মহসিন কবির: ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিকদগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে লেভেল প্লেইং ফিল্ড থাকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে রাজনৈতিক নেতারা। প্রতিদিন দলগুলো এমন আশঙ্কার কথা বলছেন।
এদিকে ভূ-রাজনৈতিক কারণে অনেক দেশের চোখ এখন বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে। তাই আগামী নির্বাচনে শুধু ভোটারদের আস্থা ফেরানোই নয়, আরও অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আগামী নির্বাচন নিয়ে কর্মপরিকল্পনা সাজানো হয়েছে।
সে অনুযায়ী কাজও চলছে। সরকারের তরফ থেকে ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে ভোট হতে পারে- এমন একটি বার্তা ইসির কাছে রয়েছে। নির্বাচন প্রশ্নহীন করতে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম- ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো, অন্তর্র্ভুক্তিমূলক নির্বাচন, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ, বিশ^াসযোগ্য পর্যবেক্ষক সংস্থার অনুমোদন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, কেন্দ্র প্রস্তুত করা, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, ভোটার উপস্থিতি।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের প্রতিটি কাজই চ্যালেঞ্জের। তবে এই নির্বাচন কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ ভোটারদের আস্থা ফেরানো। গত তিনটি নির্বাচন যেভাবে একতরফা হয়েছে তাতে মানুষ ভোট দেওয়ার সংস্কৃতি ভুলে গিয়েছিল। তাই আগামী নির্বাচনে ভোটররা যাতে নির্ভয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে আরও একটি বড় কাজ হচ্ছে নির্ভুল ভোটার তালিকা। অতীতে মৃত ব্যক্তিরও ভোটার তালিকায় থাকা নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। তা ছাড়া একজনের ভোট অন্যজনের দিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিও ছিল। তা ছাড়া আগের রাতে ভোটের বাক্স ভর্তির অভিযোগও ছিল বিগত নির্বাচনে। এসব কলঙ্ক কাটিয়ে আগামী
নির্বাচন হবে ঘুরে দাঁড়ানোর নির্বাচন। মানুষের মাঝে আবার ভোটের সংস্কৃতি ফিরে আসবে। দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা সুসংহত হবে। এটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ভোট সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব থাকে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীর ওপর। গত বছর জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে বিগত সরকারের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে পুলিশ যেভাবে জনগণের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, তাতে এখনও সাধারণ মানুষ পুলিশকে আস্থায় নিতে পারেনি। তা ছাড়া পুলিশ তাদের হারানো মনোবল ফিরে পায়নি। তাই নির্বাচনের আগে পুলিশের মনোবল ফেরানো ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আগামী নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। এতে প্রার্থীদের বিরোধী নানা অপপ্রচারের একটা সুযোগ দেখছেন অনেকে। তাই সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা ইসির কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে বলেও মনে করেন অনেকে।
আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া তিনটি নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং মাঠ প্রশাসনের সহায়তায় কালো টাকার প্রভাবে অজনপ্রিয় ব্যক্তিও অর্থের প্রভাবে সংসদ সদস্য হয়েছেন। যার ফলে জনগণের আস্থার প্রতিফলন ঘটেনি। এবারের নির্বাচনে সেই প্রভাব কতটা কাটিয়ে ওঠা যাবে তা নিয়েও রয়েছে না বিশ্লেষণ।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অপ্রাসঙ্গিক হলেও তাদের সমর্থকদের ভোট পড়বে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন আশা করেন, আওয়ামী লীগ না থাকলেও তাদের সমর্থকরা ভোট দিতে আসবেন।
আওয়ামী লীগ না থাকলে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কিনা- এ প্রশ্নে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে, স্বাভাবিক। আমাদের চিন্তা হলো- যারা ভোটার আছেন, তারা অংশগ্রহণ করেন কিনা। আমরা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে চাই। এখন ইনক্লুসিভের ডেফিনিশন তো একেক জনের কাছে একেক রকম। আমার কাছে মনে হয়, ভোটাররা অংশগ্রহণ করলেই অন্তর্র্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে।
বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের কোনো একটি দল ভোটে না থাকলে সেই নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কিনা, সে নির্বাচন নিয়ে অন্যান্য রাষ্ট্র প্রশ্ন তুলবে কিনা- জানতে চাইলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম আমাদের সময়কে বলেন, জুলাই গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করেছে সরকার। সেটা এখন আদালতের ওপর নির্ভর করছে। তাই আওয়ামী লীগকে ভোটে রাখা না রাখা সম্পূর্ণ আদালতের ওপর নির্ভর।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে কি হবে?
