ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন।। এবার বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। কয়েকটি জেলা রীতিমতো ডেঙ্গুর হট স্পটে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,আগাম সতর্কতা সত্ত্বেও প্রস্তুতি না নেয়ায় জেলাগুলোতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আরো বাড়তে পার।
জানুয়ারি থেকে এই পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছয় হাজার ৪৬৬ জন। তার মধ্যে শুধু বরগুনা জেলায়ই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৮৩২ জন। মারা গেছেন পাঁচ জন। আর সারা দেশে মারা গেছেন ৩০ জন। বরিশাল জেলায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৭৫ জন, মারা গেছেন তিন জন। কুমিল্লা জেলায় ভর্তি হয়েছেন ২০৪ জন, মারা গেছেন তিন জন। দেশের ১১টি জেলা এখন ডেঙ্গুর সর্বাধিক ঝুঁকিতে আছে ।
বিভাগওয়ারি হিসাবে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী এখন বরিশাল বিভাগে । সেখানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ৯৮০ জন, মারা গেছেন আট জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১০ জেলায় সর্বোচ্চ রোগী পাওয়া গেছে। এই ১১ জেলায় রোগী পাওয়া গেছে ৫ হাজার ৩৯৮ জন। দুই মাস আগে গত ১৫ এপ্রিল এসব জায়গায় রোগী ছিল এক হাজার ৪৩৪ জন। সে হিসেবে এই দুই মাসে রোগী বেড়েছে চার গুণের বেশি।
বরগুনায় এক হাজার ৮৩২ জন, বছরের রোগীর ২৮ শতাংশ। দুই মাস আগেও এখানে রোগী ছিলেন মাত্র ১২৮ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ রাজধানী ঢাকায়। এখানে রোগী এক হাজার ৪৭২ জন, যা বছরের রোগীর ২৩ শতাংশ। এরপর বরিশালে ৫৭৫ জন, পটুয়াখালী ৩৭৯, চট্টগ্রামে ৩১২, কুমিল্লা ২০৪, গাজীপুরে ১৩৭, কক্সবাজারে ১৩৪, মাদারীপুরে ১২৩, পিরোজপুরে ১১৯ ও চাঁদপুরে ১১১ জন রোগী পাওয়া গেছে। রোগীর ৮৩ শতাংশ এই ১১ জেলার। বাকি ৪৮ জেলায় এক হাজার ৬৮ জন রোগী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ২৪৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ভর্তি হয়েছেন ১৩৮ জন, যা দিনের রোগীর ৫৭ শতাংশ এবং এই বিভাগের বরগুনায় সর্বোচ্চ ৮২ জন ভর্তি হয়েছে, যা দিনের রোগীর ৩৪ শতাংশ। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩২ জন, ঢাকা বিভাগে ২৬, রাজশাহী বিভাগে ২৪, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চার ও ময়মনসিংহ বিভাগে একজন ভর্তি হয়েছে। নতুন রোগীদের মধ্যে ১৬০ জন পুরুষ ও ৮৪ জন নারী। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ছয় হাজার ৪৬৬ জন ও মারা গেছে ৩০ জন।
হটস্পট বরগুনা ও দাউদকান্দি
বরগুনাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবার ডেঙ্গুর হটস্পট ঘোষণা করেছে। এডিস মশার অবস্থা বুঝতে দেশে সাধারণত তিন দফা জরিপ চালানো হয়। বর্ষার আগে, বর্ষার সময় এবং পরে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় এ জরিপ শেষ করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি)।
এ বছরের মধ্য জানুয়ারিতে হওয়া জরিপে দেখা যায়, দেশের ডেঙ্গুর প্রধান বিস্তারস্থল ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার চেয়ে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন স্থানে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি। ওই বিভাগের বরগুনা অঞ্চলে ঘনত্ব ছিলো ২০ শতাংশের বেশি। এটা ছিলো সর্বোচ্চ। বরগুনায় তাই ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব নিশ্চিতভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়। বরগুনায় সুপেয় পানির সংকট থাকায় পানি ধরে রাখা হয়। ওই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি এডিসের লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে পানি ধরে রাখার বড় বড় মটকা বা প্ল্যাস্টিকের তৈরি পাত্রগুলোতে। এসব পানি বৃষ্টির সময় ধরে রাখা হয়।
বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আব্দুল ফাত্তাহ বলেন, "বরগুনায় সুপেয় পানির অভাব থাকায় খাবার পানি ও রান্নাবান্নার জন্য পানি সংরক্ষণ করা হয়। বিশেষ করে বৃষ্টির পানি চৌবাচ্চা অথবা প্ল্যাস্টিকের ড্রামে রাখা হয়। এখানে যে উচ্চ মাত্রায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে তা ওই সংরক্ষণ করা পানিতেই। এছাড়া এখানে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই খারাপ।”
