ছয় বছর বয়স থেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ফারদিন। ইনসুলিনের ওপর তার জীবন নির্ভর হয়ে গেছে। ছেলের ঘন ঘন প্রস্রাবের লক্ষণ দেখে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষা করে তার টাইপ-১ ডায়াবেটিস শনাক্ত হয় বলে জানান তার বাবা আহমেদ এলাহী। চিকিৎসকদের মতে, ডায়াবেটিস শুধু বড়দের হয় না, শিশুদেরও হয়। আর প্রতিবছর এই সংখ্যা বাড়ছে। তাই উদ্বেগ বাড়াচ্ছে শিশুদের ডায়াবেটিস।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) মতে, বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে এর সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। বাংলাদেশ ডায়বেটিক সমিতির তথ্য মতে, প্রতিবছর ৩০০-৪০০ শিশুর ডায়াবেটিস শনাক্ত হচ্ছে। এই সংখ্যা বিগত সময়ের তুলনায় বেশি।
গবেষক ও চিকিৎসকদের মতে, টাইপ-১ এবং টাইপ-২ এই দুই ধরনের ডায়াবেটিসের মধ্যে সাধারণত ৪০ বছরের বেশি বয়সী রোগীদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস দেখা যায়, কিন্তু এখন বেশিরভাগ শিশুদের মধ্যে এই অবস্থা দেখা যাচ্ছে— যা ডায়াবেটিস রোগীর সামগ্রিক সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ডায়াবেটিস চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশিকায় বলা হয়েছে—দেশে প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। রোগটিতে ২০ থেকে ৮০ বছর বয়সী ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ভুগছেন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। বর্তমান ধারায় চলতে থাকলে ২০৪৫ সালে দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হবে ২ কোটি ২৩ লাখ।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের রোগ নির্ণয় হচ্ছে না। ডায়াবেটিস সাধারণত দুই ধরনের হয়, টাইপ-১ ও টাইপ-২। চিকিৎসকরা জানান, মূলত ৩০ বছরের কম বয়সীদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়। এ ধরনের রোগীর সংখ্যা দেশে কম। তবে টাইপ-২ ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দেশে বেশি।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে অন্তঃসত্ত্বাকালীন ডায়াবেটিসের হার ৬ থেকে ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, প্রায় ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে শিশুদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) অ্যান্ডোক্রাইনলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিমের মতে, অনেক ক্ষেত্রে কম বয়সে ও শিশু বয়সে যে ডায়াবেটিস হয়, তা টাইপ-১ ডায়াবেটিস নামে পরিচিত। জন্ম ও পরিবেশগত নানা কারণে এই ডায়াবেটিস হয়। এতে এক ধরনের ইমিউন সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা) জটিলতায় দেহের অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলো দ্রুত ধ্বংস হয়ে ইনসুলিন উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে বাকি জীবন তাকে ইনসুলিনের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে হয়। অবশ্য বাংলাদেশে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের প্রকোপ অনেক কম। তবে বড়দের মধ্যে দেখা যাওয়া টাইপ-২ ডায়াবেটিসও বর্তমানে কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ, ভারত, চীন ইত্যাদি দেশ কম বয়সে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইদানীং ওজন বাড়ার প্রবণতা অত্যধিক হারে বেড়েছে। বেড়েছে ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয় ও জাংক ফুডের প্রতি আসক্তি। সমানতালে কমছে খেলাধুলার বা কায়িক শ্রমের সুযোগ। কম্পিউটার বা টেলিভিশনের সামনে বসে সময় কাটানোর অভ্যাসও ওজন বাড়ার জন্য দায়ী। সব মিলিয়ে যে রোগ হওয়ার কথা ৪০ বছরে বা তারও পরে, সেই রোগে কৈশোর বা তারুণ্যেই আক্রান্ত হচ্ছে তারা।’
তার মতে, আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অন্যান্য দেশে সাধারণত টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয় ৩৭ বছর বয়সের পর। আমাদের এখানে কিন্তু অল্প বয়সে শিশুদের হচ্ছে। এটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়।
ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ‘টাইপ-২ ডায়াবেটিস ৭০ শতাংশ প্রতিরোধযোগ্য। আর তার জন্য চাই জীবনযাপনে ও অভ্যাসে ইতিবাচক পরিবর্তন। শৈশবে যারা ওজনাধিক্য ও স্থূলতায় ভোগে, তাদের ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। সঠিক পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে শিশুদের ছোটবেলা থেকেই সচেতন করে তুলতে হবে। ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বর্জন করতে হবে। বাড়িতে তৈরি পুষ্টিকর খাবার ও টিফিনে তাদের অভ্যস্ত করতে হবে, প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবারের প্রতি উৎসাহী করতে হবে। এছাড়া প্রতিদিন নিয়ম করে খেলাধুলা বা কায়িক শ্রম করা জরুরি।’
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ‘টাইপ-১ ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ইনসুলিন লাগবেই, ইনসুলিন তাদের জীবন, ইনসুলিন নিয়ে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। মুটিয়ে যাওয়ার কারণে শিশুরা এখন টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ সময় ৩০ বছরের আগে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতো না, কিন্তু এখন ১৫-১৬ বছরেও টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ডায়াবেটিস রোগী বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। কিন্তু কত হারে বাড়ছে সেটা বলা মুশকিল। তবে অনেক বেশি বাড়ছে। মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে ডায়াবেটিস রোগী বাড়ছে। এই যে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড, কায়িক পরিশ্রম না করার কারণে মুটিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডায়াবেটিস রোগী বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ।’ উৎস: বাংলাট্রিবিউন।