শিরোনাম

প্রকাশিত : ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০২:৫৮ দুপুর
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১১:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

রাবিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা: রাকসু জিএস আম্মারকে ঘিরে সংঘর্ষ, আলটিমেটাম ও তালাবন্দিতে উত্তপ্ত ক্যাম্পাস

চব্বিশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো ও রাজনৈতিক চর্চায়ও বড় ধরনের রদবদল দেখা যাচ্ছে। তার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি)। পোষ্য কোটা ইস্যুতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংঘর্ষ, আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ও ডিনদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন, ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে উসকানি, হুমকিসহ ধারাবাহিক ঘটনায় কয়েক মাস ধরে অস্থিরতার কেন্দ্রে রয়েছে এই বিদ্যাপীঠ। এসব ঘটনার অধিকাংশের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সালাহউদ্দিন আম্মারের নাম উঠে এসেছে। সূত্র: কালবেলা প্রতিবেদন

পোষ্য কোটা ইস্যুতে সংঘর্ষ: চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য ১০টি শর্তে পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এর ধারাবাহিকতায় ২১ সেপ্টেম্বর বিকেলে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন প্রশাসন ভবন থেকে গাড়ি নিয়ে বের হলে শিক্ষার্থীরা তার গাড়ি আটকে দেন।

প্রায় ২০ মিনিট তাকে গাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে তার বাসভবনের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। এতে উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জুবেরী ভবনের সামনে গেলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাঈন উদ্দীনের গলা চেপে ধরে সিঁড়িতে ফেলে দেওয়া এবং উপ-রেজিস্ট্রার রবিউল ইসলামের দাড়ি ধরে টান দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ভিডিওতে এসব চিত্র ধরা পড়ে। এসব ঘটনায় সাবেক সমন্বয়ক ও বর্তমান রাকসু জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ ওঠে।

ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম কর্মবিরতির ডাক দেয়। অফিসার্স সমিতি ক্যাম্পাস শাটডাউন ঘোষণা করলে কয়েকদিন কার্যত অচল হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। পরে ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। ফলে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আম্মার।

ডিনদের পদত্যাগের আলটিমেটাম ও তালা: আওয়ামীপন্থি ডিনদের পদত্যাগ এবং ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অপসারণের দাবিতে ‘অপারেশন জিরো টলারেন্স ফর ফ্যাসিজম’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার। মেয়াদ শেষ হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীপন্থি ডিনদের পদত্যাগের জন্য সময় বেঁধে দেন তিনি। গত ১৮ ডিসেম্বর দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ও ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ’ নামের গ্রুপে পোস্ট দিয়ে তিনি এ আলটিমেটাম দেন।

পরে গত ২১ ডিসেম্বর ছয় ডিনের কেউ ক্যাম্পাসে না থাকায় গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে একে একে তাদের ফোন করেন আম্মার। একই সঙ্গে তাদের উদ্দেশে লেখা পদত্যাগপত্রও প্রকাশ করেন। এরপর তাদের পদত্যাগের দাবিতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, রেজিস্ট্রারসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে ডিনস কমপ্লেক্সে এবং পরে প্রশাসন ভবনে তালা দেওয়া হয়। দিনভর উত্তেজনার পর সন্ধ্যায় ডিনদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় প্রশাসন।

এর আগে, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুতে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পক্ষে যারা নমনীয়তা উৎপাদন করবে, আমরা তাদের জুতা খুলে মুখে মারব ইনশাআল্লাহ। রাবিতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি চাকরি করে, তাদের প্রশাসনিক ভবনের সামনে বেঁধে রাখব।’

শিক্ষকদের নিরাপত্তা দাবি: ক্যাম্পাসে মব সৃষ্টি করে শিক্ষক অবমাননা ও তাদের হেনস্তার অভিযোগ তুলে শিক্ষকদের নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছে বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের তিনটি সংগঠন। একই সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হামলাকারী শিক্ষকদের বিচার ও জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছে তারা। গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনে উপাচার্যের সম্মেলন কক্ষে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় শিক্ষকরা উপাচার্যের কাছে এসব বিষয় তুলে ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

শিক্ষকদের তিনটি সংগঠন হলো বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম, ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) ও জিয়া পরিষদ।

বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি রাকসুর জিএস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্দেশে অশালীন ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন। পাশাপাশি যখন-তখন বিভিন্ন দপ্তরে তালা লাগিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণের মাধ্যমে পুরো ক্যাম্পাসে ভীতিকর ও নৈরাজ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

এদিকে, নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন রাবির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদ। গত ২১ ডিসেম্বর নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ ঘোষণা দেন।

অরাজক পরিস্থিতির অভিযোগ ছাত্রদলের: আওয়ামীপন্থি ছয় ডিনের পদত্যাগের ঘটনাকে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করার অপচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে শাখা ছাত্রদল। ২১ ডিসেম্বর রাতে দেওয়া এক বিবৃতিতে তারা জানায়, ক্যাম্পাসে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি কুচক্রী মহল ষড়যন্ত্র করছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মারের হুমকিমূলক বক্তব্য শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি অশোভন ও অছাত্রসুলভ আচরণের বহিঃপ্রকাশ। একজন ছাত্রনেতার কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ জ্ঞানচর্চার পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।’

উদ্বিগ্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা: অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী নোমান ইমতিয়াজ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মূলত পড়াশোনার জায়গা। কিন্তু বর্তমানে ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে সেটা বলা মুশকিল। এখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ছাত্র প্রতিনিধিরা প্রত্যেকে নিজের দায়িত্ব ভুলে ভিন্ন কাজে বেশি আগ্রহী। একাডেমিক প্রশাসন ও রাকসু—সবই জাতীয় রাজনীতির অংশ হয়ে গেছে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না।’

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘পড়ালেখার পরিবেশ বাস্তবেই বিঘ্নিত হয়েছে। মতাদর্শিক অবস্থান থাকবে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। কিন্তু সেটা দিয়ে যদি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং তা কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছ থেকে আসে, তাহলে সেটা খুবই উদ্বেগজনক।’

ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, ‘ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি আমি ভালো বলতে পারছি না এ মুহূর্তে।’

যা বললেন আম্মার: সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘আমি ক্যাম্পাসে যা করি সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্যই করি। অধিকাংশ শিক্ষার্থী যেটা সমর্থন করে, আমি সেটাই করি। আমি জানি শেষ পর্যন্ত হয়তো সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে পারব না। কিন্তু আমি শিক্ষার্থীদের জন্য যা করে যাব, সেটাই থেকে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য যখনই কিছু করতে চাই, তখনই একটা পক্ষ বিরক্ত হয়। কখনো বিএনপিপন্থি, কখনো জামায়াতপন্থি শিক্ষকরা। আমি দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরপেক্ষ কোনো শিক্ষক নেই। প্রত্যেকেই নিজ নিজ দলীয় স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো দলের সঙ্গে নেই। যতদিন ক্যাম্পাসে আছি শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে যাব।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়