শিরোনাম
◈ ইসরাইলের বাজান তেল রিফাইনারিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত ৩ ◈ সাবেক সংসদ সদস্য অপু গ্রেফতার ◈ জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের সাধারণ সম্পাদক বাবুল কারাগারে ◈ মৎস্য খাতের অবদানের জন্য আমাদেরকে প্রকৃতি ও পানির প্রতি সদয় হতে হবে: প্রধান উপদেষ্টা ◈ হারুন সহ পুলিশের ১৮ কর্মকর্তা বরখাস্ত ◈ ইউরোপ ভ্রমণে কড়াকড়ি, গুনতে হবে মোটা অঙ্কের জরিমানা! কোথায়, কীভাবে, কত টাকা জরিমানা দিতে হতে পারে? ◈ ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ বার্তা ফাঁসকারী সেই পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার ◈ বৃষ্টি নিয়ে যে বার্তা দিল আবহাওয়া অফিস ◈ ইউক্রেন ইস্যুতে বৈঠকের জন্য হোয়াইট হাউসের পথে জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতারা ◈ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে নানা চ্যালেঞ্জ, পারবে কি কমিশন?

প্রকাশিত : ১৮ আগস্ট, ২০২৫, ১১:৫২ দুপুর
আপডেট : ১৮ আগস্ট, ২০২৫, ০৩:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : মহসিন কবির

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে নানা চ্যালেঞ্জ, পারবে কি কমিশন?

মহসিন কবির: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা সমীকরণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। অতীতের নির্বাচন সচ্ছ ছিলো না। এজন্য চ্যালেঞ্জ আরো বাড়ছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে-এমন ঘোষণার পর অপশক্তিগুলো নির্বাচন বানচাল করতে চতুর্মুখী অপতৎপরতা শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী এবং পতিত আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা নাশকতা সৃষ্টিসহ পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মতো ক্ষেত্র তৈরির অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া এ নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা এখনও বড় প্রশ্ন। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নানা হিসাব মেলাতে হবে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই সনদে ঐকমত্য, সব দলের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছ ভোটগ্রহণ ও ফল প্রকাশ- এসব সমীকরণ মিললেই কেবল নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

সরকারের সবুজ সংকেত পেয়ে ইসি ঘোষণা দিয়েছে- আগামী সপ্তাহে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, এবারের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা চ্যালেঞ্জ। এখানে শুধু ইসি বা সরকার আন্তরিক হলেই হবে না, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকেও বিশেষভাবে সহযোগিতা করতে হবে। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা রাখা বিএনপি ও তার মিত্র রাজনৈতিক দল, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিক হতে হবে। কারণ, সরকারের নির্বাহী আদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ সব সময়ই চাইবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হোক। সুযোগ পেলে তারাও সেই ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইবে। তবে ২৪-এর জুলাই আন্দোলনের ভূমিকা রাখা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য থাকলে আওয়ামী লীগ তার উদ্দেশ্যে সফল হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক প্রফেসর ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের একটা সময় ঘোষণা করেছে। আবার নির্বাচন কমিশনও বলেছে, তারা রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। নির্বাচনের মূলত তিনটি অংশীজন। তারা যেন সবাই অংশগ্রহণ করে, এটা দেশবাসীর প্রত্যাশা।

এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী শর্তসাপেক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বলেছে। সেগুলো মীমাংসা করা অবশ্যক। জুলাই সনদের বিষয়ে যদি এক ধরনের ঐকমত্য আসে, বিশেষ করে নির্বাচনসহ প্রধান বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে যদি ঐকমত্য হয়, তাহলে নির্বাচন সহজতর হবে। এবং শর্ত ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে আসতে পারবে। জুলাই সনদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে ঐকমত্য হলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু হবে বলে বিশ^াস করছি। তিনি এ-ও বলেন, নির্বাচন নিয়ে দলগুলো যদি নিজেও আলোচনা করে, তাহলেও সংকট উত্তরণে সহায়ক হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমি কোনো সংশয় দেখি না।? জামায়াত বা এনসিপি যে কথাগুলো বলেছে- এটা তাদের আদর্শিক চাপ। যেহেতু তারা জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে; তাই তারা বিএনপিকে চাপ প্রয়োগ করতেই এ ধরনের কথা বলছে। শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে কোনো সংশয় দেখি না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে খুবই কম নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ১৯৯১ সালের ৫ম, ১৯৯৬ সালের ৭ম, ২০০১ সালের ৮ম এবং ২০০৮ সালের ৯ম- এই তিনটি নির্বাচনই অংশগ্রহণমূলক ছিল। রাজনীতির মাঠে নানা কথা থাকলেও এসব নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বড় কোনো প্রশ্ন নেই। তবে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের বর্জন করা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ, বিএনপি ও তার মিত্রদের বর্জন করা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম এবং ২০২৪ সালের সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচন দেশ-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এসব নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতিও ছিল নামমাত্র।

শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও তাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, যার বড় উদাহরণ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় আগের রাতে দলীয় ব্যালেট নৌকা প্রতীকে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে ফল নিজেদের অনুকূলে নেয়। এই অবস্থায় রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, জুলাই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা কিছু ব্যক্তি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। কয়েকজন উপদেষ্টাকে মনে করা হয় এনসিপির লোক। নির্বাচনকালীন সরকারে তাদের থাকা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আপত্তি আছে। সুনির্দিষ্টভাবে যাদের নিয়ে আপত্তি আছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই তাদের অন্তর্বর্তী সরকার থেকে বাদ দিতে হবে। তা না হলে অতীতের মতো প্রশ্ন উঠতে পারে।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা এবং জাতীয় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না গণমাধ্যমকে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক উপদেষ্টাকে নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। তাদের একজন তো আবার বলেছেন, তফসিল ঘোষণা করলে তিনি পদত্যাগ করবেন এবং নির্বাচন করবেন। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে সরকারকে নিরপেক্ষ হতে হয়। তিনি আরও বলেন, একটি নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে তিনটি বিষয় খুই গুরুত্বপূর্ণ- তা হলো বড় রাজনৈতিক দলের ইতিবাচক ভূমিকা, নিরপেক্ষ পুলিশ প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশন।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সম্প্রতি প্রকাশিত জরিপে দেখা গেছে কাকে ভোট দেবেন- এই প্রশ্নে সিদ্ধান্তহীনদের সংখ্যা বেড়ে ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই জরিপও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেন, দেশে মূলত দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ; একে অন্যের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। জুলাই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি পালিয়ে পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় নেন। জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে হত্যার অভিযোগে পতিত আওয়ামী লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর নির্বাচন কমিশনও দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে।

আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, যারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল, তাদের ক্ষমতায় আসতে আবার বহু বছর লেগেছে। মুসলিম লীগ আসতে পারেনি, আওয়ামী লীগের লেগেছিল ২১ বছর। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি মাত্র ৯ বছরে আবার ক্ষমতায় এসেছিল।

রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে বলে বিভিন্ন দলের নেতাদের সূত্রে জানা গেছে। তাদের মতে, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও দলটির কর্মী-সমর্থকদের ভোটের মাঠে আনতে হলে কোনো না কোনো কৌশল গ্রহণ করতে হবে- বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে বিগত দিনে গুম, খুন ও দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ নেই; যারা ভুল বুঝতে পেরেছেন। দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশে কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করা সম্ভব- জানতে চাইলে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এমন ঘটনা ভারতবর্ষে এর আগে অতীতে দেখা যায়নি। এখানে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বলতে এখন বিএনপি। গত এক বছরে এই দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। দলটিও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে, মানুষ মনে করে, আওয়ামী লীগ যা করেছে বিএনপিও তাই করবে। তারপরও মানুষের কাছে বিএনপির বিকল্প নেই। সম্প্রতি এক জরিপেও দেখা ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ কোন রাজনৈতিক দলকে ভোট দেবে সিদ্ধান্ত নেননি।

রাজনৈতিক নেতারা বলেন, এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ হবে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনা এবং ভোটের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখা। যেহেতু একটি ধারণা তৈরি হয়ে গেছে, ভোট হলে ধানের শীষের প্রার্থীই জয়লাভ করবে। ফলে ধানের শীষ প্রতীক পাওয়ার জন্য প্রথমে নির্বাচনী এলাকাগুলোয় বিএনপি নেতাদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। এরপর যারা মনোনয়নবঞ্চিত হবেন, তারা বিদ্রোহী হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবেন। এই নিয়ে এলাকাগুলোর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে। ফলে ভোটের মাঠে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সে কারণে অনেক ভোটার ভোট কেন্দ্রে নাও যেতে পারেন। এই বিষয়ে বিএনপি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন যদি সঠিক ভূমিকা না রাখে, তাহলে ভোটার উপস্থিতির হার তুলনামূলকভাবে কম হবে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা দীর্ঘ ১৭ বছর গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করে ফাইনাল খেলার জন্য বিএনপি আন্দোলনের জন্য একটি মাঠ প্রস্তুত করে রেখেছিল। সেই মাঠে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতা জুলাই আন্দোলনের করে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করেছে। এখন দেশের মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় আছেন। অনেকে অনেক শঙ্কা প্রকাশ করতেই পারেন।

কিন্তু বাস্তবিক অর্থে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হয়- এমন কোনো কর্মকাণ্ডে বিএনপি বা অন্য কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতারা জড়াবেন না বলে মনে করেন শাহজাহান। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে, আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হবেন। ফলে এই সময়ে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ প্রার্থী হবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে দল তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। এর ফল যে ভালো হবে না, এটা দলের কোনো নেতারই বুঝতে বাকি নেই। আমি বিশ্বাস করি, সবাই ধানের শীষের পক্ষে কাজ করবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়