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের লল্ডন বৈঠকের পর আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বচনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেকথা শর্তযুক্ত, যদি ও কিন্তু আছে। এ কারণেই নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের ওপর ভরসা রাখছে পারছে বিএনপিসহ সমমনাদলগুলো। দলগুলো চায় নির্দিষ্ট তারিখ ও রোডম্যাপ। কিন্তু সরকারের তাতে সায় নেই। চলছে সংস্কারের সংলাপ। কতটুকু এতমত হতে পারবে রাজনৈতিকদলগুলো, সেটা নিয়েও শংসয় রয়েছে। তাই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন দেশে বিশৃঙ্খলা হতে পারে। তাতে ফ্যাসবাদীরা আবার উকি দিতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে মনে করে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে একটি মহল দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। এই অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করে দলটি।
গত বুধবার রাতে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সভায়, দেশের চলমান পরিস্থিতি বিশেষ করে গত বুধবার গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির সমাবেশে আওয়ামী লীগের হামলা, সংঘর্ষে হতাহত, সেনাবাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি রাজনীতির মিটফোর্র্ডের নৃশংস হত্যাকা-, কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শিষ্টাচার বিবর্জিত বক্তব্য ও সেøাগান দেওয়া এবং অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক প্রতিশ্রুত আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আগের দিন অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে।
পার্টির সভায় ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্ত ও সমর্থকদের হামলায় চারজন নিহত হওয়ায় গভীর নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। সভা মনে করে, পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সমর্থকরা পরিকল্পিতভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্য ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনকারী জাতীয় নাগরিক পার্টির সমাবেশে আক্রমণের ঘটনা ঘটায়। ফলে সরকারকে ১৪৪ ধারা ও কারফিউ জারি করতে হয়, যা এই মূহূর্তে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার নীলনকশা বলে মনে করা হয়। এই প্রসঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করা হয় সভায়। সভা আশা করে, রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করবে, অন্যথায় গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিকে সুযোগ করে দেওয়া হবে।
দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বলা হয়, অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় যে, গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ বিঘ্নিত করতে এবং আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিশ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ব্যাহত করতে একটি মহল পরিকল্পিতভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। মবোক্রেসি, হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো অযোগ্যতা এবং নির্লিপ্ততা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা গণমাধ্যমে শুধু কথাই বলছেন কিন্তু কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য অতিদ্রুত সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে আহ্বান জানানো হয় সভায়।
সভায়, সম্প্রতি সংঘটিত মিটফোর্ডের নৃশংস হত্যাকা-ে বিএনপিকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে জড়িয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শিষ্টাচারবিবর্জিত বক্তব্য ও সেøাগান গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। বিশেষ করে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, বিএনপি চেয়ারপারসন, গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের তরুণ জনপ্রিয় নেতা তারেক রহমান সম্পর্কে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বিবর্জিত যেসব অশ্লীল বক্তব্য ও সেøাগান দেওয়া হয়েছে তা গোটা জাতিকে বিক্ষুব্ধ করেছে। এসব কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানায় সভা।
সভা মনে করে, এই ধরনের কর্মকা- শুধু রাজনৈতিক পরিবেশকেই বিনষ্ট করবে না, গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে। সভা আশা করে, ব রাজনৈতিক দল পারস্পরিক মর্যাদা ও সৌহার্দের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে এই ধরনের অরাজনৈতিক কর্মকা- থেকে বিরত থাকবে। সেই সঙ্গে মিডফোর্ডসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানায় এবং অবিলম্বে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় সভায়।
সভায় বিএনপি মহাসচিব ছাড়াও জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম ও অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন।