তুর পাহাড় ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যেখানে আল্লাহ তায়ালা সরাসরি নবী মুসা (আ.)-এর সঙ্গে কথা বলেছেন। পবিত্র কোরআনে এই পাহাড়কে ‘তুর সিনিন’ বা ‘আত-তুর’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এর ভূগোল, ধর্মীয় তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক প্রমাণ ইসলাম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি—তিন ধর্মেই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
ধর্মীয় ইতিহাসে তুর পাহাড়
তুর পাহাড়কে ইসলামের পাশাপাশি খ্রিষ্টান ও ইহুদিধর্মেও পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। ইহুদিরা বিশ্বাস করে, এখানেই নবী মুসা (আ.) তাওরাত গ্রহণ করেছিলেন। খ্রিষ্টানদের মতে, এখানে নবী মুসা (আ.) আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং পরে ‘দশ আদেশ’ লাভ করেছিলেন। (এক্সোডাস ১৯-২০, পুরাতন নিয়ম, বাইবেল)
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.)-কে এই পাহাড়ে আহ্বান করেছিলেন। মুসা (আ.) তখন বললেন, “হে আমার প্রতিপালক, আপনি আমাকে দেখা দিন, আমি আপনাকে দেখব।’ তিনি বললেন, ‘তুমি আমাকে কখনো দেখবে না। বরং তুমি পাহাড়ের দিকে তাকাও।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ১৪৩)
হাদিস ও তাফসির অনুযায়ী, মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে ৪০ দিন অবস্থান করেছিলেন, যাকে ‘আইয়ামুল আরবাইন’ বলা হয়। সেখানে তিনি রোজা রেখেছিলেন, তাওরাতপ্রাপ্তির প্রস্তুতি নিয়েছিলেন এবং আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
ইমাম তাবারি (রহ.) বলেন, ‘তুর পর্বতটি এমন স্থান, যেখানে নবী মুসা (আ.) ওহিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এটি মিসরের সীমান্তে অবস্থিত সিনাই অঞ্চলের একটি উঁচু পাহাড়।’ (তাফসির আত-তাবারি, ১৯/২২৪, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৮)
কোরআনে তুর পাহাড়
কোরআনে তুর পাহাড়ের উল্লেখ একাধিকবার এসেছে। যেমন,
১. সুরা তুর: ‘শপথ তুর পর্বতের, এবং শপথ লিপিবদ্ধ কিতাবের।’ (আয়াত: ১-২)
২. সুরা মুমিনুন: ‘আর (আমি সৃষ্টি করেছি) সেই বৃক্ষ, যা তুর পর্বতের পাশে জন্মে এবং তা তেল উৎপন্ন করে, যা আহারকারীদের জন্য সুস্বাদু।’ (আয়াত: ২০)
৩. সুরা নাজম: ‘আর নিশ্চয়ই তিনি [নবী মুসা (আ.)] তাঁকে দ্বিতীয়বার দেখেছিলেন, তুর পাহাড়ের কাছে।’ (আয়াত: ১৩-১৪)
৪. সুরা কাসাস: ‘আর তুমি তো তুর পাহাড়ের পাশে ছিলে না, যখন আমি মুসাকে আহ্বান করেছিলাম।’ (আয়াত: ৪৬)
এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে, তুর পাহাড় নবুওয়াতের ইতিহাসে এক বিশেষ যোগাযোগস্থল, যেখানে আল্লাহ ও মুসা (আ.)-এর মধ্যে সরাসরি সংলাপ হয়েছিল। (তাফসির ইবনে কাসির, ৬/৩১৫, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০০)
তুর পাহাড়ের অবস্থান
তুর পাহাড়ের অবস্থান মিসরের সিনাই উপদ্বীপে। আধুনিক সময়ে স্থানটি পরিচিত ‘জাবাল মুসা’ নামে। আরো স্পষ্ট করে বললে, এর অবস্থান মিসরের দক্ষিণ সিনাই প্রদেশে শহরের সেন্ট ক্যাথরিনের কাছে, লোহিত সাগরের উত্তর-পূর্বে প্রায় ২,২৮৫ মিটার (৭,৪৯৭ ফুট) উচ্চতায়।
মিসরের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বর্ণনামতে, অঞ্চলটি বর্তমানে মিসর সরকারের দক্ষিণ সিনাই প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত এবং সেখানে ‘মাউন্ট সিনাই’ নামে সেটি ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সংরক্ষিত।
আধুনিক ভূতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গবেষণা অনুযায়ী, সিনাই অঞ্চলের ‘তুর সিনাই’ এলাকা প্রাচীন সেমিটিক জাতির তীর্থস্থান ছিল। ১৯ ও ২০ শতকে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে এখানে প্রাচীন মন্দির ও শিলালিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। (নেলসন গ্লুয়েক, দ্য রিভার্স ইন দ্য ডেজার্ট: আ হিস্ট্রি অব দ্য নেগেভ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ১১২)
তুর পাহাড়ের প্রতীকী অর্থ
তুর পাহাড় কেবল একটি ভূগোল নয়, বরং ইমান, তাওহিদ ও আল্লাহর নৈকট্যের প্রতীক। এখানে নবী মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আল্লাহর কথোপকথন প্রমাণ করে—আল্লাহ তাঁর বান্দাকে সরাসরি নির্দেশ দিতে পারেন এবং বান্দার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন।
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, ‘তুর পাহাড়ে মুসা (আ.) যে আলো দেখেছিলেন, সেটি ছিল আল্লাহর নূরের আভাস, যা পরে আধ্যাত্মিক জ্ঞানলাভের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।’ (ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালি, ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, ৪/৭৫, দারুল মিনহাজ, জেদ্দা, ২০০৩)। সূত্র: প্রথম আলো