যুক্তরাজ্যের মাটিতে ইরান দীর্ঘ এক দশক ধরে একটি বহুমুখী ও গোপন ‘ছায়া যুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছে। এই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য শুধু তেহরানের ওপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর করা নয়, বরং এর পরিধি আরও অনেক বিস্তৃত। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, আর্থিক নেটওয়ার্ক এবং স্থানীয় সংগঠনকে ব্যবহার করে ইরান ব্রিটিশ সমাজে বিভাজন তৈরি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট এবং পশ্চিমা প্রভাব খর্ব করার এক দীর্ঘমেয়াদি রণকৌশল বাস্তবায়ন করছে। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য টাইমস এবং স্কটিশ ডেইলি এক্সপ্রেস-এর মতো একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
ইরানের বহুমুখী রণকৌশল:
১. আর্থিক ও নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দেওয়ার তৎপরতা:
ব্রিটিশ সরকারের ট্রেজারি বিভাগ জানিয়েছে, শুধু ২০২৪ সালেই তারা ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের ৯টি ঘটনা তদন্ত করছে। তবে এটি ইরানের পরিচালিত বিশাল আর্থিক নেটওয়ার্কের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ইরানের দুটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক— মেলি ব্যাংক এবং ব্যাংক সাদেরাত— লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে তাদের কার্যক্রম বহাল রেখেছে। অতীতে এই দুটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের সশস্ত্র গোষ্ঠী, বিশেষ করে হিজবুল্লাহ এবং হামাসকে অর্থায়নের অভিযোগ উঠেছিল, যা যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি।
২. গণমাধ্যম ও প্রচারণার জাল:
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল প্রেস টিভি-কে ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যে সম্প্রচারের অনুমতি বাতিল করা হলেও তারা দমে যায়নি। অনলাইনে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই চ্যানেলটি এখনও ইরান-ঘেঁষা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে ইরান সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি এবং পশ্চিমা নীতিগুলোর বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করে।
৩. স্থানীয় সংগঠনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার:
প্রতিবেদনে লন্ডনভিত্তিক কিছু সংগঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা ইরানের মতাদর্শ প্রচারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে ইসলামিক হিউম্যান রাইটস কমিশন (আইএইচআরসি) অন্যতম। এই সংগঠনটি লন্ডনে প্রতি বছর ‘আল-কুদস ডে’র আয়োজন করে, যা ঐতিহাসিকভাবে ইরান-সমর্থিত একটি ফিলিস্তিনপন্থী সমাবেশ। অতীতে এই সংগঠনটি লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়ে তীব্র সমালোচিত হয়েছিল। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য সরকার হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
৪. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে অনলাইন প্রোপাগান্ডা:
ইরানের এই ছায়া যুদ্ধের সবচেয়ে আধুনিক ও উদ্বেগজনক দিকটি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণা সংস্থা ওপেনএআই (OpenAI) ইরানের সঙ্গে যুক্ত স্টর্ম-২০৩৫ (Storm-2035) নামের একটি অনলাইন নেটওয়ার্ক শনাক্ত করেছে। দ্য টাইমস এবং স্কটিশ ডেইলি এক্সপ্রেস-এর তথ্যমতে, এই নেটওয়ার্কের কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম:
কার্যপদ্ধতি: নেটওয়ার্কটি পারসিয়ান (ফারসি) ভাষায় লেখা প্রম্পট ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায় উসকানিমূলক এবং বিভেদমূলক পোস্ট তৈরি করত।
ভুয়া পরিচয়: এই পোস্টগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার)-এ এমন সব অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করা হতো, যেগুলো নিজেদের সাধারণ ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিত। প্রোফাইলে স্টক ছবি ব্যবহার করে এবং ব্রিটিশ নাম দিয়ে এই ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলো তৈরি করা হতো।
লক্ষ্য: এই প্রচারণার মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলন, সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি এবং বিদেশনীতির মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে বিতর্ক উসকে দিয়ে সামাজিক বিভাজন তৈরি করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
৫. বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (IRGC) সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত:
এই অনলাইন নেটওয়ার্কটির সঙ্গে ইরানের ক্ষমতাধর ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)-এর সরাসরি যোগসাজশের শক্তিশালী প্রমাণ মিলেছে। জানা যায়, গত ১২ জুন ইসরায়েলি হামলায় আইআরজিসি-র এক জ্যেষ্ঠ কমান্ডার নিহত হওয়ার পরপরই এই ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলো হঠাৎ করে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। বিশ্লেষকদের মতে, এটি প্রমাণ করে যে এই প্রচারণা ইরানের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সম্ভবত আইআরজিসি-র নির্দেশেই পরিচালিত হচ্ছিল।
** যুক্তরাজ্যের ব্যর্থতা এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ:**
দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে তীব্র সমালোচনা করে বলা হয়েছে, ইরানের এই জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তারের অভিযান মোকাবিলায় যুক্তরাজ্য সরকার কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতা এবং নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়েই ইরান তার নেটওয়ার্ক এতটা গভীরে বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের এই ‘ছায়া যুদ্ধ’ যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি। আর্থিক, প্রযুক্তিগত এবং সামাজিক—এই তিন ক্ষেত্রেই তেহরানের তৎপরতা মোকাবিলা করা ব্রিটিশ সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য টাইমস, স্কটিশ ডেইলি এক্সপ্রেস।