আবেগঘন মুহূর্তটা ছিল এক তরুণীর সঙ্গে তার ৯ মাস বয়সী শিশুপুত্র এবং স্বামীর বিদায়বেলার। কালো রঙের বোরকা পরে তপ্ত রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি তরুণী সায়রা শক্ত করে স্বামী ভারতীয় যুবক ফারহানের হাত ধরে রেখেছিলেন। যুদ্ধাবস্থায় কাছাকাছি চলে যাওয়া ভারত ও পাকিস্তানের প্রধান সীমান্ত চেকপোস্টে আরও কিছুটা সময় দুজনে একমাত্র সন্তানকে জড়িয়ে একসঙ্গে থাকার চেষ্টা করছিলেন।
এই দুই দেশের মাঝে অন্যতম সীমান্ত ক্রসিংটির নাম আত্তারি-ওয়াঘা। এর একদিকে ভারতের আত্তারি গ্রাম, অন্যদিকে পাকিস্তানের ওয়াঘা। এই সীমান্ত পথ বহু বছর ধরে ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য ভ্রমণের একটি গেটওয়ে বা করিডর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে আজ সেই আত্তারি-ওয়াঘা সীমান্ত বিভাজন এবং পরিবারের সদস্যদের বিচ্ছেদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। পরমাণু শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনার মধ্যে দুই দেশ তাদের নাগরিকদের সীমান্তের ওপারের যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। হাজারো পরিবারের ওপর এর প্রভাব পড়ছে, যাদের কিছু সদস্য ভারতের, আবার কিছু সদস্য পাকিস্তানের। খবর আল জাজিরার।
ভারত সরকার মঙ্গলবারের (২৯ এপ্রিল) মধ্যে প্রায় সব পাকিস্তানি নাগরিককে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়ার পর ৯ মাসের ছেলে আজলানকে সঙ্গে নিয়ে সায়রা ও ফারহান নয়াদিল্লি থেকে সারা রাত ভ্রমণ করে সীমান্ত ক্রসিংয়ে পৌঁছান। ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীর হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই নির্দেশ দেয়া হয়। হামলার জন্য পাকিস্তানকে মদদদাতা হিসেবে দায়ী করছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। অন্যদিকে, এই হামলাকে নয়াদিল্লির শাসনের প্রতি সশস্ত্র গোষ্ঠীর দীর্ঘ দিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলছে ইসলামাবাদ। সেই সঙ্গে কাশ্মীর সংকটকে ভয়াবহ মাত্রায় নিয়ে যাওয়া এবং কাশ্মীর শাসনে নয়াদিল্লির ব্যর্থতাকেই সশস্ত্র হামলার কারণ বলছে ইসলামাবাদ।
সায়রার দিকে তাকিয়ে ফারহান বলেন, ‘শিগগিরই আমাদের দেখা হবে।’ এরপর শিশুপুত্র আজলানের গালে চুমু খেয়ে বিদায় জানালেন ফারহান। বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ, খুব শিগগির দেখা হবে। আমি তোমাদের দুজনের জন্য দোয়া করবো।’
তিন বছর আগে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমের পাকিস্তানের করাচির বাসিন্দা সায়রার সঙ্গে নয়াদিল্লির ফারহানের প্রেম হয়। এরপর বিয়ে। সায়রা চলে আসেন শ্বশুরবাড়ি নয়াদিল্লিতে। তবে গত মঙ্গলবার আত্তারি সীমান্তে দাঁড়িয়ে সায়রা ও ফারহান যখন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলেন, তখন দুজনেরই চোখ ভিজে উঠেছিল। সেই মুহূর্তে এক সীমান্তরক্ষী তাদের তাড়া দিয়ে বললেন—‘দ্রুত করুন, সময় নেই।’
কাঁটাতার আর ব্যারিকেডে ঘেরা সেই চেকপয়েন্টে এ দম্পতির পরিচয়ের একমাত্র চিহ্ন ছিল পাসপোর্টের রং—সায়রার সবুজ, ফারহানের নীল।
সায়রার দিকে তাকিয়ে ফারহান বলেন, ‘শিগগিরই আমাদের দেখা হবে।’ এরপর শিশুপুত্র আজলানের গালে চুমু খেয়ে বিদায় জানালেন ফারহান। বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ, খুব শিগগির দেখা হবে। আমি তোমাদের দুজনের জন্য দোয়া করব।’
ঠিক তখনই এক নিরাপত্তারক্ষী এগিয়ে এসে আজলানের পাসপোর্টের দিকে ইশারা করলেন। সেটি ছিল নীল রঙের—মানে ভারতীয়।
নিরাপত্তারক্ষী সায়রাকে বললেন, ‘শিশুটি যাবে না, ম্যাডাম।’ সায়রা তখনো বাঁ হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছেন।
এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই দম্পতিকে আলাদা করে দেয়া হয়। এরপর সায়রা চললেন করাচির পথে, আর ফারহান শিশু আজলানকে নিয়ে ফিরে গেলেন নয়াদিল্লিতে।
গত ২২ এপ্রিল রোববার দুপুরে অস্ত্রধারীরা পেহেলগামের এক পর্যটন শহরে গুলি চালিয়ে ২৬ জনকে হত্যা করে। নিহতদের বেশির ভাগই পর্যটক। ঘটনার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত এ হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। ইসলামাবাদ তা প্রত্যাখ্যান করে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
ঘটনার জেরে উপমহাদেশের দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কয়েক দিন ধরেই সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। এরই মধ্যে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে হওয়া বহু বছরের পুরোনো সিন্ধু পানিচুক্তি একতরফাভাবে স্থগিত করেছে। পাকিস্তানও অন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পাল্টা হুমকি দিয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে এনেছে এবং কার্যত একে অপরের বেশির ভাগ নাগরিককেই বহিষ্কার করেছে। আত্তারি-ওয়াঘা সীমান্ত এখন পুরোপুরি বন্ধ। সেখান দিয়ে মানুষের পারাপার ও পণ্য পরিবহন বন্ধ আছে।
