শিরোনাম
◈ মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখ থেকে বর্ণবাদের দুর্গন্ধ, ইলহান ওমরকে আবর্জনা বললেন ‌ডোনাল্ড ট্রাম্প ◈ বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সারাদেশে দোয়া ও প্রার্থনার আহ্বান জানিয়েছে সরকার  ◈ পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা এনওসি পাচ্ছে না, বিপাকে পড়তে পা‌রে বিপিএল  ◈ বাফুফে ৪ কোটি টাকার বেশি আয় কর‌লো এশিয়ান কাপ বাছাই’র তিন ম্যাচ থেকে ◈ এবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সব কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে রিট ◈ রাজনী‌তি‌তে চল‌ছে সমীকরণ, জোটে যাওয়া নিয়ে এনসিপিতে নানা মত ◈ বিপিএলে নোয়াখালী‌তে খেল‌বেন মোহাম্মদ নবি, সিলেটে সালমান  ◈ বাংলাদেশে পথকুকুর বা বিড়াল হত্যায় কী শাস্তি রয়েছে? ◈ মে‌ক্সি‌কোর বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামের পাশে শত শত ব্যাগে মানুষের দেহাবশেষ উদ্ধার ◈ চি‌কিৎসাধীন খালেদা জিয়ার অবস্থা অপরিবর্তিত, তবে ওষুধে রেসপন্স করছেন

প্রকাশিত : ০৮ নভেম্বর, ২০২৫, ০২:০৭ দুপুর
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১১:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সাফারি পার্ক থেকে রিংটেইলড লেমুর চুরি, সীমান্ত হয়ে বিদেশে পাচার: বন্যপ্রাণী পাচার চক্রে সক্রিয় আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট

বণিক বার্তা প্রতিবেদন: আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কারের একটি বিশেষ প্রাণী রিংটেইলড লেমুর। দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে ২০১৮ সালে বিরল প্রজাতির দুটি রিংটেইলড দেশে আমদানি করা হয়। রাখা হয় গাজীপুর সাফারি পার্কে। পরবর্তী সময়ে প্রাণীগুলো বংশবিস্তার করে। তবে গত বছরের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির সুযোগে গাজীপুর সাফারি পার্ক থেকে তিনটি রিংটেইলড লেমুর চুরি হয়ে যায়।

শুধু রিংটেইলড লেমুরই নয়, নিরাপত্তা দুর্বলতায় চুরি হয়ে যাচ্ছে বিরল প্রজাতির নীলগাই, কচ্ছপ-পাখিও। বিরল প্রজাতির এসব প্রাণী দেশ থেকে চুরি হওয়ার পর ভারতের শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি হয়ে যাচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায়। জীবিত প্রাণীর পাশাপাশি কচ্ছপের হাড়ও পাচার হচ্ছে। গত তিন বছরে শুধু পাচারের সময়ই সীমান্ত থেকে উদ্ধার হয়েছে ২৯৭ কেজি কচ্ছপের হাড়। প্রাণী পাচারের রুট হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে মেহেরপুর, হিলি, শিবগঞ্জ, বুড়িমারী সীমান্ত।

বন্যপ্রাণী চুরি ও পাচার রোধে কাজ করে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। তাদের হিসাবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৪৪টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারিতে ৪৫৮টি, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৪৪, মার্চে ১২১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে ২৭৭, জুনে ১৬৭, জুলাইয়ে ৯৭৮, আগস্টে ৮৫৬ ও সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ১১১টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ, গন্ধগোকুল, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, বানর, তক্ষক, লেমুর, হাতি, ভালুক, হনুমানসহ নানা ধরনের বন্যপ্রাণী। এসব বন্যপ্রাণীর দেশ থেকে চুরি হওয়ার পর সেটি প্রথম গন্তব্য হয় প্রতিবেশী কোনো দেশে। পরে সেখান থেকে চড়া দামে চীন, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ বেশকিছু দেশে পাচার করা হয়েছে। এছাড়া জীবিত প্রাণীর পাশাপাশি কচ্ছপের হাড়, হাঙরের চর্বি ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে থাকে।

