করে যাব? ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোন ইজ্জত দিয়েছিল একটি শান্তির বাংলাদেশ পাওয়ার জন্য। যেই বাংলাদেশে বিনা বিচারে কেউ হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে না, সন্ত্রাসের শিকার হবে না, ধর্ষণের শিকার হবে না, লুটপাটের শিকার হবে না, বাকস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে না।

কিন্তু আমরা কি পেয়েছি সেই বাংলাদেশ? ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমরা পেলেও, আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, চিন্তা ও চেতনার স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আমরা কিন্তু পাই নাই। যার ফলে ৯০-এ তৎকালীন স্বৈরাচার সরকার এরশাদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। পরবর্তীতে গত ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান/বিপ্লবে ১৫ বছর জাতির ঘাড়ে চেপে থাকা জগদ্দল পাথরের ন্যায় স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের পতন ঘটিয়ে এদেশের ছাত্রসমাজ একটি সমৃদ্ধশালী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার জন্য তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, ২০২৪ সালের আগস্ট মাস থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত সর্বমোট মব সহিংসতায় ১৭৪ জন মানুষ মারা গেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র আমাদেরকে সে তথ্য দিয়েছে। যারা মবকে জাস্টিস হিসেবে বেছে নিয়েছে সেই অন্যায়কারীদের হাতে।

মুরাদনগরের ঘটনা: মাদকে জড়িত হলেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেন?

জুলাই মাসের শুরুতেই মুরাদনগরে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। আমরা কোথায় আছি? আমরা জানি যে তিনজন মারা গেছে তাদের সবার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা আছে।

কুমিল্লা জেলা পুলিশ ও বাঙ্গরা বাজার থানা-পুলিশের তথ্য মতে, নিহত রোকসানার বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ তিনি গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে তিনি জামিনে ছিলেন। এছাড়া রোকসানার ছেলে নিহত রাসেলের বিরুদ্ধে ৯টি, মেয়ে নিহত তাসপিয়া জোনাকির বিরুদ্ধে ৫টি, আহত রুমার বিরুদ্ধে ২টি, তাসপিয়ার স্বামী মনিরের বিরুদ্ধে ১১টি, আরেক মেয়ের স্বামী আমির হামজার বিরুদ্ধে দুটি মাদকের মামলা রয়েছে।

অর্থাৎ নিহত রোকসানার পরিবার পারিবারিকভাবে মাদকের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। এটা যেমন অস্বীকার করার সুযোগ নাই, তেমনি আমাদের উচিত ছিল তাকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া। আইন তো নিজের হাতে তুলে নেওয়ার জন্য ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত দেয়নি। বরং আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার জন্য ছাত্র-জনতা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল।

সেদিন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া গর্জে উঠেছিল বৈষম্যমুক্ত একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণ হবে বলে। কিন্তু সেই বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকা অবস্থায়, যে সরকারের প্রধান হচ্ছেন বিশ্বের আইকন, নোবেল বিজয়ী, আমাদের গর্ব, অহংকার প্রফেসর ড. ইউনুস মহোদয়। সেই মহান মানুষের আমলে কিভাবে এত মব জাস্টিস হচ্ছে? উচ্ছৃঙ্খল জনতা কিভাবে আইন তাদের হাতে তুলে নিচ্ছে?

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জেনেছি, মব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, মামলা না নেওয়া এবং বিচারিক কাজে যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়া। যদি সংশ্লিষ্ট থানা মবের বিরুদ্ধে যথাযথ মামলা নিত এবং যথাযথ বিচারিক কাজ করা হতো, তাহলে এভাবে মব বাড়তো না। একটা জাতিকে মব জাস্টিস একেবারে নিঃশেষ করে দিতে পারে, যা সুন্দর আগামীর জন্য উদ্বেগজনক।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব
চলতি জুলাই মাসেই লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় বালুমহলকে কেন্দ্র করে থানায় আক্রমণ করে থানার ওসিকে আহত করা হয়েছে, গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। আমরা কি মব জাস্টিসকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিলাম? তাহলে তো আইনের শাসন আর দরকার নেই।