২২ এপ্রিলের পর এ পর্যন্ত আনুমানিক ৭৫০ জন পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ফিরে গেছেন। আর পাকিস্তান থেকে ভারতে ফিরেছেন প্রায় ১ হাজার ভারতীয় নাগরিক।
এ সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানুষদের মধ্যে আছেন দুই দশক পর ভারতে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে আসা পাকিস্তানি নারী, ভারতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসা দুই বোন—যাদের অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়েই ফিরতে হয়েছে এবং ভারতে চিকিৎসা নিতে আসা বয়স্ক পাকিস্তানি রোগীরাও।
৪৮ বছর বয়সী হালিমা বেগমও এ তালিকায় আছেন। ওডিশা থেকে দুই দিন ধরে দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ (প্রায় ১ হাজার ২৫০ মাইল) পাড়ি দিয়ে আত্তারি সীমান্তে পৌঁছেছেন তিনি।
হালিমা বেগম ২৫ বছর আগে করাচি ছাড়েন। সেই সময় ওডিশার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। জীবন মোটামুটি ভালোই চলছিল। এর মধ্যেই সম্প্রতি এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে তার হাতে ভারত সরকারের ‘ভারত ছাড়ো’ নোটিশ ধরিয়ে দিয়েছেন।
সীমান্তের কাছে একটি ট্যাক্সিতে বেশ কিছু ব্যাগ নিয়ে বসে ছিলেন হালিমা। তিনি বলেন, ‘আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি ওনাদের বলেছিলাম, আমি তো এখানে এমনি এমনি আসিনি—আমার বিয়ে হয়েছে ভারতে। ভারত সরকার যে আমার এত বছরের গড়ে তোলা জীবনকে এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেলছে এবং আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, তা কি ন্যায্য হচ্ছে?’
২৫ বছর ভারতে কাটানো হালিমা বলেন, দেশটা তারও দেশ হয়ে গেছে।
হালিমার সঙ্গে ছিলেন তার দুই ছেলে—২২ বছর বয়সী মুসাইব আহমেদ ও ১৬ বছরের যুবায়ের আহমেদ। আট বছর আগে তাদের বাবা মারা গেছেন। দুই ভাই মিলে ঠিক করেছেন, যুবায়ের মায়ের সঙ্গে সীমান্ত পার হবে, যেন সে মায়ের দেখাশোনা করতে পারে।
দুই ছেলের পাসপোর্টই নীল (ভারতীয়)। আর হালিমার পাসপোর্ট সবুজ (পাকিস্তানি)। মুসাইব ও যুবায়ের শুরুতে সীমান্তরক্ষীদের কাছে কাকুতি-মিনতি করেছিলেন, এমনকি শেষে তর্কেও জড়ান। কিন্তু কোনো কিছুতে কাজ হয়নি।
কাঁপা গলায় মুসাইব বলেন, ‘মা কখনো একা কোথাও যাননি। আমি জানি না, উনি কীভাবে এই ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে করাচি পৌঁছাবেন।’
করাচিতে হালিমার যাওয়ার মতো কোনো ঘর নেই। তার মা–বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। তার একমাত্র ভাই নিজের ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে মাত্র দুটি কক্ষে থাকেন।
চোখ মুছতে মুছতে হালিমা বলেন, ‘হাজারটা প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়। কিন্তু একটারও উত্তর নেই। আমি শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করি—আমার সন্তানদের যেন রক্ষা করেন। খুব শিগগির আবার এক হব আমরা।’
রাতারাতি টানা সীমান্তে ভাগ হয়ে যাওয়া মানুষের গল্প নিয়ে ২০২২ সালে প্রকাশিত হয় ‘মিডনাইটস বর্ডারস’ বইটি। এর লেখিকা সুচিত্রা বিজয়ন বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে এমন অসংখ্য হৃদয়বিদারক কাহিনি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে।
সুচিত্রার মতে, ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের পর থেকে যেসব মুসলিম নারী ভারত কিংবা পাকিস্তানে জন্ম নিয়ে অন্য দেশের পুরুষদের বিয়ে করে সেদিকে চলে গেছেন, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। বিশেষ করে যখন তাঁদের জোর করে ফেরত পাঠানো হয়, তখন তাঁদের অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়তে হয়।
‘(বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর) আপনি এমন এক জায়গায় বন্দী হয়ে পড়েন, যা আর আপনার ঘর নয়—অথবা এমন একটা ঘর, যেটাকে আপনি চিনতেও পারেন না। নির্বাসন হয়ে ওঠে আপনার জীবনের স্বাভাবিক অবস্থা’, বলেন সুচিত্রা।
সায়রা ও ফারহানের মতো করে বিগত কয়েক দশকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের টানাপোড়েনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বহু পরিবার এ আশায় বুক বেঁধে থেকেছে যে অচিরেই তারা আবার মিলিত হবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবে তা ঘটেনি। সুচিত্রা বিজয়ন বলেন, ‘সবচেয়ে বেদনাদায়ক যে কথা বারবার শুনবেন, সেটা হলো—অনেকে ভেবেছিলেন যে তারা সাময়িকভাবে যাচ্ছেন।’ উৎস: চ্যানেল২৪