গাজীপুর সাফারি পার্ক থেকে চুরি যাওয়া তিনটি রিংটেইলড লেমুরের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের তথ্য বলছে, গত ২৩ মার্চ রাতে গাজীপুর সাফারি পার্কের নিরাপত্তাবেষ্টনী কেটে বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির দুটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রী রিংটেইলড লেমুর চুরির ঘটনা ঘটে। তদন্তে উঠে আসে, ২০১৮ সালে মাদাগাস্কার থেকে দুটি প্রতিষ্ঠান আমদানি, সংরক্ষণ এবং বিক্রয় নিষিদ্ধ দুটি রিংটেইলড লেমুরসহ ৮৬ জোড়া প্রাণী আমদানি করে। পরবর্তী সময়ে প্রাণীগুলোকে গাজীপুর সাফারি পার্কে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রদান করা হয়। দুটি রিংটেইলড লেমুর সাফারি পার্কে আরো দুটি বাচ্চার জন্ম দিলে মোট চারটি লেমুরের আবাসন হয় পার্কে। এর মধ্যে একটি লেমুর মারা যায়।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, গাজীপুর সাফারি পার্কটিতে আউটসোর্সিংয়ে কাজ করতেন নিপেল মাহমুদ। পার্কের ভেতরে তিনি বিভিন্ন দুর্লভ, বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণীদের ছবি এবং ভিডিও ধারণ করতেন। সে ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মের প্রাইভেট গ্রুপ ও পেজগুলোয় পোস্ট করে দেশী-বিদেশী ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। ক্রেতাদের কোনো প্রাণী পছন্দ হলে দরদাম করে মূল্য নির্ধারিত হলে পছন্দকৃত প্রাণীকে চুরি করতেন তিনি।

এভাবেই গত ২৩ মার্চ ভোরে নিরাপত্তাবেষ্টনী কেটে বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির তিনটি রিংটেইলড লেমুর চুরি করে প্রতিবেশী মো. জুয়েল মিয়ার বাড়িতে রাখেন। এর মধ্যে একটি রিংটেইলড লেমুর দেলোয়ার হোসেন তাওসীফ এবং মো. সাব্বির হোসেন তপনের কাছে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন নিপেল মাহমুদ। আরো দুটি লেমুর আছে জানতে পেরে তারা দুজন ভারতীয় ক্রেতার সঙ্গে ৭ লাখ টাকায় বিক্রির জন্য মধ্যস্থতা করে দেয়। পরে দেলোয়ার হোসেন তাওসীফ ও সাব্বির হোসেন তপন দুজন ভারতীয় ক্রেতাসহ ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকা থেকে দুটি লেমুর কার্টনে ভরে ক্রেতাদের গাড়িতে তুলে দেন। এ সময় নিপেলকে ৭০ হাজার টাকা কমিশন হিসেবে দেয়া হয়।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীমউদ্দিন বলেন, ‘গাজীপুর সাফারি পার্কটিতে আউটসোর্সিংয়ে কাজ করা নিপেল মাহমুদ মূলত আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী চুরি ও পাচার চক্রের সদস্য। পার্কের কর্মী হওয়ার সুযোগে খুব সহজেই বিরল প্রজাতির পণ্যের ছবি ও ভিডিও ধারণ করে আন্তর্জাতিক বাজারে ছড়িয়ে দিতেন নিপেল। পরে দরদাম চূড়ান্ত হলে পার্কে সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী চুরি করে আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের হাতে তুলে দিতেন। নিপেলসহ এ চক্রের গ্রেফতার হওয়া ছয় সদস্যই আদালতে দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। চুরি যাওয়া মোট তিনটি রিংটেইলড লেমুরের মধ্যে একটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, বাকিগুলো উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। প্রতারক চক্রটি এভাবে দেশের দুর্লভ, বিপন্ন ও বিরল প্রাণী চুরি করে দেশের বাইরে পাচার করে থাকে মর্মে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।’

