জুলাই সনদ-২০২৫ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিএনপির দাবি, আগামী সংসদে নির্বাচিত সরকার সনদ বাস্তবায়ন করবে। অন্যদিকে, জামায়াত ও এনসিপি সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে। রোববার (২৪ আগস্ট) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা সনদ বাস্তবায়নে দুটি কার্যকর পদ্ধতির প্রস্তাব দেন—গণভোট আয়োজন অথবা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি।
রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সনদের বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতি নিয়ে বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এবং চার বিশেষজ্ঞ অংশ নেন।
বিশেষজ্ঞ প্যানেলে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ ড. শরিফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক।
কমিশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
সব গাড়িই আইন ভাঙছে, প্রতিদিন আড়াই লাখ মামলা হওয়া উচিত
সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে জুলাই সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিতে গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ (Special Constitutional Order) গ্রহণের পরামর্শ এসেছে আইন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে।
এর আগে, গত ১০ আগস্ট জাতীয় সংসদে এলডি হলে আইন বিশেষজ্ঞরা সনদ বাস্তবায়নে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে অধ্যাদেশ জারির পরামর্শও দিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের বৈঠকে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বৈঠক সূত্র বলছে, আইনি দিক বিবেচনা করে অধ্যাদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের বাস্তবায়নের চিন্তা থেকে সরে এসেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে সংবিধানে নিষেধাজ্ঞা আছে।
বৈঠকে আইন বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দুটি কার্যকর পদ্ধতি রয়েছে। তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে, গণভোট। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারি।
বৈঠকে অংশ নেওয়া কমিশনের সংশ্লিষ্ট একজন জানান, এগুলো নির্ভর করছে জাতীয় সংসদের ওপর। পরবর্তী সংসদ চাইলে তা বাতিল করে দিতে পারে কিংবা আদালতও চাইলে বাতিল করে দিতে পারে।
একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, গণভোটে গেলে জনগণের সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকবে এবং এতে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হবে। চাইলে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই ব্যালটে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। তবে তিনি গণভোটের অনিশ্চয়তাও উল্লেখ করেন।
অন্য এক সদস্য বলেন, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া যাবে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও দীর্ঘ আন্দোলনে মানুষের ত্যাগ-রক্তের বিনিময়ে যে পরিবর্তন এসেছে, তা গুরুত্ব পেতে হবে। আদালতে এটিও টিকবে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া আরেকজন বিশেষজ্ঞের মতামত, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটে গেলে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয় থাকবে। তখন একটা চাপ থাকবে। শেষ পর্যন্ত গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। সেইক্ষেত্রে ব্যালটে নির্বাচনী প্রতীকের পাশাপাশি জুলাই সনদের বিষয়টি থাকতে পারে। সেই আলোচনা বৈঠকে হয়েছে। পাশাপাশি গণভোটে কিছু অনিশ্চয়তার কথা এসেছে। সবকিছু মিলিয়ে কোনো পন্থা কিংবা পদ্ধতি যাওয়া কতটুকু উত্তম হবে তা নিয়ে নানান পরামর্শ আসলেও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজকে জুলাই সদস বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা আইনজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেখানে নানা ধরনের পরামর্শ এসেছে। তবে, এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধের কারণে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিকল্প প্রস্তাব ঠিক করতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থায়ী সমাধান কেবল রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমেই সম্ভব। এর উদাহরণ হিসেবে তারা একাদশ সংবিধান সংশোধনের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে দলগুলোর সম্মতিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পরে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন, যা আদালতে কখনো চ্যালেঞ্জ হয়নি।
এবার জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য না হলেও জাতীর কপালে দুঃখ আছে বলেও মন্তব্য করেন কমিশনের একজন সদস্য।
জাতীয় সনদের বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে গণভোটসহ বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানান কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, সেখানে গণভোট একটি বিকল্প ছিল। এ ছাড়া একাধিক বিকল্প নিয়ে আমরা বিবেচনা করছি।
বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আইন উপদেষ্টা ও অ্যাটর্নি জেনারেল থাকার প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকার দ্রুত সময়ে কি করতে পারে, সেগুলো বিবেচনা করা হয়েছে। সনদের যে সমস্ত প্রস্তাবে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে, তার কোন-কোন প্রস্তাব দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় সেগুলো নিয়ে কথা হয়েছে। সেগুলোর বাস্তবায়নের পথ ও পদ্ধতি বিবেচনা করা হচ্ছে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আইন মন্ত্রণালয় ঐকমত্য কমিশনকে জানিয়েছে, জুলাই সনদের কোন কোন প্রস্তাব দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য তা চিহ্নিত করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওনকে ছয় মাসের জন্য বিশেষ পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গত ১০ আগস্ট আইন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম, বিশেষ করে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের কাজে সহযোগিতার জন্য ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওনকে বিশেষ পরামর্শক (অবৈতনিক) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যোগদানের তারিখ হতে ছয় মাস মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ থাকবে তার। উৎস: ঢাকা পোষ্ট।