দক্ষিণ চীন সাগরপারে পর্বতময় দ্বীপমালার দেশ তাইওয়ান। এটি এশিয়ার ব্যাঘ্র বলে পরিচিতি। এর আয়তন ১৩ হাজার ৮২৬ বর্গমাইল। ২০২৪ সালের হিসাবমতে, দেশটির মোট জনসংখ্যা দুই কোটি ৩৪ হাজার।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী তাইওয়ানে মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ৬০ হাজার। দেশটির উত্তর-পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর, পূর্ব ও দক্ষিণে চীন সাগর, উত্তর-পশ্চিমে চীন এবং পূর্বে জাপান ও ফিলিপিন্স। এর রাজধানী তাইপে। তাইওয়ানের বেশির ভাগ মানুষ চীনা বংশোদ্ভূত।
তাইওয়ানে পর্তুগিজরা ১৬২৪ সালে দখলে নেয়। ১৬৬১ সাল পর্যন্ত দেশটিতে তাদের শাসন কায়েম ছিল। এরপর চীন দেশটি দখল করে নেয়। চীন-জাপান যুদ্ধের সময় ১৮৯৫ সালে জাপান তাইওয়ান দখল করে।
অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন আবার তাইওয়ান দখল করে। তাইওয়ান বর্তমানে একটি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পরিচিত। দেশটির মাথাপিছু আয় ১৮ হাজার ৫৮৮ মার্কিন ডলার। তাইওয়ানে সরকারিভাবে ১৩টি ধর্ম স্বীকৃত। তবে এর অর্ধেক জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ।
তাইওয়ানে মুসলমানদের আগমন
তাইওয়ানে মুসলমানরা সর্বপ্রথম আগমন করে সপ্তদশ শতাব্দীতে। ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ১৬৬১ সালে তাইওয়ানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর থেকে ডাচেদর বিতাড়িত করার উদ্দেশে কক্সিঙ্গার নেতৃত্বে বহু মুসলিম পরিবার চীনের কুজিয়ান থেকে তাইওয়ানে আসে। তারাই ছিল তাইওয়ানের প্রথম অভিবাসী। ১৯৪৯ সালে চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ২০ হাজার মুসলিম পরিবার তাইওয়ানে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৯৫০ সালে চীনের হান মুসলমানদের সঙ্গে তাইওয়ানের মুসলমানদের সংযোগ স্থাপিত হয়। ১৯৫৩ সালে তাইপে, ইয়াগুন ও ব্যাংককের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে তাইওয়ানে অনিয়মিত বাহিনীর পাঁচ হাজার ৫৮৩ জন সেনা এবং তাদের ওপর নির্ভরশীলদের মধ্যে এক হাজার ৪০ জনকে নিয়ে আসা হয়। এই বাহিনীর একটি বড় অংশ ছিল মুসলিম। তাদের কয়েকজন মুসলিম নেতা তাইওয়ানের জাতীয় পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৮০ সালে দিকে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে বিপুলসংখ্যক মুসলমান উন্নত জীবনের আশায় তাইওয়ানে পাড়ি জমায়। ১৯৮৯ সালে তাইওয়ান সরকার শিল্প খাতে বিদেশি শ্রমিকদের কাজের অনুমতি দিলে অনেক মুসলিমের তাইওয়ানে আগমন ঘটে। এ সময় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে লক্ষাধিক মুসলিম শ্রমিক তাইওয়ানে আসে। তাদের অনেকেই পরে তাইওয়ানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির আশায় অনেক মুসলমান তাইওয়ানে আসে এবং এখানে বসবাস করে।
তাইওয়ানে মুসলিমদের তৎপরতা
অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তাইওয়ানের মুসলমানরা এগিয়ে যাচ্ছে। বৌদ্ধ অধ্যুষিত একটি অমুসলিম পরিবেশে থেকেও মুসলমানরা মিলেমিশে বাস করছে। পর্যাপ্ত মসজিদ না থাকায় তাইওয়ানের মুসলমানরা ওয়াক্তি ও জুমার নামাজ পড়তে অসুবিধার সন্মুখিন হন। তবে তাইওয়ানের রয়েছে তাইপে গ্র্যান্ড মসজিদ। ১৯৬০ সালে স্থানীয় মুসলিম ও বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগিতায় তাইপে গ্র্যান্ড মসজিদ কাম ইসলামিক সেন্টার নির্মিত হয়। এটি দেশটিতে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক মিলনকেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তাইপে মসজিদে বছরে প্রায় ১০০ জন মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই মসজিদ ইসলামী শিক্ষা ও ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন দেশের কিছু সংস্থা ও সংগঠন তাইপে মসজিদ বিভিন্ন সময় পরিদর্শন করেছে। যেমন—রাবেতা আল-আলম আল ইসলামী। তা ছাড়া ওয়ার্ল্ড অ্যাসেম্বলি অব মুসলিম ইয়ুথের সহযোগিতায় এখানে সেমিনার ও ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। এতে মুসলমানদের মধ্যে প্রেরণা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এর ফলে দাওয়াতি কাজের পরিবেশও সৃষ্টি হয়। তাইওয়ানে মোট পাঁচটি মসজিদ আছে, যেখানে নামাজসহ ইসলামী জ্ঞানের ব্যবস্থা করা হয়।
তাইওয়ানের মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন সংগঠন মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের উন্নতির জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। চীনের মুসলমানদের একমাত্র সংগঠন হচ্ছে ‘চীনা মুসলিম সংঘ’। এর কেন্দ্রীয় দপ্তর তাইওয়ানে। প্রতিবছর বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করার জন্য সরকার এই সংগঠনকে ১০ হাজার মার্কিন ডলার অনুদান প্রদান করে আসছে। তাইওয়ানে রয়েছে ‘চীনা মুসলিম শিক্ষা সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিবছর এখান থেকে বহু ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষা অর্জন করে। তাইওয়ানের সমাজকর্মী আলহাজ উমর হিনি এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাইওয়ানি মুসলিম যুবকদের নানা বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য ‘চীনা মুসলিম যুব সংগঠন’ নামে একটি যুব সংঘ আছে। এভাবে মসজিদ, শিক্ষা কেন্দ্র ও অন্যান্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের মাধ্যমে তাইওয়ানের মুসলমানরা ইসলামের বিকাশের কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে ধীরে ধীরে তাইওয়ানে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে। সূত্র: কালের কণ্ঠ