ঔষধি কাঁচামাল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে সাপের বিষের চাহিদা রয়েছে। সেই চাহিদার জোগান দিতে আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের সদস্যরা দেশের নানা অঞ্চল থেকে সাপের বিষ সংগ্রহ করছে। আবার কখনো বিভিন্ন দেশ থেকে এ বিষ আসে বাংলাদেশে। সিন্ডিকেটটি বাংলাদেশ থেকে এ বিষগুলো কিনে ভারতে নিয়ে যায়। এরপর ভারত ঘুরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে চলে যায় বহু মূল্যবান এ সাপের বিষ। নানাবিধ কৌশলে তা চীনে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। একপর্যায়ে এই বিষ পৌঁছে যায় চীন কিংবা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। সাপের বিষ উদ্ধারের সময় গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে এসব তথ্য পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশে গত আট বছরে কয়েকশ কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধার করেছে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে সংকট তৈরি হয়েছে তার সূত্র ধরে বিভিন্ন জায়গায় অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। যারা অপরাধ করে থাকে তারা সুযোগ অনুযায়ী অপরাধের মাত্রা বাড়িয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয় হতে না পারার সুযোগ নিয়ে যারা বন্যপ্রাণী চুরি ও পাচার করে তারা আরো বেশি সংগঠিত হয়েছে। দেশ থেকে বিরল প্রজাতির প্রাণী চুরি করে সীমান্ত দিয়ে পাচার করছে। এজন্য সীমান্তে সিসি ক্যামেরাসহ প্রযুক্তিগত তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে দেশের মধ্যে যে চক্রগুলো বন্যপ্রাণী চুরি করে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা এবং বন অধিদপ্তরের সক্রিয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

বন্যপ্রাণী দমন ইউনিটের তথ্য বলছে, গত বছরের নভেম্বরেও ঠাকুরগাঁওয়ের কান্তিভিটা সীমান্ত থেকে উদ্ধার হয় একটি নীলগাই। গত কয়েক বছরে পঞ্চগড়, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁয় পাওয়া গেছে নীলগাই-বনরুইয়ের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। তবে এসব অঞ্চল থেকে নীলগাই বিলুপ্ত হয়েছে ১৯৪০ সালের পর পর। এছাড়া জলপাইগুড়ির গজলডোবায় ২০২২ সালে উদ্ধার হয়েছিল সাতটি ক্যাঙারু। সেগুলো অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশ হয়ে সেখানে গেছে বলে দাবি করেছিল ভারতের গণমাধ্যম। প্রাণী পাচারে ব্যবহার হচ্ছে বালিয়াডাঙ্গী, হিলি, শিবগঞ্জ, বুড়িমারী ও মেহেরপুর সীমান্ত। জলপাইগুড়ি লাগোয়া চিকেন নেক থেকে মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, চীন থাইল্যান্ডসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোয়ও যাচ্ছে এসব প্রাণী।

বন্যপ্রাণী চুরি ও পাচার রোধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার কথা জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘দেশের আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতা বন্যপ্রাণী চুরি ও পাচারের ঘটনাকে কিছুটা প্রভাবিত করছে। এ ধরনের অপরাধ দমনে আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। গত মাসে আমরা ইউএনডিসির আয়োজনে থাইল্যান্ডে একটি বৈঠকে বসেছিলাম। সেখানে ৩২টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। আমরা বিরল প্রজাতির প্রাণী সংরক্ষণে সবার সহযোগিতা চেয়েছি। তারা আশ্বাসও দিয়েছে। পাশাপাশি সাফারি পার্ক থেকে চুরি যাওয়া তিনটি রিংটেইলড লেমুরের মধ্যে একটি উদ্ধার হয়েছে। বাকি দুটি প্রতিবেশী দেশের চোরাকারবারিদের হাতে রয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সব সময়ই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে। বিশেষ করে বন্যপ্রাণী দমন ইউনিটসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে বন্যপ্রাণী পাচার চক্রের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। পাশাপাশি ইন্টারপোলের সঙ্গে সমন্বয় করে আন্তর্জতিক বন্যপ্রাণী চক্রের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়