"আমার এখানে হাসপাতালে বেড আছে ২৫০ টি। কিন্তু তার চারগুণ রোগী ভর্তি আছে। তার সাথে আছেন তাদের আত্মীয়স্বজন। আমরা চেষ্টা করেই তাদের মশারি ব্যবহারে বাধ্য করতে পারছি না। ফলে এখন হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে তাদের স্বজনরাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন। তারা আবার বাইরে গিয়ে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছেন,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন," আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার টিম এরই মধ্যে বরগুনায় এসেছিল। তারাও পানি জমিয়ে রাখাকে প্রধান কারণ বলেছেন। এখানে সুপেয় পানির আলাদা ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। আর আমার হাসপাতালে আইসিইউ নাই। ফলে রোগীর অবস্থা খারাপ হলে বরিশাল পাঠাতে হয়।”
বরগুনা সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৫ জুন ভর্তি হন কাওসার মিয়া। তার শারীরিক অবস্থা এখন উন্নতির দিকে। তিনি বলেন," আসলে হাসপাতালে অনেক রোগীর ভিড়। সবাই ভর্তিরও সুযোগ পাচ্ছেন না। আমার পরিচিত অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। পৌরসভায় বেশি।
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা ডেঙ্গুর রেডজোন। এই একটি উপজেলার কারণেই এখন পুরো কুমিল্লা জেলা ডেঙ্গুর শীর্ষ জেলাগুলোর মধ্যে একটি। গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে আরো ছয় জন আক্রান্ত হয়েছেন। এনিয়ে জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত একটি উপজেলায়ই আক্রান্তের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে পৌরসভা এলাকায়। আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পৌরসভার ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডকে হটস্পট ঘোষণা করা হয়েছে। রেডজোন চিহ্নিত করা এলাকার ৩ নারী ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হাবিবুর রহমান বলেন," আমার ৫০ বেডের হাসপাতালে আর রোগী ভর্তি করার জয়াগা নাই। বেডের বাইরেও ফ্লোরিং করে কিছু রোগী রাখা হয়েছে।”
তার কথা, "এই এলাকায় আসলে গবেষণা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিম আসলে ভালো হয়। তবে আমাদের যেটা মনে হয়েছে এই পৌর এলাকায় অনেক জায়গায় পানি জমে থাকে। ময়লা আবর্জনায় ভরা। আর কাছে হওয়ায় এখানে অনেকেই প্রতিদিন ঢাকায় গিয়ে অফিস করেন । আবার ফিরে আসেন। সেই কারণেও হতে পারে।”
আগাম ডেঙ্গু
এবার জানুয়ারি থেকেই দেশের ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। জানুয়ারি মাসে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছিলো এক হাজার ১৬১ জন। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে কিছুটা কমলেও এপ্রিল থেকে আবার বাড়তে থাকে। মে মাসে এক হাজার ৭৭৩ জন আর জুনের ১৭ দিনে দুই হাজার ১২১ জন। সামনে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর তীব্রতা আরো বাড়বে বলে ডয়চে ভেলেকে জানান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, "আমরা এত দিন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা কেন্দ্রিক কাজ করেছি। কিন্তু বাংলাদেশে সব জায়গায়ই এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র। ফলে এখন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। আর এডিস মশার প্রজননের জন্য ঢাকার বাইরেও দালান কোঠা, ভবন আছে। আমরা সেগুলোকে গুরুত্ব দেইনি। আর জেলা বা উপজেলার হাসপাতালগুলোর এত রোগী সামাল দেয়ার সক্ষমতা নেই। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ নাই।”
"সামনে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম। গত বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু আরো খারাপ অবস্থায় যাবে বলে আশঙ্কা করছি।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন," গত বছরেই আমরা বলেছিলাম বরিশাল, বরগুনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। এর কারণ হলো, আমরা জরিপ করতে গিয়ে দেখেছি প্রাদুর্ভাব হওয়ার তিনটি উপাদান হোস্ট (মানুষ), প্যাথোজেন (ডেঙ্গু ভাইরাস) এবং এনভায়রনমেন্ট (এডিস মশার প্রজণনের উপযোগী পরিবেশ)- এই তিনটিই অনুকূলে ছিল। তখনই আমরা ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। কিন্তু নেয়া হয়নি।”
কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরীর কথা," ২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারির পর এডিস মশা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এবার এখন পর্যন্ত ৫৮ জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। কিন্তু এডিস মশা প্রতিরোধে ঢাকাসহ কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন ছাড়া আর কোনো উদ্যোগ নেই। আর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগও তেমন কার্যকর নয়। আসলে আমাদের সমন্বিত কোনো ব্যবস্থাপনাই নাই।”
এ বিষয়ে কথা বলতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বার বার ফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।