কুমিল্লার সর্ববৃহৎ উপজেলা মুরাদনগর, যেখানে দুটি থানা আছে – মুরাদনগর থানা এবং বাংগরা বাজার থানা। ৫ আগস্টের পর থেকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া এবং মুরাদনগরের অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা আলহাজ্ব কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ – এই দুই নেতার দ্বন্দ্ব শুরু থেকেই মুরাদনগরকে অশান্ত করে রেখেছে। কিছুদিন পরপর মুরাদনগরে হামলা-পাল্টা হামলা, মামলা, ভাঙচুর করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন সেখানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে আমি মনে করি। এ দায় পুলিশ প্রশাসন এড়াতে পারবে না।

এর ভিতরে চলে এসেছে অত্যন্ত ঘৃণিত, নিন্দিত ধর্ষণকাণ্ড। ধর্ষণ করে সেই ভিডিও আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দিয়েছে। আশার বিষয় হলো পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। যেদিন ধর্ষণকাণ্ডের সাথে জড়িত চারজনকে রিমান্ডে নেওয়া হলো সেদিনই মব জাস্টিসের আওতায় এনে একই পরিবারের মা, বোন, ছেলেকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। একটি পরিবারকে কি এভাবে বিনা বিচারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়?

তারা মাদকের মামলার সাথে জড়িত। তাদের অত্যাচার-নির্যাতনে এলাকাবাসী অতীষ্ঠ। এ সত্য স্বীকার করে বলছি, এটা তো স্বাধীন বাংলাদেশ। এখানে প্রশাসন, আইন, বিচার আছে। সংবিধান এখনো সমুন্নত আছে। আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী মাঠে আছে। তারপরেও কিভাবে একটি পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হলো বিনা বিচারে?

দৈনিক "আমাদের কুমিল্লা" পত্রিকার প্রতিনিধি অনুসন্ধান করে বের করেছেন যে ওই মব জাস্টিসের সময় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও চেয়ারম্যান উপস্থিত থেকে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন মব জাস্টিসের জন্য।

পুলিশের ভূমিকা ও সংস্কারের প্রশ্ন
কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার নজির আহমেদ বলেছেন, যারা এই অন্যায় করেছে, তাদের খুঁজে এনে আইনের মাধ্যমে যথাযথ শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মানুষ কিন্তু এখনো পুলিশের এই কথায় বিশ্বাস করে না। অনেকে বলে পুলিশ নিষ্ক্রিয়। আমি আমার সাথে ঘটে যাওয়া নীলফামারীর ঘটনা দিয়ে বলতে পারি, পুলিশ এখনো তাদের অন্যায়, নির্যাতনের যে বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল, সেটা থেকে বের হতে পারেনি। নীলফামারীর পুলিশ সুপার তারিক আমার প্রতি যে অন্যায় করেছিলেন, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পড়ে।

আমরা পুলিশের সংস্কারের (রিফর্ম) কথা বলি, কিন্তু পুলিশ কি মানসিকভাবে এখনো ভালো হতে পারছে কিনা, সেটা একটা বিশাল প্রশ্ন হয়ে আমার মধ্যে দেখা দিয়েছে। কোনো রকম ক্লু না থাকা সত্ত্বেও নীলফামারীর পুলিশ সুপার আমাদের উপর যে অন্যায় করেছিলেন, আমাদেরকে প্রায় দেড় দিন পরিবার থেকে, সমাজ, দেশ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে যে হয়রানি করেছেন, সেটা কিন্তু এক প্রকার ক্রিমিনালের আওতায় পড়ে বলে আমি মনে করি।

সুতরাং আমি কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার নজির আহমেদ খানকে বলব, কুমিল্লায় যেন মব জাস্টিসের আওতায় আর একজন নাগরিকও আহত বা নিহত না হয়। ভিডিও দেখে সবাইকে বিচারের আওতায় এনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেখানে বিএনপি এবং এনসিপির মত দুটি সক্রিয় রাজনৈতিক দল রয়েছে, সেখানে যেন আপনার বিবেক কোনো পক্ষাবলম্বন না করে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।

মব জাস্টিস এখনই এবং এখন বন্ধ করতে হবে। এর আর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সাংবাদিক,সংগঠক, টকশো উপস্থাপক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক। ০১৭১১-৩৮৮৩০৮,  sahajadaamran@yahoo.com.

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়