শিরোনাম
◈ সাগারিকার এক হালিতে বিধ্বস্ত নেপাল, সাফে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ ◈ সুন্দরবনের উপকূলে চার শতাব্দীর পুরনো কালীবাড়ি-শিববাড়ি পরিণত হতে যাচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে ◈ বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের উপকূলে বর্ষায় প্রাণ ফেরে বাধালের নৌকার হাটে ◈ সাপের কামড় খেয়ে সাপ নিয়ে হাসপাতালে হাজির তিনজন ◈ কুড়িগ্রামে বিপৎসীমার অতি কাছে তিস্তা নদীর পানি ◈ উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানে সমস্যা আঁচ করেন পাইলট তৌকির ইসলাম, জানিয়েছিলেন কন্ট্রোল রুমেও ◈ শনাক্ত মৃতেদহ পরিবারের কাছে দ্রুত হস্তান্তর করা হবে: প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ◈ কুড়িগ্রামের ৭ উপজেলায় নির্মিত হচ্ছে সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ ◈ বিমান বিধ্বস্তের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন শিক্ষার্থী (ভিডিও) ◈ বুধবার ইংল‌্যা‌ন্ডের বিরু‌দ্ধে ভার‌তের ঘু‌রে দাঁড়া‌নোর টেস্ট, কেমন হবে ম্যাঞ্চেস্টারের পিচ?

প্রকাশিত : ২১ জুলাই, ২০২৫, ০৪:৩০ দুপুর
আপডেট : ২১ জুলাই, ২০২৫, ০৯:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ইতালির পথে লিবিয়ায় বন্দি সাতক্ষীরার তিন যুবক: মুক্তিপণের দাবিতে দালালচক্রের নির্যাতন

লিবিয়ায় পাচারের শিকার হয়ে অমানবিক নির্যাতনের মধ্যে দিন পার করছেন সাতক্ষীরার তিন যুবক। অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি পৌঁছানোর চেষ্টায় লিবিয়ায় গিয়ে স্থানীয় মানবপাচারকারী ও দালাল চক্রের হাতে বন্দি হয়েছেন তারা। পাচারকারীরা তাদের নির্যাতন করে সেই ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে মুক্তিপণ চাইছে। দরিদ্র পরিবারগুলো চাহিদামতো মুক্তিপণ না দেওয়ায় প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা।

বন্দি তিন যুবক হলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের রেজোয়ান ও আবু শহিদ গাজী এবং বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের রমজান। উন্নত জীবনের আশায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তারা একই ফ্লাইটে পাঁচটি দেশ ঘুরে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় যান।

পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ছেলেরা ফোন করে জানান, তারা অমানবিক নির্যাতনের মধ্যে আছেন। ঠিকভাবে খাবার দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিদিন শরীরে আঘাত করা হচ্ছে এবং টাকার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।

পরিবারের অভিযোগ, মানবপাচারকারী চক্রের ফাঁদে পড়ে প্রতিটি পরিবার দালালদের হাতে ১৮ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছে। সবকিছু বিক্রি করে, ধারদেনা করে এই টাকা জোগাড় করেছে পরিবারগুলো। এখন তারা নিঃস্ব। বাঁচাতে চাইছে কেবল তাদের সন্তানদের প্রাণ।

লিবিয়া থেকে পাচারকারীরা তিন যুবকের হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করে সেই ভিডিও পাঠাচ্ছে পরিবারের কাছে। শারীরিক নির্যাতনের সেই দৃশ্য দেখে ভেঙে পড়ছে পরিবারগুলো।

নির্যাতনের একটি ভিডিও এসেছে জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকের হাতে। সেখানে দেখা গেছে, তিন যুবকের একজন আবু শহিদ গাজীর হাত-পা বেঁধে মারা হচ্ছে। তিনি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।

এই ভুক্তভোগীর ভাই শহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই নির্যাতন শুরু হয়। এই চিত্র আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। প্রতিদিন ওদের নির্যাতনের শব্দ রেকর্ড করে পাঠায়। আমরা ওদের কান্নার শব্দ শুনতে পাই। দালালদের মধ্যে মাত্র দুজনকে ধরেছে পুলিশ। এখনো অনেক দালাল বাইরে। আমরা কিচ্ছু চাই না, শুধু ভাইদের ফেরত চাই।’

মানবপাচার ও অপহরণের পেছনে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের মুকুল সানা নামের একজন রয়েছে জানিয়ে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মুকুল দালাল সবকিছুর মূলে রয়েছে। তিনি দুবাই থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এখানে ছয় থেকে সাতজনের একটা টিম তার জন্য কাজ করে। এই কাজে সহযোগিতা করেন তার দুলাভাই রেজাউল ও তার স্ত্রী মোমেনা বিবি। তারা অনেক টাকা-পয়সা খেয়ে মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় পাঠিয়ে অপহরণ বাণিজ্য করে।’

ভুক্তভোগী এসব পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রেজোয়ান, শহিদ গাজী ও রমজান একই ফ্লাইটে প্রথমে শ্রীলঙ্কায় যান। সেখান থেকে চারটি দেশ ঘুরিয়ে তাদের লিবিয়ায় পাঠায় দালাল চক্র।

ভুক্তভোগীদের সবাই জমি বিক্রি, জমানো ও ঋণ করে টাকা সংগ্রহ করেন। দালালচক্র লিবিয়ায় পৌঁছানো পর্যন্ত জনপ্রতি ১৪ লাখ টাকা করে নেয় বলে তাদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শহিদুল বলেন, ‘ওরা লিবিয়ায় পৌঁছানোর ১৫ দিন পরই আমাদের কল দিয়ে কষ্টের কথা জানায়। এর আগে আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। মুকুল ও তার স্থানীয় সহযোগীরা আমাদের কাছে ১৭ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে আমার ভাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেন। প্রাণ বাঁচাতে আমি দুই লাখ টাকা জোগাড় করে দিই। এরপর কিছুদিন ভালো থাকলেও আবারও ফোন দিয়ে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। হাতের নখ তুলে ফেলা ও মারধরের ভিডিও আমাদের দেখানো হয়। পরে পাঁচ লাখ টাকা দেই মুকুল দালালের শ্যালক শাহিনুরের হাতে। আমরা তিন পরিবার এ পর্যন্ত ২০ লাখ টাকা করে দিয়েছি।’

‘এখনো প্রতিনিয়ত নির্যাতনের ছবি, ভিডিও ও তাদের আর্তনাদের চিত্র রেকর্ড করে আমাদের কাছে পাঠায়। এসব দেখে আমরা আর সহ্য করতে পারছি না। টাকাও জোগাড় করতে পারছি না।’ বলছিলেন মানবপাচারের শিকার আবু শহিদ গাজীর ভাই।

লিবিয়ায় বন্দি ও নির্যাতনের শিকার রেজোয়ানের ভাই আব্দুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে গেছি। আমরা টাকা জোগাড় করতে পারছি না। আমরা ভাইকে ফের‍ত চাই। মুকুল দালাল আর তার সহযোগীদের শাস্তি চাই।’

এ ঘটনায় মুকুলসহ সাতক্ষীরার ১৫ জনের বিরুদ্ধে শ্যামনগর থানায় মানবপাচার আইনে মামলা করেছে তিনজনের পরিবার। এই মামলার তদন্ত করছে সাতক্ষীরার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আসামিরা হলেন শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালী গ্রামের মুকুল সানা, হাকিম সানা, সিরাজুল ইসলাম, হালিমা ইসলাম, ছাবিনা খাতুন, আরিফুল ইসলাম, মাজেদ ও হেলাল, শৈলখালী গ্রামের মোমেনা বিবি, মামুন, মোনাজাত ও রেজাউল, ঘুমানতলী গ্রামের ফিরোজ মোল্লা ও মোসাম্মৎ বকুল খাতুন এবং সাহেবখালী গ্রামের আজিজুল গাজী। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআই সাতক্ষীরা জেলার পুলিশ পরিদর্শক অনিমেশ কুমার মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুজন গ্রেফতার হয়েছে। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। দালাল ও ভুক্তভোগী সবাই পাশাপাশি এলাকার। দালাল মুকুলের পাসপোর্ট, এনআইডি সব তথ্য ইমিগ্রেশনে দিয়েছি। ভুক্তভোগীদের অবস্থার বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

অভিযুক্ত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জাগো নিউজ। সবার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। দুবাইয়ে অবস্থানরত মুকুলকে ইমোতে কল দিয়ে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

জানা গেছে, লিবিয়ার ত্রিপোলি, বেনগাজী ও মিশ্রতা শহরের তিন ক্যাম্পে এখনো ৫০০’র বেশি বাংলাদেশি আটক রয়েছে। তাদের ওপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন। ভয়ংকর এই মাফিয়া চক্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িত লিবিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মিলিশিয়া গ্রুপ। মুক্তিপণের দাবিতে তারা শুধু বন্দিদের হাত-পা বেঁধে নির্যাতনই নয়, ঠিকমতো খেতেও দেয় না। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মারাও গেছেন অনেকে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ প্রবেশে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ২০২২ সালে ছিল তৃতীয়। ২০২১ সালে এ তালিকায় শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। ২০২০ সালে ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। সবশেষ ২০২৪ সালে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে দুই হাজার ৬৭০ জন সমুদ্রপথে ইউরোপে প্রবেশ করেন। গত বছর ওই সময় সমুদ্র পথে ইউরোপ যাত্রায় বাংলাদেশ ছিল সর্বোচ্চ।

২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালিতে সমুদ্রপথে পৌঁছায় ছয় হাজার ৮০৮ জন। যার মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৫৮৯ জন বা প্রায় ৪২ শতাংশ।

অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া হয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানোর প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। বিদেশগামীদের অসচেতনতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঘটনাও উদ্বেগজনক। অন্যদিকে বৈধ পথের সীমাবদ্ধতা ও দালালচক্রের প্রলোভন যাত্রার পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে।

তারা আরও বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধি, দালালচক্র নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত না করলে এমন ঘটনা বাড়তে থাকবে।

অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইতালি যেতে গিয়ে লিবিয়ায় এত নির্যাতন, মানুষের লাশ পর্যন্ত আসছে; তবু মানুষ উচ্চস্বপ্ন দেখে এই অবৈধ পথে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে পা বাড়াচ্ছে। মানবপাচার আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে রুট লেভেল থেকে এসব দালাল ও প্রলোভনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে ইউরোপে বৈধ শ্রমবাজার খুলতে হবে, দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে হবে। লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়া-এই ট্রেন্ডের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করতে হবে।’ উৎস: জাগোনিউজ24

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়