সাধারণ তেলাপিয়া মাছের চামড়া ব্যবহার করে ব্যথাহীন ও সাশ্রয়ী এই চিকিৎসা পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে পোড়া রোগীদের জন্য নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে।
যে তেলাপিয়া মাছ আমাদের খাবার টেবিলের সাধারণ একটি পদ, সেই মাছের ত্বকই এখন গুরুতর পোড়া ক্ষতের চিকিৎসায় বিস্ময়কর সাফল্য এনেছে। ব্রাজিলের একদল গবেষক তেলাপিয়া মাছের চামড়া ব্যবহার করে পোড়া রোগীদের জন্য একটি যুগান্তকারী, সাশ্রয়ী এবং কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এই অভিনব পদ্ধতিটি কেবল রোগীর ব্যথা কমাচ্ছে না, বরং প্রচলিত চিকিৎসার ব্যয়বহুল ও জটিল প্রক্রিয়াকে সহজ করে তুলেছে। পরিবেশবান্ধব এই সমাধানটি বিশ্বজুড়ে পোড়া চিকিৎসার未来 বদলে দিতে পারে।
ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব সিয়ারার গবেষক ডা. এডমার ম্যাসিয়েলের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী ২০১৫ সালে এই যুগান্তকারী ধারণাটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পোড়া ক্ষতের প্রচলিত চিকিৎসায় ব্যবহৃত গজ, ক্রিম, এমনকি মানুষের বা শূকরের ত্বক বেশ ব্যয়বহুল এবং সহজলভ্য নয়। এই সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করতেই বিজ্ঞানীরা বিকল্প সমাধান হিসেবে তেলাপিয়া মাছের চামড়ার দিকে ঝোঁকেন। তেলাপিয়া মাছের খামার থেকে পাওয়া এই চামড়া একটি বর্জ্য পণ্য, যা খুব কম খরচে প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব।
এই পদ্ধতিতে তেলাপিয়া মাছের চামড়াকে জীবাণুমুক্ত করে একটি জৈব ব্যান্ডেজ হিসেবে পোড়া ক্ষতের উপর লাগানো হয়। এর কার্যকারিতার মূল কারণ হলো:
উচ্চ কোলাজেন: তেলাপিয়ার চামড়ায় প্রচুর পরিমাণে টাইপ-১ কোলাজেন প্রোটিন থাকে, যা মানুষের ত্বকের গঠনের জন্য অপরিহার্য। এই কোলাজেন নতুন কোষ তৈরিতে সাহায্য করে এবং ক্ষত নিরাময় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
আর্দ্রতা ধরে রাখা: এই চামড়া ক্ষতের উপর একটি প্রাকৃতিক আস্তরণ তৈরি করে, যা আর্দ্রতা ধরে রাখে। ফলে ক্ষতস্থান শুষ্ক হয় না এবং রোগীর ব্যথাও অনেক কম হয়।
ব্যথাহীন ও সুবিধাজনক: প্রচলিত ব্যান্ডেজের মতো এটি প্রতিদিন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। জীবাণুমুক্ত চামড়াটি ক্ষতের উপর প্রায় ১০ দিন পর্যন্ত থাকে এবং ক্ষত শুকিয়ে এলে এটি নিজে থেকেই আলগা হয়ে যায়, ফলে রোগীকে বাড়তি যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় না।
ডা. ম্যাসিয়েলের গবেষণায় ১১৫ জন পোড়া রোগী অংশ নেন। তাদের অর্ধেককে প্রচলিত ক্রিম ও গজ দিয়ে এবং বাকি অর্ধেককে তেলাপিয়ার চামড়া দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। ফলাফল ছিল অভাবনীয়।
দ্রুত নিরাময়: তেলাপিয়া গ্রুপের রোগীদের ত্বক সেরে উঠতে গড়ে ১.৪৩ দিন কম সময় লেগেছে।
কম সরঞ্জামের ব্যবহার: তাদের গড়ে ৩.৭২টি কম ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করতে হয়েছে।
গাড়ির মেকানিক আন্তোনিও জানিও, যার হাত ঢালাই গ্যাস বিস্ফোরণে পুড়ে গিয়েছিল, তিনি বলেন, "আমি কোনো ওষুধ ছাড়াই সম্পূর্ণ ব্যথামুক্তভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছি। এটা এক কথায় অসাধারণ!" আরেক রোগী জোসুয়ে বেজেরা জুনিয়র জানান, "আমাকে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথার ওষুধ নিতে হয়নি এবং মাত্র ১৩ দিনেই আমার ক্ষত সেরে গিয়েছিল।"
তেলাপিয়ার চামড়া প্রচলিত অন্যান্য জৈব ব্যান্ডেজের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ ও সুবিধাজনক। শূকর বা ব্যাঙের চামড়া ব্যবহারে পশুজনিত রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। অন্যদিকে, মানুষের ত্বক পেতে দাতার উপর নির্ভর করতে হয়, যা সহজলভ্য নয়। কিন্তু তেলাপিয়া মাছের চামড়া সহজলভ্য, বর্জ্য থেকে তৈরি এবং এতে সংক্রমণের ঝুঁকি নেই। এটি দুই বছর পর্যন্ত ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যায়।
ব্রাজিলে ইতিমধ্যে ৫০০ জনেরও বেশি পোড়া রোগীকে এই পদ্ধতিতে সফলভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এই পদ্ধতিটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালের শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং ব্রাজিল সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অনুমোদন পেলে এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হবে এবং চিকিৎসা খাতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।
আমেরিকান বার্ন অ্যাসোসিয়েশনের মতে, প্রতি বছর প্রায় ৪,৫০,০০০ পোড়া রোগীর চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, যার একটি বড় অংশই নিম্ন ও মধ্যম-আয়ের দেশে। তেলাপিয়ার ত্বকের এই সাশ্রয়ী ও কার্যকর ব্যবহার বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ পোড়া রোগীর জন্য আরও আরামদায়ক ও দ্রুত নিরাময়ের পথ খুলে দেবে। তথ্যসূত্র: এনবিসি নিউজ, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস