৭০টি ইন্টারসেকশনে পরিবর্তন, ভিডিও ও ডিজিটাল মামলাসহ প্রধান সড়কগুলোর মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নতুন করে ঢেলে সাজানোর কারণে ঢাকার রাস্তার চিরচেনা যানজটের চিত্র অনেকটা বদলে গেছে। গত বছরের তুলনায় ঢাকার রাস্তায় যান চলাচলের গতি দ্বিগুণ বেড়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। ২০০৬ সালে ঢাকার রাস্তার গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। সেটা কমতে কমতে গত বছর ২০২৪ সালে ৫ কিলোমিটারে নেমে আসে। এ বছর সেই গতি বেড়ে ১০ কিলোমিটার হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের তুলনায় যানজটও অনেকটাই কমে এসেছে বলে ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান।
রাজধানীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক ইন্টারসেকশন বা মোড় হলো কারওয়ানবাজার ও শাহবাগ। এই দুটি মোড়ে সবসময় যানজট লেগেই থাকে। এ দুটি স্থানে যানজট কমাতে এবং যানবাহনের গতি বাড়াতে ইন্টারসেকশন নতুন করে বিন্যাস করা হয়েছে। এতে ঢাকার কারওয়ানবাজারে দুটি এবং শাহবাগে একটি রাস্তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই দুই জায়গায় নতুন করে করা হয়েছে দুটি ইউটার্ন। এতে চিরচেনা যানজটের চিত্র বদলে গেছে। এই দুই মোড়েই যানবাহনে গতি বেড়েছে। এ ছাড়া আগের তুলনায় কম সময় লাগছে মোড় পার হতে।
কারওয়ানবাজার মোড়ে প্রতিদিন যানবাহনের চাপে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তীব্র যানজটে আটকে থাকতে হতো ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত। এখানকার চারটি সড়কে ছিল আলাদা আলাদা সিগন্যাল। এক সড়কের যান চলাচল উন্মুক্ত করলে বন্ধ রাখতে হতো বাকি তিন সড়ক। ফলে অফিসে যাওয়া-আসার সময় যানবাহনের দীর্ঘ সারি কখনও কখনও শাহবাগ পর্যন্ত পৌঁছে যেত। পান্থপথ থেকে আসা সিগন্যালটি তিন সপ্তাহ আগে বন্ধ করে দিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ। এর বিকল্প হিসেবে পান্থপথ থেকে মতিঝিল বা শাহবাগমুখী যানবাহনগুলোর জন্য কারওয়ানবাজার ওয়াসা ভবনের সামনে থেকে করা হয়েছে ইউটার্ন। ফলে ফার্মগেট ও শাহবাগে আসা-যাওয়ার পথে আগের মতো যানজটের ভোগান্তি নেই। দীর্ঘক্ষণ এই মোড়ে যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে না। এই মোড়ের নিউমার্কেটমুখী সড়কটিও বন্ধ করা হয়েছে। ফলে হাতিরপুল রোডেও চিরচেনা যানজট নেই।
একইভাবে শাহবাগে বারডেম হাসপাতালের সামনের সিগন্যালটিও বন্ধ করা হয়েছে। ঢাকা ক্লাবের সামনে করা হয়েছে ইউটার্ন। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও কাঁটাবনমুখী যানবাহনগুলোকে ঢাকা ক্লাবের ইউটার্ন থেকে ঘুরে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। এতে শাহবাগ মোড়ে যানবাহনের গতি বেড়েছে। তেমনিভাবে নিউমার্কেট থানা মোড় থেকে নিউমার্কেটগামী যানবাহনগুলোকে এখন ইডেন কলেজের সামনের ইউটার্ন থেকে ঘুরে আসতে হচ্ছে। নীলক্ষেত মোড়ে এই সড়কটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে নীলক্ষেত মোড়ে একটি সিগন্যাল কমে গাড়ির গতি বেড়েছে।
অনুরূপভাবে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ৭০টি ইন্টারসেকশন
নতুন করে বিন্যাস করার ফলে যানবাহনের গতি বেড়েছে। পাশাপাশি যানজটও কমে গেছে। গত জানুয়ারি মাসে মো. সরওয়ার (বর্তমানে অতিরিক্ত কমিশনার, প্রশাসন) ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবে যোগদানের পর রাজধানীর যানজট কমাতে এবং যানবাহনের গতি বাড়াতে ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করেন। ভিডিও এবং ডিজিটাল মামলা বৃদ্ধির পাশাপাশি তিনি রাজধানীর ৭০টি ইন্টারসেকশন নতুন করে বিন্যাস করেন। যেখানে ৪টি সিগন্যাল সেখানে একটি বা দুটি সিগন্যাল বন্ধ করে দেন। এ ছাড়া ইউটার্ন বৃদ্ধি করেন। এতে প্রতিটি মোড়ে যানবাহন যানজটে আটকে থাকার সময়সীমা কমে গেছে। পাশাপাশি গাড়ির গতিও বেড়েছে। এসব ইন্টারসেকশনে এখন আগের তুলনায় ট্রাফিক বিভাগের কম জনবল লাগছে।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. সরওয়ার গত রবিবার আমাদের সময়কে বলেন, ৭০টি ইন্টারসেকশন মোডিফাই করাসহ ট্রাফিক বিভাগের নতুন কিছু উদ্যোগ যানজট কমাতে যেমন ফল মিলছে, তেমনি গাড়ির গতিও বেড়েছে। ২০০৫-০৬ সালে ঢাকার সড়কের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। সেটা কমতে কমতে ২০২৪ সালে এসে ৫ কিলোমিটারে এসে ঠেকে। আমাদের নতুন কিছু উদ্যোগ বিশেষ করে বিভিন্ন জায়গায় ট্রাফিক ফ্লো বা ডাইভারশন বা মেডিফিকেশন করার ফলে এখন গতি আবার বেড়ে ১০ কিলোমিটার হয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের ফলে গত বছরের চেয়ে এ বছর ঢাকার রাস্তার গতি বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, তেজগাঁও লাভ রোড থেকে র্যাংগস ফ্লাইওভার হয়ে যারা বিজয় সরণি পার হতেন তাদের দুটি সিগন্যালে দাঁড়াতে হতো। কিন্তু এখন সেসব যানবাহনগুলোকে লাভ রোড মোড় থেকে বামে কিছুটা গিয়ে ইউটার্ন করে র্যাংগস ফ্লাইওভারে উঠতে হচ্ছে। এরপর যানবাহনগুলোকে বিজয় সরণি মোড় থেকে বামের লেন ধরে ফার্মগেট থেকে ঘুরে বিজয় সরণি পার হতে হচ্ছে। বিজয় সরণি মোড়ের পূর্বপাশে তেজগাঁওমুখী সিগন্যাল বন্ধ করে দেওয়ার ফলে দুটি সিগন্যাল কমে গেছে। এতে লাভ রোড এবং বিজয় সরণি মোড়ে যানবাহনের গতি বেড়েছে। যানজটও কমেছে বলে একাধিক চালক ও যাত্রী আমাদের সময়কে জানান।
রাজধানীর বনানী সিগন্যাল বন্ধ করে একমুখী সড়ক চালুর পর সড়কজট কমে এসেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। আগে যেখানে মহাখালী থেকে বনানী পৌঁছাতে তিন-চারটি সিগনালে ২০ থেকে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হতো, এখন সেই চিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে।
মহাখালী থেকে বনানী কাঁচাবাজার সড়ক মাঝপথে বন্ধ করায় যান চলাচলে গতি ফিরে এসেছে। সিগন্যাল তুলে দেওয়ায় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদেরও স্বস্তি মিলছে। এখন কাকলী-মহাখালী রুটেও আগের তুলনায় যানজট অনেকটাই কমে এসেছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক মো. রাসেল জানান, ট্রাফিক বিভাগের নতুন কিছু উদ্যোগের ফলে বিজয় সরণি, কারওয়ানবাজারসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক মোড় পার হতে এখন আগের তুলনায় কম সময় লাগছে। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি কমেছে। পাশাপাশি আগের চেয়ে কম সময়ে নির্ধারিত গন্থব্যে পৌঁছানো যাচ্ছে। সূত্র : দৈনিক আমাদের সময়