জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাজধানীর চাঁনখারপুলে গুলিতে নিহত শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্যে ছেলে হত্যার বদলা হত্যা চেয়েছেন এই মা।
রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে দেওয়া জবানবন্দিতে এ শাস্তি দাবি করেন তিনি।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রাজধানীর চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে নবম সাক্ষী হিসেবে রোববার সাক্ষ্য দিলেন দীপ্তি।
জবানবন্দিতে সানজিদা খান দীপ্তি বলেন, ‘২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকালে একটি চিঠি লিখে রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার ভাড়া বাসা থেকে বের হয়েছিল আনাস। চিঠিতে আনাস লিখেছিল ‘‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। যদি না ফিরি তাহলে গর্বিত হইও।’ ঠিক দুপুরে তার মৃত্যুর খবর পাই আমরা। পরে তার লাশ আনতে মিটফোর্ড হাসপাতালে যাই। সঙ্গে তার বাবা ও নানাও ছিলেন। লাশটি নিয়ে রিকশায় করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেই আমরা। ওই সময় আনাসের রক্তে আমাদের তিনজনের শরীর ভেসে গিয়েছিল।’
ছেলেহারা এই মা বলেন, বাসায় আনার পর লাশ নিয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মিছিল করেন এলাকাবাসী। পরে ধুপখোলা মাঠে তার জানাজার আয়োজন করা হয়। সেখানে মেহেদী হাসান জুনায়েদ নামের আরও একজনের জানাজা হয়েছে বলে আনাসের বাবার কাছ থেকে জানতে পারি। তবে স্থানীয় আলেমের পরামর্শে রক্তাক্ত কাপড়ে গোসল ছাড়াই শহীদি মর্যাদায় আনাসকে দাফন করা হর।
আন্দোলনকারী রাব্বী ও সৌরভের বরাত দিয়ে সানজিদা খান দীপ্তি বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে হাজারও আন্দোলনকারীর সঙ্গে শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছিল আনাস। কিন্তু চাঁনখারপুলে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধার সম্মুখীন হন। ওই সময় গুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ-র্যাব। এতে প্রাণ রক্ষায় চাঁনখারপুলের নবাব কাটারাসহ বিভিন্ন গলিতে আশ্রয় নেন আন্দোলনকারীরা। আনাসও সেখানে ছিল। একপর্যায়ে আমার ছেলেকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন একজন পুলিশ সদস্য। গুলিটি বুকে লাগলে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায় আনাস। পরে আন্দোলনকারী কয়েকজন মিলে তাকে রিকশায় করে হাসপাতালে নেন। কারণ রিকশাই ছিল ওই সময়ের অ্যাম্বুলেন্স।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে গুলি বর্ষণকারীসহ নির্দেশদাতাদের নাম জানতে পারেন বলে জবানবন্দিতে তুলে ধরেন দীপ্তি। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে চাঁনখারপুলে হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী ও রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম। আর তাদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। তারা সেদিন নির্বিচারে গুলি চালিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে আনাসের মা দীপ্তি বলনে, ‘অভিযুক্তরা এমন ভয়াবহভাবে গুলি চালিয়েছিল, যেন মানুষ না বাঁচতে পারেন। তাদের গুলিতেই চাঁনখারপুলে আমার ছেলে আনাসসহ ছয়জন শহীদ হয়েছিলেন। গুলির নির্দেশদাতা ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। আমি হত্যার বদলে হত্যা চাই। এসব আসামির ফাঁসির আদেশ চাই।’
পরে ট্রাইব্যুনালে আনাসের মাকে জেরা করেন মামলার আসামি আরশাদের আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি। পর্যায়ক্রমে তাকে জেরা করছেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এর আগে এদিন সকালে কারাগার থেকে মামলার চার আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পুলিশ। তারা হলেন শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম।